ইসলামে সালাতের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব এত বড় যে তা বোঝাবার জন্য আমাকে আল্লাহর খলিফা অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির অধ্যায় থেকে শুরু কোরতে হবে- যদিও খুব সংক্ষেপে।
এই মহাবিশ্ব, অগণিত ছায়াপথ, নীহারিকা, সূর্য, চন্দ্র, তারা ও এগুলো সুশৃংখলভাবে পরিচালনা করার জন্য অসংখ্য মালায়েক সৃষ্টি করার পর আল্লাহর ইচ্ছা হোল এমন একটি সৃষ্টি করার যার মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি থাকবে। তাই তিনি নিজ হাতে সৃষ্টি কোরলেন আদম (আঃ) আর হাওয়াকে। আদমের (আঃ) মধ্যে আল্লাহ তাঁর নিজ রূহ্ থেকে ফুঁকে দিলেন (কোরান- সুরা হেজর ২৯) তাঁর নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ সব গুণাবলি। নাম দিলেন আল্লাহর প্রতিনিধি- খলিফাতুল্লাহ। তারপর আদম ও হাওয়ার (আঃ) দেহের ভেতরে প্রবেশ কোরে তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনায় প্রভাব ফেলার শক্তি দিলেন এবলিসকে আদম-হাওয়াকে পরীক্ষার জন্য (কোরান- সুরা নেসা ১১৯)। আদমের (আঃ) কারণে আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত হোয়ে এবলিস আল্লাহকে বোলল যে তোমার এই খলিফাকে দিয়ে আমি তোমাকে অস্বীকার করাবো। জবাবে আল্লাহ বোললেন- আমি যুগে যুগে নবী-রসুল পাঠিয়ে বনী আদমকে হেদায়াহ সঠিক দিক নির্দেশনা অর্থাৎ সেরাতুল মুস্তাকীম দান কোরব। যারা এই সেরাতুল মুস্তাকীমের ওপর দৃঢ় থাকবে তুমি তাদের বিপথে চালনা কোরতে পারবে না, তারা হেদায়াতে থাকবে, তাদের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা কোরে আমি তাদের জান্নাতে দেব। জবাবে এবলিস বোলল- তুমি তোমার খলিফাকে যে সেরাতুল মুস্তাকীম দেবে তার সম্মুখে, পেছনে, ডানে, বামে আমি ওঁৎ পেতে বোসে থাকবো (আর তাদের সে পথ থেকে ছিনিয়ে নেবো); আর দেখবে যে তাদের অধিকাংশ অকৃতজ্ঞ (অর্থাৎ অধিকাংশই আমি ছিনিয়ে নেব)। এর উত্তরে আল্লাহ বোললেন তোমাকে এবং যাদের তুমি সেরাতুল মুস্তাকীম থেকে ছিনিয়ে নেবে তাদের দিয়ে আমি জাহান্নাম ভর্ত্তি কোরবো (সুরা আ’রাফ- ১৭,১৮)। এখানে বলা প্রয়োজন এই সেরাতুল মুস্তাকীম কী? দেখা যাচ্ছে আল্লাহর সাথে এবলিসের চ্যালেঞ্জটা সালাহ্ (নামাজ), সওম (রোযা), হজ্ব, যাকাত বা চুরি ডাকাতি, ব্যাভিচার, খুন নিয়ে নয়, চ্যালেঞ্জটা এই সেরাতুল মুস্তাকীমটাকেই নিয়ে।
এই সেরাতুল মুস্তাকিম হোচ্ছে তওহীদ- লা এলাহা এল্লা আল্লাহ। (কোরান- সুরা ইয়াসিন- ৬১ ও কোরানের বিভিন্ন স্থানে)। কিন্তু আল্লাহ যে লা-এলাহা ইল্লাল্লাহর কথা বোলেছেন তা বর্ত্তমানে পৃথিবীতে প্রচলিত লা-এলাহা এল্লা আল্লাহ নয়। বর্ত্তমানে মোসলেম জগতের সকলেই লা এলাহা এল্লা আল্লাহ-এ বিশ্বাস করে, কিন্তু তারা সেরাতুল মুসতাকীমে, সহজ-সরল পথে নেই। কারণ প্রকৃত তওহীদ অর্থাৎ লা-এলাহা এল্লা আল্লাহ হোচ্ছে আল্লাহকে ছাড়া আর সমস্ত রকম ক্ষমতাকে অস্বীকার করা; এবং এই অস্বীকার জীবনের সর্বক্ষেত্রে, সর্ব অঙ্গনে। এক কথায় যে কোন বিষয়ে, যে কোন প্রশ্নে, যেখানে আল্লাহ বা তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য আছে সেখানে আর কারো কথা, আদেশ, নিষেধ, নির্দেশ অগ্রাহ্য করা (সুরা আহযাব- ৩৬); হোক সেটা ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, আইন-কানুন, দ-বিধি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সমাজ-ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য। এখানে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সঙ্গে রসুলকেও অঙ্গীভূত কোরছি এই কারণে যে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ হাতে-কলমে কার্যকরী কোরে দেখানোর দায়িত্ব তাঁর রসুলের এবং তিনি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, নির্দেশের বাইরে কিছুই করেন না, কিছুই বলেন না (কোরান সুরা নজম-৩-৪)। এই হোল ইসলামের