মোহাম্মদ আসাদ আলী
একটি গান আমরা সকলেই শুনেছি- ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই, বল আমারে তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই।’ উত্তাল পদ্মার যেন কোনো কুল-কিনারা নেই, সে ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিতে চায় সবকিছু। তার বিশালতার মাঝেও হিংস্রতা স্পষ্ট। আজ দুনিয়াময় গণতন্ত্রের নামে যে সিস্টেমটি চলছে তা যেন ওই উন্মত্ত পদ্মারই স্বভাব ধারণ করেছে। সে একদিকে নিজেকে উদার ভাবে, পরমতসহিষ্ণুতার দীক্ষা প্রদান করে, অধিকারের কথা বলে, অন্যদিকে সবার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সে সমস্ত পৃথিবীকে পদানত করে রাখতে চায়, মানুষের সাথে, মানবতার সাথে তার প্রতারণা সুস্পষ্ট।
দুনিয়াময় আজ গণতন্ত্রের নামে যা চলছে সেখানে কেবল অনৈক্যের সুর, ভাঙ্গনের সুর। পরিবার ভাঙছে, সমাজ ভাঙছে, দল ভাঙছে, রাষ্ট্র ভাঙছে। অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাত ও ধ্বংস- গণতন্ত্রের এই অশুভচক্রে আটকা পড়েছে রাষ্ট্রসমূহ। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র রপ্তানি করতে গিয়ে পরাশক্তিধর শোষক রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্যে দখলদারিত্ব চালাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ জনপদকে বিরানভূমিতে পরিণত করছে। প্রয়োজনে চালানো হচ্ছে গণহত্যা। এদিকে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো না পারছে এহেন গণতন্ত্রকে হজম করতে, না পারছে উগরে দিতে। জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, ভাঙচুর, অবরোধ-হরতাল এসব দেশের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশ্চাত্যের পানে বাড়ানো ভিক্ষার হাত দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। পদানত রাষ্ট্র আরও পদানত হচ্ছে। চূড়ান্তবিচারে লাভবান হচ্ছে একমাত্র পাশ্চাত্য শোষক রাষ্ট্রগুলোই, যেখান থেকে এ শোষণযন্ত্রের সূচনা হয়েছিল।
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র বরাবরই এক বৃহৎ ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গণতন্ত্রের আশায় বুক বেঁধেছে লাখো মানুষ। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে গণতন্ত্রের দাবিতে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে। উত্তপ্ত স্লোগানে স্লোগানে গরম হয়ে উঠেছে রাজপথ। বুলেটে ঝাঝরা হয়েছে কত বুক। তারপর একসময় শোনা গেল গণতন্ত্র নাকি মুক্তি পেয়েছে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বিজয়ের আস্ফালন করল। নব্বই এর দশকে যাত্রা শুরু করল কথিত গনতন্ত্র। কিন্তু যে শান্তির জন্য এতকিছু, তার এতটুকু চিহ্নও কি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনামলের কয়েক দশকের ইতিহাসে আমরা পেয়েছি? গণতন্ত্র চলছে, পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হচ্ছে, ক্ষমতা পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু দেশবাসীর ভাগ্যের কাক্সিক্ষত কোনো পরিবর্তন নেই।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে যা চালানো হয় তাকে এক কথায় ‘সর্বনাশা’ বললে অত্যুক্তি হয় না। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক দল হিসেবে পরিচিত। তারা কথিত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে যোগ দেয়, গণতান্ত্রিকভাবে জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসে। সবার মুখেই গণতন্ত্রের বুলি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- কোনটা গণতন্ত্র আর কোনটা স্বৈরতন্ত্র সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত এরা ঐক্যমতে পৌঁছতে পারল না। যে দল ক্ষমতায় বসে তার কাছে গণতন্ত্রের মানে একরকম, যে দল পরাজিত হয় তার কাছে অন্যরকম। ইদানিং শুরু হয়েছে- ‘গণতন্ত্রের আসল রূপটা কী’ এই নিয়ে বিতর্ক। সরকার যেখানে দেশে গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই দেখছে না, সেখানে বিরোধী পক্ষগুলোর অভিযোগ হলো দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সরকার বলছে, এই দেখো, দেশ চলছে একশভাগ সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন হচ্ছে সংবিধান মেনে, বিচারবিভাগ কাজ করছে স্বাধীনভাবে, যে কেউ সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে পারছে, দাবি আদায়ের আন্দোলনও করছে অনেকে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়নের জোয়ার বইছে। মানুষ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো আছে। এটাই গণতন্ত্র। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষটি বলছে, না, দেশের কোথাও গণতন্ত্র নেই। দেশ চলছে স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়লাভ করলেই কেবল সে সরকার বৈধ হয়। এ সরকার সেই শর্ত পূরণ করে নি। এ বিতর্ক আজকের হলেও, খেয়াল করলে বোঝা যাবে, একই ধরনের বিতর্ক আমাদের দেশে দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। সম্প্রতি এ ধরনের বিতর্কে নতুন একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। গণতন্ত্র জরুরি নাকি উন্নয়ন জরুরি- কোনটা আগে? যদি গণতন্ত্র জরুরি হয় তাহলে কোন গণতন্ত্র? সীমিত গণতন্ত্র (Controlled democracy) নাকি বিস্তৃত পরিধির গণতন্ত্র (wide space democracy)? এসব নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। সব কিছুতেই যারা গণতন্ত্রের সার্থকতা খুঁজেন, তাদের নিজেদের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই, তা কি হয়? ইদানীং তাই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার জোর চেষ্টা চলছে। রাজনীতিক দলের বা অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটাভুটির মাধ্যমে। কিন্তু যে গণতন্ত্র রাষ্ট্রে ব্যর্থ, তা দলে সফল হবে এমন আশা তো করা যায় না। পরিণাম- কাদা ছোঁড়াছুড়ি, চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি, শক্তিশালী সিন্ডিকেট, এক কমিটিকে আরেক কমিটির অস্বীকার। কোনো কোনো জেলায় দশকের পর দশক চলে যায়, কমিটি গঠন করতে পারে না। মারামারি, খুনোখুনি ও আতঙ্কের কারণে শেষ পর্যন্ত আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দল চলে। কাজের কাজ এই হয় যে, গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ফুটো আরও বড় হয়।
এই সর্বনাশা বহুরূপী পুঁজিবাদী গণতন্ত্র জাতিটাকে শেষ করে দিল। একদিকে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার নগ্ন প্রতিযোগিতা, হামলা-মামলা, খুন-খারাবি, হয়রানি, দমন-পীড়ন; অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ভাঙচুর, মানুষ পোড়ানোসহ যার যা খুশি বলা, যার যা খুশি লেখা ও যার যা খুশি করার মানসিকতা এ জাতিকে একটি মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দেয় নি। স্রোতস্বিনী নদী যেমন তার স্রোতের টানে একটু একটু করে তীরের গাছপালা, গ্রাম-গঞ্জ, বাজার ও জনপদ ধ্বংস করে নিজেকে বিস্তৃত করে, তেমনি চলমান সর্বনাশা গণতন্ত্র এ জাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে চলেছে।
গণতন্ত্রের উৎপত্তি ইউরোপে। মধ্যযুগের বর্বরতা কাটিয়ে উঠার জন্য এমন একটি সিস্টেম ইউরোপের প্রয়োজন হয়েছিল। ধর্মের নামে চালানো চার্চের অধর্মের অপশাসন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যশীল জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপীয়ানরা তাই গণতন্ত্র আবিষ্কার করে। পরবর্তীতে শিল্পবিপ্লবের ফলে গণতন্ত্র পরিণত হয় পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে। তার কুফল থেকে মানুষকে বাঁচাতে আবার একদল সমাজচিন্তক আবিষ্কার করেন সমাজতন্ত্র। সেই সমাজতন্ত্রও যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, সমস্ত পৃথিবীকে পুনরায় গ্রাস করে নিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। ঔপনিবেশিক আমল শেষ হয়ে গেলে, নব্য নাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদের আধুনিকতম পদ্ধতি হিসেবে গরীব দেশগুলোতে গণতন্ত্র রপ্তানি করতে শুরু করল। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল সেই ব্রিটিশ, যাদের অপশাসন, দমন-পীড়ন ও শোষণের দাগ তখনও ভারতের বুকে দগদগ করছে। যাদের দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক আমলে একবারের জন্যও গণতন্ত্রের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় নি। যুগে যুগে এ উপমহাদেশের মানুষের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতির যোগসূত্র রচিত হয়েছে ধর্মের দ্বারা। সেই ধর্মকেই অবাঞ্ছিত করে রেখে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের নামে এমন একটি সিস্টেম তারা চাপিয়ে দিল যার সাথে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, রুচি-অভিরুচি, কৃষ্টি-কালচার ও ধ্যান-ধারণার বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য নেই। আমাদের দেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কটাবস্থা ও বিভিন্ন জটিলতার প্রধান কারণ এটাই। এছাড়াও রয়েছে প্রাচ্যের এই দেশগুলোর দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে চালানো পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের বহুমুখী শোষণ। গণতন্ত্রের প্রধান কুফল- জাতির ঐক্য বিনষ্টকরণ। যে জাতিতে যত বেশি অনৈক্য, সেই জাতিকে শোষণ করা তত সহজ। গণতন্ত্র এ কাজটি খুব সহজ করে দিয়েছে। আর সে কারণেই গণতন্ত্রের জন্য পাশ্চাত্যের এত মায়াকান্না।
আজ সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের তত্ত্বকথা অনেক শোনা হয়েছে। সেগুলো যে ‘শাখের করাত’ ছাড়া কিছুই নয় তা প্রমাণ হতে বাকি নেই। সুন্দর সুন্দর শব্দজাল বিছিয়ে জাতিকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থানে আটকে রাখা হয়েছে। তাই আর সংজ্ঞা দেখে নয়, ফলাফল দেখে বিচার করতে হবে। আর নির্লিপ্ত থাকা চলে না। সবাইকে বসতে হবে। রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সকলে মিলে আসুন আমরা একটি ঐক্যমতে পৌঁছাই। আমাদের বিশ্বাস, কৃষ্টি-কালচার, রুচি-অভিরুচি অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং প্রাকৃতিক সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত এমন একটি সিস্টেম দাঁড় করাই যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের মতো ভাগ্যবরণ করা থেকে রক্ষা করবে, সেটা যে তন্ত্রই হোক না কেন।