কামাল হোসেন
আমরা যখন বলি বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম দাবিদার এই জাতি আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে যাওয়ায় তাদের কোনো নামাজ রোজা, হজ্ব, কোরবানি কিছুই আর আল্লাহর কাছে কবুল হয় না, তখন কিছু লোক বলেন- কার নামাজ রোজা হয় কার হয় না এটা আপনি কীভাবে বলেন? কোনো আমল কবুল হয় কি হয় না সেটা বোঝার সহজ পন্থা রয়েছে।
যেমন আল্লাহ বলেছেন সালাহ মানুষকে অশ্লীল অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে (সুরা আনকাবুত ৪৫)। একশত বছর আগে পৃথিবীতে মসজিদের সংখ্যা যা ছিল বর্তমানে তার থেকে কমপক্ষে একশত গুন বেড়েছে, নামাজির সংখ্যাও সে অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত অধিকাংশ মসজিদে জুমার দিন স্থান সংকুলান হয় না। কিন্তু সমাজে অন্যায় অবিচার চুরি ডাকাতি হত্যা সর্বপ্রকার অশ্লীলতা ধাই ধাই করে বেড়েছে। সুতরাং এই নামাজিদের নামাজ কবুল হচ্ছে না, অন্যথায় আল্লাহর বাণী মিথ্যা হয়ে যায়। তারা জামাতে নামাজ পড়ে। জামাত মানে ঐক্য, অথচ পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠী বাদ দিলাম, আমাদের এই ষোল কোটি বাঙালি ধর্মীয় ও রাজনীতিকভাবে শত শত ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। অনেক সময় মসজিদ থেকেই অনৈক্যের আহ্বান জানানো হয়। জামাতে নামাজ পড়ে বাইরে গিয়ে তারা যার যার মতো সরকারি, বিরোধী জোট ইত্যাদি পরিচয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য রক্তপাত ও সংঘাত করতে থাকে। সুতরাং নামাজের এই বৃহৎ জামাত তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারছে না। সুতরাং নামাজ কবুল হচ্ছে না। তাছাড়া মহানবী বলে গেছেন, এমন সময় আসবে যখন মসজিদসমূহ লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু তাতে হেদায়াহ থাকবে না (আলী রা. থেকে বায়হাকী, মেশকাত)। সুতরাং হেদায়াহ্হীন পথভ্রষ্ট জাতির নামাজ কবুল হবে না, এটা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।
রোজা বা সওমের অর্থ হচ্ছে সংযম। রমজান মাসে আমাদের দেশে মানুষের খাওয়ার খরচ ও রসনা বিলাস বাড়ে না কমে? আমাদের ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেন সেটা কি সংযমের পরিচয়? রমজান মাসে কি আমাদের দেশে অপরাধ কম সংঘটিত হয়? না। তাহলে এ জাতির রোজা যে কবুল হয় না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাদের হজ্বও হয় না, কারণ হজ্ব হল মুসলিম উম্মাহর বার্ষিক সম্মেলন। যেই সম্মেলনে মুসলিম উম্মাহর সমস্যা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করে এর প্রতিবিধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে ধর্মবাণিজ্যের প্রতিই সবার ঝোঁক, আর হাজীদের ঝোঁক একটি আলহাজ্ব উপাধির প্রতি আর নিষ্পাপ হয়ে জান্নাতে যাওয়ার প্রতি। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয় কিন্তু একটি সংকটেরও পরিত্রাণ হজ্বের আসরে মেলে না। প্রতি বছর সঙ্কট শুধু বেড়েই চলে। সুতরাং এই হজ্বের কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই।
একইভাবে কোরবানিও কবুল হচ্ছে না। কোরবানি কবুল হলো কি হলো না তা বোঝার জন্য পূর্বে একটি ব্যবস্থা ছিল। আদম (আ.)-এর সময় থেকেই কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট বস্তু বা জন্তুকে কোনো একটি উঁচু স্থান বা পাহাড়ে রেখে আসা হতো। যার কোরবানি আল্লাহপাক কবুল করতেন, সেই বস্তু বা জন্তুটিকে আকাশ থেকে একটি আগুনের ফুলকি এসে জ্বালিয়ে দিত। আর কবুল না হলে যেভাবে জবেহ করেছে সেভাবেই পড়ে থাকতো। ইব্রাহীম (আ.) ও তার পরবর্তীতে কোরবানির পশুকে জবেহ করে কাবার সামনে অথবা উপসনালয়ের সামনে রেখে দিত। সেই রীতি এখনও থাকলে আজকের লোক দেখানো ধার্মিকদের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেত।
সেটা না হলেও কোরবানি হয় কি হয় না তা বোঝার আরো উপায় আছে, সেটা হচ্ছে সমাজে কোরবানির প্রভাব প্রকাশিত হবে। কোরবানি এসেছে ‘র্কুব’ শব্দ থেকে যার অর্থ নৈকট্য। জীবন ও সম্পদ ত্যাগের দ্বারাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যাবে তাই কোরবানি করার আদেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ যাদের কোরবানি কবুল হবে তারা আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত হবে। পরিণামে তাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে ঐক্য, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব, মমত্ববোধ, সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি থাকবে। আর সেটাই হবে পারস্পরিক ত্যাগ ও কোরবানির সামষ্টিক রূপ। এটাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার প্রমাণ। পক্ষান্তরে যাদের সামষ্টিক ও জাতীয় জীবনে অন্যায় অবিচার, হানাহানি, ষড়যন্ত্র, মিথ্যা, প্রতারণা, যুদ্ধ, রক্তপাত, এক কথায় ভয়াবহ অশান্তি বিরাজ করে তাদের কোনো কোরবানি হয় না, সেটা যে আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার চূড়ান্ত মহড়া (Displaying egotism) তা বুঝতে অধিক বিদ্যাবুদ্ধি লাগে না। এই অন্যায়পূর্ণ সমাজই বলে দেয় যে, তারা আল্লাহর নিকটে যেতে পারে নি, আল্লাহর কাছ থেকে সরে গেছে। উল্টো তারা শয়তানের নিকটবর্তী হয়ে গেছে।
ইসলামের অধিকাংশ এবাদতই সামষ্টিক জীবনের কল্যাণার্থে, তাই কোনো এবাদত সফল হলে সমাজে তার প্রভাব পড়বেই। তাই বিবেচনা করে দেখুন আমাদের সমাজে নামাজ, রোযা, হজ্বের প্রভাব কতটুকু আছে? এগুলোর সঙ্গে সমাজব্যবস্থার বা জীবনব্যবস্থার আদৌ কি কোনো যৌক্তিক সম্পর্ক অবশিষ্ট আছে?
শেষ কথা হচ্ছে, গাছ তোমার নাম কী? গাছ বলল, ফলেই পরিচয়। দুটো গাছের ডাল পালা, পাতা, কা- যতই একরকম দেখতে হোক না কেন, ফলেই তাদের পরিচয় প্রমাণ করে দেয়। তেমনি এই জাতির লোকেরা যতই আমল করুক, তাদের সমাজের অশান্তিময় বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে যে তাদের সব আমলই অর্থহীন হচ্ছে। যাদের দুনিয়া সুন্দর তাদের আখেরাতও সুন্দর। যাদের দুনিয়া কুৎসিত তাদের আখেরাতও কুৎসিত। এ কথা শুনে আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে লাভ নেই, বরং আত্মশুদ্ধি ও পরিত্রাণের পথ সন্ধান করা আমাদের প্রত্যেকের উচিত।