সেরাতুল মুস্তাকীম। বর্ত্তমানে অন্য জাতিগুলির তো কথাই নেই- মোসলেম হবার দাবীদার এই একশ’ পঞ্চাশ কোটির জাতির মধ্যেও কোথাও নেই এবং তাদের মধ্যে এ বোধ ও উপলব্ধিও নেই যে তওহীদ না থাকার অর্থই হোচ্ছে শেরক ও কুফর এবং তওহীদহীন কোন এবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। যে বিষয়ে আল্লাহ বা তাঁর রসুলের কোন নির্দেশ আছে সেটা যত ছোট, যত সামান্যই হোক সে বিষয়ে অন্য কারো নির্দেশ, ব্যবস্থা গ্রহণ মানেই শেরক, অংশীবাদ, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও স্বীকার করা।
শুরু হোল বিশাল খেলা, বিরাট পরীক্ষা। আল্লাহ তাঁর কথামত যুগে যুগে প্রতি জনপদে পাঠাতে লাগলেন তাঁর নবী-রসুলদের সেরাতুল মুস্তাকীম দিয়ে, অর্থাৎ তওহীদ দিয়ে।
আল্লাহ নবী-রসুলদের মাধ্যমে বনি-আদম, মানুষকে আরও জানিয়ে দিলেন যে, যে বা যারা ঐ সেরাতুল মুস্তাকীমে অর্থাৎ তওহীদের ওপর অটল থাকবে জীবনের কোন অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মানবে না, স্বীকার কোরবেনা তাদের তিনি সমস্ত অপরাধ, পাপ, গোনাহ মাফ কোরে জান্নাতে স্থান দেবেন চিরকালের জন্য (কোরান- সুরা যুমার- ৫৩)। আর যে বা যারা জীবনের যে কোন অঙ্গনে, যে কোন বিষয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অস্বীকার কোরে অন্য কোন শক্তি বা নিজেদের তৈরী আদেশ-নিষেধকে মেনে নেবে তারা জীবনে যত পুণ্য, যত সওয়াবই করুক, যত ভালো কাজই করুক আল্লাহ তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ কোরবেন চিরকালের জন্য (সুরা মায়েদা- ৭২, সুরা নেসা- ৪৮, বোখারী, মোসলেম, তিরমিযি)।
আল্লাহর নবী-রসুলরা যুগে যুগে প্রতি জনপদে ঐ তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নিয়ে আসতে লাগলেন আর ঐ তওহীদের ওপর ভিত্তি কোরে দীন প্রতিষ্ঠা কোরতে লাগলেন। আদমের (আঃ) মাধ্যমে আল্লাহ বনি-আদমকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান কোরেছেন- যার ইচ্ছা সে আল্লাহর তওহীদ, সার্বভৌমত্ব স্বীকার ও গ্রহণ কোরতে পারে, যার ইচ্ছা তওহীদ অস্বীকার কোরে অন্যের প্রভুত্ব, সার্বভৌমত্ব স্বীকার কোরতে পারে (কোরান- সুরা কাহাফ- ২৯)। যুগে যুগে আল্লাহ যাদের হেদায়াহ অর্থাৎ সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তারা সেরাতুল মুস্তাকিম অর্থাৎ তওহীদে বিশ্বাসী হোয়ে নবী রসুলকে মেনে নিয়েছে। নবী-রসুলরা তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তির ওপর দীনের এমারত, অট্টালিকা তৈরী কোরেছেন। যারা তওহীদে, সেরাতুল মুস্তাকীমে বিশ্বাস কোরেছে তারা ঐ এমারত, অট্টালিকায় বসবাস কোরতে শুরু কোরেছে।
যথাসময়ে নবী-রসুলরা পৃথিবী থেকে চোলে যাবার পর এবলিসের প্ররোচনায় মানুষ তওহীদ ভিত্তিক ঐ এমারত ভাংতে শুরু কোরেছে এবং ধীরে ধীরে ওর কাঠামো এবং শেষে ভিত্তি তওহীদ সুদ্ধ ভেংগে ফেলেছে। এরপর রহমানুর রহিম আবার নবী-রসুল পাঠিয়েছেন। তাঁরা এসে মানুষকে বোলেছেন- তোমরা তো আল্লাহর দেয়া দীনটাকে নষ্ট কোরে ফেলেছো, এমারত ভেংগে ফেলেছো এবং শেরক ও কুফরীতে ফিরে গেছো। শুধু তাই নয় এর ভিত্তি, তওহীদটাকেও তো টুকরো টুকরো কোরে ফেলেছো এবং শেরক ও কুফরীতে ফিরে গেছো। আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর তওহীদ, তাঁর সার্বভৌমত্ব, সেরাতুল মুস্তাকিম দিয়ে, এবং এই তওহীদের ভিত্তির ওপর দীনের এমারত তৈরী করার দায়িত্ব দিয়ে। কোন কোন নবীকে তার জাতি গ্রহণ কোরেছে, কোন নবীকে কিছু মানুষ গ্রহণ কোরেছে, কিছু আগের নবীর বিকৃত দীনটাকেই ধোরে রেখেছে, আর কোন নবীকে মানুষ এবলিসের প্ররোচনায় অস্বীকার কোরেছে, এমন কি হত্যাও কোরেছে (মায়েদা- ৭০)।
