মো. সাজ্জাদ কাদির খান:
জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। একটি জাতির প্রধান শক্তিই হলো ঐক্য। ঐক্যহীন জাতি ধনে, বলে যতই শক্তিশালী হোক কোনো বড় কাজে সফল হওয়া সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালে আমরা ছিলাম সাড়ে সাত কোটি। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়-অবিচার, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বলতেই ছিল এই সাড়ে সাত কোটি জনতা। তবে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, যে যেভাবেই তাফসির করুক না কেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি সেদিন ছিল ঐক্যবদ্ধ, এতে কারও দ্বিমত নেই। এই ঐক্যই আমাদের বিজয়ী করেছিল। আমরা পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে নিস্তার পেয়েছিলাম। কিন্তু বিজয়ের কিছুকাল পরেই আমরা আমাদের প্রধান শক্তি তথা ‘ঐক্য’কে ধরে রাখতে ব্যর্থ হই। বিভিন্ন মত-পথ, দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ি। সৃষ্টি হয় বিবিধ প্রকারের ধর্মীয় কোন্দল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা। বাঙালি জাতির এই যে অধঃপতন, এর জন্য দায়ী মূলত দু’টি শ্রেণি। এক, পশ্চিমা পরাশক্তি; দুই, ধর্মের ধারক-বাহক সেজে থাকা ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই উভয় শ্রেণির ষড়যন্ত্র ও স্বার্থ উদ্ধারের ঘৃণিত অপচেষ্টায় এক কালের ঐক্যবদ্ধ এই জাতিতে আজ বিরাজ করছে শত শত মত-পথ-রাজনৈতিক দল, উপদল ও মাজহাব, ফেরকা। প্রতিনিয়তই এক দল বা এক মতের অনুসারীরা অন্য দল-মতের অনুসারীদের উপর শত্রুরূপ ধারণ করে আক্রমণ চালাচ্ছে, ভ্রাতৃঘাতী নৃশংসতার পরিচয় দিচ্ছে। একটি জাতির জন্য এর থেকে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় আর হতে পারে না।
আজ আমরা ষোল কোটি। বিশাল শক্তির আধার। কিন্তু তবুও আমাদের দিন দিন কেবল অধোগতিই প্রাপ্ত হচ্ছে। এত প্রচেষ্টা, এত প্রচার-প্রচারণা, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠার মতো সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান, অনুসন্ধান ও প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা গেছে, আমাদের জাতীয় উন্নতির পেছনে প্রধান অন্তরায় হলো ‘অনৈক্য’, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনৈক্য। গত বছরেই আমরা এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। রাজনৈতিক অনৈক্য একটি জাতিকে কতটা নিরূপায় করে দিতে পারে, জাতির উন্নতির রাশ টেনে ধরে রাখতে পারে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে গত বছর ব্যাপী। কাজেই এখন আমাদের একমাত্র করণীয় হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আমরা যদি যাবতীয় অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করতে পারি, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, রক্তারক্তির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারি, তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন আমরা এই বাঙালি জাতিই পরিণত হব পৃথিবীর অপ্রতিরোধ্য পরাশক্তিতে। মনে হতে পারে আমাদের এই ছোট্ট দেশ কীভাবে পৃথিবীর পরাশক্তি হবে? এর উত্তরে প্রথমেই বলব- ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল জাতিমাত্রই পরাশক্তি। ঐক্যবদ্ধ জাতিকে পরাজিত করা তো দূরের কথা, সে জাতির সামান্য পরিমাণ ক্ষতিসাধনও কেউ করতে পারে না। তবে তার জন্য অবশ্যই একটি ইস্পাত কঠিন নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ মোটেও অপ্রতুল নয়। পৃথিবীর বহু বড় বড় শক্তিধর দেশ রয়েছে যাদের তুলনায় আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল, আমরা এই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের দেশে যতজন কর্মক্ষম মানুষ আছে, পৃথিবীর বহু দেশ রয়েছে যে দেশের মোট জনসংখ্যাও তার চেয়ে কম। আমরা এই বিরাট লোকবলকে উপযুক্ত কাজে লাগাতে পারি। জনশক্তিকে শুধুই জনসংখ্যা বিবেচনা করে তাদেরকে একত্রিত করে একসাথে গান গেয়ে গিনেচ বুকে নাম লেখানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব হবে তখন, যখন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা হবে। কর্মক্ষম শক্তি অনেক বড় শক্তি। এ শক্তির বিস্ফোরণ হবার জন্য ঐক্যই যথেষ্ট। কাজেই আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের পথ রুদ্ধ করি এবং ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মবাণিজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। যার কথায়, কাজে ঐক্য নষ্ট হয় তাকে প্রতিরোধ করি। দেশটাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করি।
এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আজকে দেখা যায়, এক নেতা মঞ্চে উঠেই আরেক নেতাকে গালাগালি করেন- এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর যুগ যুগান্তরের পরম্পরা এই যে, রাজার ধর্মই প্রজা অনুসরণ করে। রাজধর্মের ওপর নির্ভর করে প্রজার শান্তি-অশান্তি। কাজেই রাজনীতিকদেরকেই আগে ঐক্যের জয়গান গাইতে হবে, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের সমাধি রচনা করতে হবে। তবেই জনসাধারণ ঐক্যের প্রতি আকৃষ্ট হবে, নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবে। সমাজে নেমে আসবে শান্তির ঝর্ণাধারা।