এই ভাবে নবী-রসুলদের আল্লাহর তওহীদ ও তওহীদ ভিত্তিক দীন প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতার শেষ প্রান্তে পৃথিবীতে আল্লাহ পাঠালেন তাঁর হাবিব মোহম্মদ (দঃ) বিন আবদুল্লাহকে (কোরান- সুরা আহযাব- ৪০)। পূর্ববর্ত্তী সব নবী-রসুলদের মত ইনিও সেই একই দায়িত্ব নিয়ে এলেন; আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা। তফাৎ শুধু এইটুকু যে পুর্ববর্ত্তীদের দায়িত্ব ছিলো তাদের যার যার সমাজ, গোত্র, জাতির মধ্যে সীমিত, আর এই শেষ-নবীর দায়িত্ব হোলো সমস্ত পৃথিবীর (সুরা নেসা- ১৭০, সুরা ফোরকান- ১)।
এখন একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে আল্লাহ নবী-রসুলদের মাধ্যমে যে তওহীদ ভিত্তিক দীন মানব জাতির জন্য দান কোরেছেন এবং শেষ নবীও যেটা মানুষকে শেখালেন সেটা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, ওটার শুধু খোলসটা আছে। আজ মোসলেম বোলে পরিচিত জাতিটি যেটাকে দীনুল ইসলাম বোলে তাদের জীবনে পালন কোরছে সেটা নবীর শেখানো ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাজেই এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটার যে জবাব আমি এখন দেব সেটা এই বিপরীতমুখী দীনের অনুসারিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেনা; শুধুমাত্র আল্লাহ যাদের হেদায়াহ কোরবেন তারা ছাড়া।
আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত দীন (জীবন-ব্যবস্থা) অবলুপ্ত কোরে দিয়ে এই সঠিক দিক নির্দেশনা (তওহীদ, সেরাতুল মুস্তাকিম) ও এই সত্যদীন (জীবন-ব্যবস্থা, শরিয়াহ) প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিলেন- এই সত্য আমরা পাচ্ছি প্রত্যক্ষ, সরাসরি কোরানে তিনটি আয়াত থেকে (কোরান- সুরা তওবা ৩৩, ফাতাহ ২৮, সফ ৯), এবং পরোক্ষভাবে সমস্ত কোরানে শত শত আয়াতে। প্রশ্নটি হোচ্ছে- আল্লাহ শেষ নবীকে এই বিশাল দায়িত্ব দিলেন কিন্তু কেমন কোরে, কোন নীতিতে তিনি এ কাজ কোরবেন তা কি আল্লাহ তাঁকে বোলে দেবেন না? আল্লাহ সোবহান, অর্থাৎ যার অণু পরিমাণও খুঁত, ত্রুটি, অক্ষমতা, অসম্পূর্ণতা বা চ্যুতি নেই। কাজেই তাঁর রসুলকে আল্লাহ এক বিরাট, বিশাল দায়িত্ব দিলেন কিন্তু কেমন কোরে, কোন্ প্রক্রিয়ায় তিনি তা কোরবেন তা বোলে দেবেন না, তা হোতেই পারে না। কাজেই আল্লাহ তাঁর নবীকে ঐ দায়িত্বের সঙ্গে ঐ কাজ করার নীতি ও প্রক্রিয়া অর্থাৎ তরিকাও বোলে দিলেন। সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন প্রতিষ্ঠার নীতি হিসাবে আল্লাহ তাঁর রসুলকে দিলেন জেহাদ ও কেতাল- অর্থাৎ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সশস্ত্র সংগ্রাম; এবং ঐ নীতির ওপর ভিত্তি কোরে একটি পাঁচদফার কর্মসূচি। ঐ পাঁচ দফা হোল- ১) ঐক্য, ২) শৃংখলা, ৩) আনুগত্য, ৪) হেজরত, ৫) জেহাদ, যুদ্ধ (হাদীস- তিরমিযী, মুসনাদে আহমেদ, আহমদ, বাব-উল-এমারাত)। পৃথিবীতে প্রচলিত অন্য সমস্ত জীবন ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় কোরে আল্লাহর দেয়া সঠিক দিক-নির্দেশনা ও সত্যদীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে যে নীতি ও তরিকা (প্রক্রিয়া, কর্মসূচি) দিলেন সেটা দাওয়াহ নয়; সেটা কঠিন জেহাদ, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
এর প্রমাণ আল্লাহর কোরান এবং তাঁর রসুলের জীবনী, কথা ও কাজ। আল্লাহ তাঁর কোরানে সশস্ত্র সংগ্রাম অর্থাৎ যুদ্ধকে মো’মেন, মোসলেম ও উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য ফরদে আইন কোরে দিয়েছেন সুরা বাকারার ২১৬ ও ২৪৪ নং আয়াতে, আনফালের ৩৯ নং ও আরও বহু আয়াতে। শুধু তাই নয় মো’মেন হবার সংজ্ঞার মধ্যেই তিনি জেহাদকে অন্তর্ভুক্ত কোরে দিয়েছেন। তিনি বোলেছেন- শুধু তারাই সত্যনিষ্ঠ মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর ঈমান এনেছে এবং তারপর আর কোন দ্বিধা-সন্দেহ করেনি এবং প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করেছে (কোরান- সুরা হুজরাত ১৫)। এই আয়াতে আল্লাহ মো’মেন হবার জন্য দু’টি শর্ত্ত রাখছেন। প্রথমটি হোল আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান; এটির অর্থ হোল জীবনের সর্ব অঙ্গনে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন-কানুন, দ-বিধি, অর্থনীতি, শিক্ষা- এক কথায় যে কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য আছে, আদেশ-নিষেধ আছে সেখানে আর কাউকে গ্রহণ না করা, কারো নির্দেশ না মানা যা পেছনে বোলে এসেছি এবং এ ব্যাপারে বাকি জীবনে কোন দ্বিধা, কোন সন্দেহ না করা অর্থাৎ তওহীদ। দ্বিতীয়টি হোল আল্লাহর ঐ তওহীদ, সার্বভৌমত্বকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম, যুদ্ধ করা। কারণ ঐ তওহীদ এবং তওহীদ ভিত্তিক দীন, জীবন-ব্যবস্থা যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা না হয় তবে দীনই অর্থহীন, যেমন বর্ত্তমানের অবস্থা। এই দু’টি শর্ত্ত হোল মো’মেন হবার সংজ্ঞা। যার বা যাদের মধ্যে এই দু’টি শর্ত্ত পূরণ হোয়েছে সে বা তারা প্রকৃত মো’মেন আর যে বা যাদের মধ্যে এই দু’টির মধ্যে একটি বা দু’টিই শর্ত্ত পুরণ হয় নি, সে বা তারা প্রকৃত মো’মেন নয়; এবং মো’মেন নয় মানেই হয় মোশরেক না হয় কাফের।
আল্লাহ জেহাদকে মো’মেন হবার সংজ্ঞার মধ্যে শর্ত্ত হিসাবে দিলেন, কেতাল অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রামকে ফরদে আইন কোরে দিলেন, তারপর সরাসরি হুকুম দিলেন- সশস্ত্র সংগ্রাম (যুদ্ধ) করো (বাকারা ২৪৪)। আরও বোললেন- সশস্ত্র সংগ্রাম (যুদ্ধ) করতে থাকো তাদের বিরুদ্ধে যে পর্যন্ত না সমস্ত অন্যায় অশান্তি বিলোপ হোয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা হয় (আনফাল ৩৯)। এইসব সরাসরি হুকুম ছাড়াও সমস্ত কোরানে আল্লাহ ছয়শত বারের বেশী সশস্ত্র সংগ্রামের উল্লেখ কোরেছেন। আল্লাহর এই নীতির প্রতিধ্বনি কোরে তার রসুল বোললেন- আমি আল্লাহর আদেশ পেয়েছি পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম (যুদ্ধ) চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া এলাহ নেই এবং আমি মোহাম্মদ আল্লাহর রসুল এবং সালাহ্ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয় [হাদীস- আবদুল্লাহ এবনে ওমর (রাঃ) থেকে বোখারী]। এছাড়াও আল্লাহ তাঁর কোরানে এবং আল্লাহর রসুল তাঁর জীবনের কাজে ও কথায় সন্দেহাতীত ভাবে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন যে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক এই দীনুল ইসলাম, দীনুল হককে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার নীতি হোচ্ছে সামরিক, অর্থাৎ জিহাদ, কেতাল। আল্লাহ নীতি হিসাবে যুদ্ধকে নির্দ্ধারণ কোরেছেন বোলেই তার নির্দেশে তাঁর রসুল মাত্র সাড়ে নয় বছরের মধ্যে কম কোরে হোলেও ১০৭টি যুদ্ধ কোরেছেন।
দীন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাঁর রসুলকে যে পাঁচ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন তার প্রথম চার দফা অর্থাৎ ১) ঐক্য, ২) শৃংখলা, ৩) আনুগত্য, আদেশ প্রতিপালন, ৪) হেজরত হোল জেহাদ করার পস্তুতি এবং পঞ্চম দফা হোচ্ছে জেহাদ, যুদ্ধ। প্রথম চার দফা ছাড়া যুদ্ধ করা যাবে না। জেহাদকে, সশস্ত্র সংগ্রামকে আল্লাহ নীতি হিসাবে নির্দ্ধারণ কোরেছেন বোলেই এই দীনে শহীদ ও মোজাহেদদের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা কোরে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেয়ার অঙ্গীকার কোরেছেন, জান্নাত নিশ্চিত কোরে দিয়েছেন (কোরান- সুরা সফ ১০-১২), এমন নিশ্চয়তা এই জাতির, উম্মাহর আর কোন শ্রেণী বা প্রকারের মানুষকে তিনি দেন নি। আল্লাহর এই নীতি নির্দ্ধারণ তাঁর রসুল বুঝেছিলেন বোলেই তিনি ২৩ বছরের কঠোর সাধনায় যে সংগঠন গড়ে তুললেন সেটার ইতিহাস দেখলে সেটাকে একটি জাতি বলার চেয়ে একটি সামরিক বাহিনী বলাই বেশী সঙ্গত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এই বাহিনী তার জন্মলগ্ন থেকে শুরু কোরে প্রায় একশ’ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে গেছে; এর সর্বাধিনায়ক (আল্লাহর রসুল) থেকে শুরু কোরে সাধারণ সৈনিক (মোজাহেদ) পর্যন্ত একটি মানুষও বোধহয় পাওয়া যেতনা যার গায়ে অস্ত্রের আঘাত ছিলো না; হাজারে হাজারে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেয়ার কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
তাহোলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক এই দীনকে সমস্ত পৃথিবীতে কার্যকর কোরে মানব জাতির জীবন থেকে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও রক্তপাত দূর কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আল্লাহ তাঁর রসুলকে পৃথিবীতে পাঠালেন এবং ঐ কাজ করার নীতি হিসাবে নির্দ্ধারিত কোরে দিলেন সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম এবং জেহাদ ভিত্তিক একটি ৫ দফার কর্মসুচি। তাঁর রসুল ঐ নীতি ও কর্মসুচির অনুসরণ কোরে গড়ে তুললেন এক দুর্দম, দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় সামরিক বাহিনী যার নাম হোল উম্মতে মোহাম্মদী। এই উপলব্ধি (আকীদা) থেকে আজ আমরা লক্ষকোটি মাইল দূরে অবস্থান নিয়েছি। এই কথা কোরান এবং হাদীস থেকে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করা যায়। কিন্তু তা কোরতে গেলে এই নিবন্ধ অতি বড় হোয়ে যাবে কাজেই আমি এখানেই এর ইতি টানবো। তবে ইতি টানার আগে দু’টি কথা না বোললেই নয়। একজন মানুষের এন্তেকালের সময় রেখে যাওয়া জিনিস-পত্র দেখেই ঐ মানুষটির সারা জীবনের কর্মকা- সমন্ধে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। যেমন- কোন লোকের মৃত্যুর পর তার ঘরে যদি শুধু মাত্র কয়েকটি পুরানো ইঞ্জিন, ড্রিল মেশিন, হাতুড়ী, রেঞ্জ এগুলো পাওয়া যায় তাহোলে লোকটির পূর্ব পরিচয় জানা না থাকলেও লোকটি যে মোটর মিস্ত্রী বা ইঞ্জিনিয়ার ছিলো তা কাউকে বলে দিতে হয় না, লোকটির মৃত্যুর সময় রেখে যাওয়া জিনিসগুলো দেখে খুব সহজেই তা বুঝা যায়। আবার কেউ যদি তার মৃত্যুর সময় তার ঘরে শুধুমাত্র হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল, তানপুরা ইত্যাদি কতগুলো গানের সরঞ্জাম রেখে যায় তাহোলে ঐ লোকটি যে গায়ক ছিলো তাও কাউকে বোলে দিতে হয় না, লোকটির সাথে কোন পূর্ব পরিচয় না থাকলেও না। তেমনি কেউ মৃত্যুর সময় যদি শুধুমাত্র কতকগুলো যুদ্ধের সরঞ্জাম রেখে যায়, তাহোলে সে যে একজন যোদ্ধা ছিল তাতেও কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
আল্লাহর শেষ রসুল এন্তেকালের সময় পার্থিব সম্পদ বোলতে রেখে যান (১) ১টি চাটাই, (২) ১ টি বালিশ (খেজুরের ছাল দিয়ে ভর্ত্তি) ও (৩) কয়েকটি মশক। আর রেখে যান
(১) ৯টি তরবারী, (২) ৫টি বর্শা, (৩) ১টি তীরকোষ, (৪) ৬টি ধনুক, (৫) ৭টি লৌহবর্ম, (৬) ৩টি জোব্বা (যুদ্ধের), (৭) ১টি কোমরবন্ধ, (৮) ১টি ঢাল এবং (৯) ৩টি পতাকা। (তথ্যসূত্র:- সিরাতুন্নবী- মওলানা শিবলী নোমানী)
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে তাঁর স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য কোরে এরশাদ করেছেন, হেদায়াহ ও সত্য দীন (জীবন-ব্যবস্থা)-সহ তোমাকে প্রেরণ করেছি এই জন্য যে, সমস্ত দীনের (জীবন-ব্যবস্থা) ওপর আমার এই দীনকে বিজয়ী কোরে দিবে (সুরা তওবা-৩৩, ফাতহ্-২৮)। আর এ বিজয়ী করার পথ হিসাবে নীতি নির্দ্ধারণ কোরে দিলেন জিহাদ ও কেতাল (সশস্ত্র সংগ্রাম)। তাইতো মো’মেন হওয়ার শর্ত্ত হিসাবে রাখলেন, জিহাদ ও কেতালকে। এজন্যই আল্লাহর রাসুল বললেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি ততক্ষণ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে, যে পর্যন্ত না প্রত্যেকটি মানুষ আল্লাহকে তাদের একমাত্র এলাহ হিসাবে এবং আমাকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে না নেয় [আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে- বোখারী]। আর এ আদেশ পালন কোরতে যেয়ে আমাদের নেতা রাসূলকে মাত্র ৯-১০ বৎসরে ছোট-বড় ১০৭টি যুদ্ধ কোরতে হোয়েছে। একজন যোদ্ধা হিসাবে তাঁকে জীবন-যাপন কোরতে হোয়েছে; অর্থাৎ তিনি একজন যোদ্ধা ছিলেন। উপরোক্ত উদাহরণগুলোর আলোকে এ সত্যের সত্যায়ন করে তাঁর রেখে যাওয়া জিনিসগুলো।
আল্লাহর রসুলের মুখ নিঃসৃত বাণীর সাথেও রয়েছে এগুলোর অপূর্ব মিল। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- আমি হোলাম যোদ্ধা নবী, আমি হোলাম দয়ার নবী (ইবনে তাইমিয়ার আস সিয়াসাহ আশ-শরীয়াহ, পৃষ্ঠা- ৮)
এ সম্বন্ধে আরও জানতে চাইলে আমার লেখা ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ বইটি পড়া দরকার। আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের যুগ অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সত্যদীনকে কার্যকরী কোরে সমস্ত পৃথিবীতে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠার যুগের পরবর্ত্তীতে ঐ সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দেবার পর জেহাদ, কেতালকে আত্মরক্ষামূলক বোলে প্রচার চালানো হয় ও তা গৃহিত হয়। শুধু তাই নয়, এমন কি বর্ত্তমানে এই জাতির কাছে ওটা কোন প্রয়োজনীয় কাজ নয় বোলেই বিশ্বাস করা হয়। মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতির এখন মনে নেই যে মো’মেন হবার সংজ্ঞার মধ্যেই যে জেহাদকে আল্লাহ অন্তর্ভুক্ত কোরে দিয়েছেন সে জেহাদকে শুধু আত্মরক্ষামূলক বলা বা প্রয়োজন নেই মনে কোরলে আর মো’মেন থাকা যায় না এবং মো’মেন না থাকার মানেই হয় মোশরেক না হয় কাফের হোয়ে যাওয়া যার পর আর সালাহ্-সওম (নামায-রোযা) সহ কোন এবাদতেরই আর কোন অর্থ থাকে না।
আল্লাহর আরেকটি কথাও মোসলেম ও মো’মেন হবার দাবীদার এ জাতির মনে নেই, তাদের ভুলিয়ে দেয়া হোয়েছে যে আল্লাহ বোলেছেন- তোমরা যদি (সামরিক) অভিযানে (অর্থাৎ দীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য) বের হওয়া ত্যাগ করো তবে তোমাদের কঠিন শাস্তি দেব এবং তোমাদের বদলে অন্য জাতিকে মনোনীত কোরবো; তোমরা তাঁর (আল্লাহর) কোন ক্ষতি কোরতে পারবেনা (কারণ) আল্লাহ সর্বশক্তিমান (সুরা আত তওবা ৩৮-৩৯)। রসুলের ওপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠার জন্য বের হোয়ে পড়া ছেড়ে দিলে আল্লাহ কী কোরবেন বোলে সাবধান কোরছেন তা লক্ষ্য করুন। আল্লাহ দুু’টো কথা বোলছেন- প্রথমটা কঠিন শাস্তি দেবেন, দ্বিতীয়টা এই জাতিকে ত্যাগ কোরে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠা কোরবেন অর্থাৎ তাদের হাতে কর্ত্তৃত্ব দেবেন। দুু’টো শাস্তিই প্রমাণ করে যে জেহাদ ত্যাগ কোরলে আর মো’মেন থাকা যায় না। কারণ প্রথমটি অর্থাৎ কঠিন শাস্তি আল্লাহ কখনও মো’মেনকে দেবেন না। আল্লাহ বোলছেন তিনি তাঁর মালায়েকদের নিয়ে মো’মেনদের ওপর সালাম পাঠান (সুরা আহযাব- ৪৩)। যাদের ওপর আল্লাহ একা নন, তাঁর কোটি কোটি, অসংখ্য মালায়েকদেরসহ সালাম পাঠান তাদের তিনি কঠিন শাস্তি দেবেন? অবশ্যই নয়। এ ছাড়াও হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বোলছেন- আমার কাছে একজন মো’মেনের সম্মান ও মরতবা আমার কাবার চেয়েও ঊর্দ্ধে। যাদের সম্মান ও মরতবা আল্লাহর কাছে তার কাবা ঘরের উর্দ্ধে, যাদের ওপর তিনি তাঁর অসংখ্য মালায়েকদের (ফেরেশতা) নিয়ে সালাম পাঠান তাদের তিনি অবশ্যই কঠিন শাস্তি দেবেন না। তাঁর শাস্তি অর্থই এই দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই।
দ্বিতীয়ত তিনি বোলছেন- তোমাদের বদলে অন্য জাতিকে মনোনীত কোরব অর্থাৎ তোমাদের পরিত্যাগ কোরব, তোমাদের বহি®কৃত কোরব, বিতাড়িত কোরব। আল্লাহ যাদের পরিত্যাগ কোরবেন, বহিষ্কৃত কোরে বাদ দিয়ে অন্য জাতি মনোনীত কোরবেন তারা কি আর মো’মেন থাকবে? অবশ্যই নয়। আল্লাহর প্রতিশ্রুত দুু’টো শাস্তি থেকেই দেখা যাচ্ছে যে জেহাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ কোরলে আল্লাহ আর মো’মেন বোলে গ্রহণ কোরবেন না। আরও লক্ষ্য করার বিষয় হোচ্ছে যে আল্লাহ কোথাও বলেন নাই যে সালাহ্ (নামায) ত্যাগ কোরলে বা সওম (রোযা) ত্যাগ কোরলে বা হজ্ব ত্যাগ কোরলে বা অন্য যে কোন এবাদত ত্যাগ কোরলে কঠিন শাস্তি দিয়ে এই দীন থেকেই বহিষ্কৃত কোরবেন, শুধু জেহাদ (সংগ্রাম) এবং আল্লাহর রাস্তায় (জেহাদে) ব্যয় ছাড়া (সুরা মুহাম্মদ ৩৮)।
মোসলেম বোলে পরিচিত ১৫০ কোটির এই জাতির অন্য সমস্ত জাতি দ্বারা পরাজিত, লান্ছিত, অপমানিত, ঘৃণিত হবার পরিপ্রেেিত আজ আমাদের পরিষ্কার কোরে বোঝা প্রয়োজনীয় হোয়ে পড়েছে যে জেহাদ ত্যাগ কোরলে ‘কঠিন শাস্তি’ ও আমাদের ‘পরিত্যাগ কোরে অন্য কোনও জাতিকে মনোনীত’ আল্লাহ কেন কোরবেন। সালাহ্ (নামায), যাকাহ, সওম (রোযা), হজ্ব ইত্যাদি দীনের হাজারো রকমের এবাদতের কোনটাই ত্যাগ কোরলে একত্রে ‘কঠিন শাস্তি ও তারপর বহিষ্কার’ করার মত শাস্তি আল্লাহ বলেন নি। কিন্তু জেহাদ ছাড়লে তাই দেবেন বোলে জানিয়ে দিয়েছেন, সতর্ক কোরেছেন। কারণ হোল-
ক) মো’মেনের সংজ্ঞা অর্থাৎ মো’মেন হবার শর্ত্তের মধ্যেই আল্লাহ ঈমানের সঙ্গে জেহাদকে অন্তর্ভুক্ত কোরে দিয়েছেন। কারণ দীন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার নীতি হিসাবে তিনি জেহাদকে, কেতালকে (সশস্ত্র সংগ্রাম) নির্দ্ধারিত কোরে দিয়েছেন। জেহাদ ত্যাগ কোরলে মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যেই থাকা যায় না, আর মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যে না থাকলে অবশ্যই হয় মোশরেক কিম্বা কাফের। সে যতই সালাহ্ (নামায) পড়–ক, যতই সওম (রোযা) পালন করুক; আল্লাহর দৃষ্টিতে সে আর মো’মেন নয় এবং মোশরেক আর কাফেরদের জন্য আল্লাহর নির্দ্ধারিত শাস্তি অবশ্যই কঠিন, আল্লাহর বহুঘোষিত জাহান্নাম।
খ) এই জাতির বদলে অন্য কোনও জাতি মনোনীত কোরবেন, অর্থাৎ অন্য কোন জাতিকে এই জাতির ওপর কর্ত্তৃত্ব দান কোরবেন। কারণ পরিষ্কার- যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে পাঠিয়ে এই জাতি, উম্মাহ গঠন কোরলেন, এই জাতি যদি সেই উদ্দেশ্যটিকেই ছেড়ে দেয় তাহোলে আল্লাহর কাছে সেই জাতির এবং অন্য কোন এবাদতের আর কোন প্রয়োজন থাকে না। পেছনে দেখিয়ে এসেছি যে সেই কাজটি হোল জেহাদের মাধ্যমে অন্য সমস্ত রকমের জীবন বিধানের অবসান, বিলুপ্তি ঘটিয়ে শেষনবীর মাধ্যমে ইসলামের এই শেষ বিধান, শেষ সংস্করণ পৃথিবীতে কার্যকর কোরে সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা কোরে এবলিসের চ্যালেঞ্জে এবলিসকে পরাজিত কোরে আল্লাহকে জয়ী করা। ঈমানের অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর সর্বব্যাপী বিশ্বাস আনার পরই যে কাজটি নির্দ্ধারিত করা হোয়েছে তা হোল জেহাদ, এই দীনকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম (কোরান- সুরা হুজরাত ১৫)। সেই কাজটি ছেড়ে দিলে এ জাতির অস্তিত্ব থাকারই আর প্রয়োজন থাকেনা; তাই আল্লাহ এ জাতিকে সতর্ক কোরে দিয়েছেন জেহাদ ছেড়ে দিলে তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্য জাতিকে অধিকার ও কর্ত্তৃত্ব দেবেন।
আল্লাহ যে শুধু ভয় দেখাবার জন্যই এই জাতিকে এই কথা বোললেন তা যে নয় তার প্রমাণ হোল পরবর্ত্তী ইতিহাস। সে ইতিহাস হোচ্ছে এই যে জাতিগতভাবে জেহাদ ছেড়ে দেবার শাস্তি হিসাবে ইউরোপের বিভিন্ন খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলিকে দিয়ে আটলান্টিক মহাসমুদ্রের তীরে মরক্কো থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ফিলিপাইন পর্যন্ত সমস্ত মোসলেম রাষ্ট্রগুলিকে সামরিকভাবে পরাজিত কোরে খ্রীস্টানদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত কোরে দিলেন, অর্থাৎ সমস্ত মোসলেম দুনিয়াকে খ্রীস্টানদের গোলামে, দাসে পরিণত কোরে দিয়ে তাঁর হুশিয়ারি, প্রতিশ্রুতি পালন কোরলেন। এই সরাসরি দাসত্বের বাইরে রোইলো শুধু হেজাজ, আল্লাহর ঘর কাবা এবং তাঁর রসুলের পবিত্র রওযা। খ্রীস্টান শক্তিগুলি যদি ওগুলিও দখল কোরতে চাইত তবে বাধা দেবার শক্তি একদা অপরাজেয় এই জাতির ছিলো না। আমার মতে আল্লাহ শুধু মধ্য আরবটুকু খ্রীস্টানদের হাতে তুলে দিলেন না তাঁর নিজের ঘর এবং তাঁর হাবিবের রওযার সম্মানে। যারা ইতিহাস পড়েছেন তারা উপলব্ধি কোরবেন যে ইউরোপের খ্রীস্টান শক্তিগুলি যখন এই মোসলেম উম্মাহকে সামরিকভাবে পরাজিত কোরে কয়েকশ’ বছর তাদের ওপর প্রভুত্ব কোরেছে তখন আল্লাহর সতর্কবাণী- “তোমাদের কঠিন শাস্তি (আযাবুন আলীমা) দেব” কেমন কোরে সত্য হোয়েছে। তাদের সামরিক আক্রমণ, যুদ্ধ ও শাসনকালে সমস্ত মোসলেম দুনিয়ায় তারা এই জাতিকে গুলি কোরে, বেয়োনেট দিয়ে বিদ্ধ কোরে, আগুনে পুড়িয়ে, লাইন কোরে দাঁড় কোরিয়ে মেশিনগান কোরে, জীবন্ত কবর দিয়ে, ট্যাংকের তলায় পিষে হত্যা কোরেছে, এই জাতির মেয়েদের ধোরে নিয়ে ইউরোপে, আফ্রিকায় ও বিভিন্ন দেশের বেশ্যালয়ে বিক্রি কোরেছে; জেল, ফাঁসির তো কথাই নেই। আল্লাহর ঐ শাস্তি আজও শেষ হয় নাই। আজ ইউরোপীয় খ্রীস্টানদের সরাসরি শাসন নেই কিন্তু এই জাতি আজও রাজনৈতিক, কুটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষা, আইন-কানুন, দ-বিধি এক কথায় সর্বতোভাবে ইউরোপ-আমেরিকার দাস হোয়েই আছে। আজও এই জাতি শুধু ইউরোপে নয়, পৃথিবীর সমস্ত জাতিগুলি দিয়ে পরাজিত, অপমানিত, লান্ছিত হোচ্ছে। এই জাতি তার প্রভু আল্লাহর সতর্কবাণীর অর্থ আজও বোঝে নাই; আজও জেহাদ বিমুখ হোয়ে হাজারো রকমের ‘এবাদত’ নিয়ে মশগুল আছে। আজও সে মো’মেনের সংজ্ঞায় ফিরে যায় নি, এবং আজও আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সেই শাস্তি দিয়েই চোলেছেন এবং আখেরাতে জাহান্নামে আরও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা কোরে রেখেছেন, কোনও নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত সে আযাব থেকে বাঁচাতে পারবে না।
এখন আমরা নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে যেহেতু মো’মেন হবার সংজ্ঞা ও শর্ত্তের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর সর্বব্যাপী বিশ্বাসের (ঈমান) সঙ্গে জেহাদকে অন্তভুক্ত কোরে দিয়েছেন (সুরা হুজরাত, আয়াত ১৫), জেহাদকে ফরদে আইন কোরে দিয়েছেন (সুরা বাকারা ২১৬), সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামের হুকুম দিয়েছেন (সুরা বাকারা ২৪৪, সুরা আনফাল ৩৯ এবং কোরানের আরও অনেক স্থানে) ছয়শ’ বাইশ বারেরও বেশী সশস্ত্র সংগ্রাম, কেতাল, যুদ্ধ সম্বন্ধে উল্লেখ কোরেছেন, যুদ্ধ কোরে জীবন বিসর্জন যে দেবে তার জন্য এই দীনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান নির্দ্ধারণ কোরে দিয়েছেন, যেহেতু জেহাদ ত্যাগ কোরলে আল্লাহ ভয়াবহ শাস্তি দিয়ে বিতাড়িত কোরবেন, বহি®কৃত কোরবেন বোলে হুশিয়ার কোরেছেন (তওবা ৩৮-৩৯), সেহেতু এই দীনের মধ্যে প্রবেশ কোরতেই একজন মানুষকে যোদ্ধা হোতে হবে, যোদ্ধা না হোয়ে কেউ এই দীনে প্রবেশই কোরতে পারবে না। অর্থাৎ যে যোদ্ধা নয় এই দীনুল ইসলামের একজন প্রাথমিক সদস্য হওয়ারও যোগ্যতা তার নেই। ভালো বা উচ্চস্তরের সদস্য হওয়া তো দূরের কথা। এক কথায় বলা যায় যে এই শেষ ইসলামে প্রবেশ করার জন্য, আল্লাহর কাছে মো’মেন বোলে গৃহিত হবার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর ঈমানের (বিশ্বাস) সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে একজন নির্ভিক দুর্জয় যোদ্ধায় রূপান্তরিত কোরতে হবে এবং নিজের প্রাণ ও পার্থিব সম্পদ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম কোরতে হবে; নইলে কোন লোক মো’মেন বোলে আল্লাহর কাছে গৃহিত হবে না, সে যত বড় মুত্তাকি (পরহেযগার)-ই হোক।
আল্লাহ তাঁর রসুলকে হুকুম দিলেন- পৃথিবীতে প্রচলিত সব রকম জীবন-ব্যবস্থাকে (দীন) নিষ্ক্রিয়, অচল কোরে দিয়ে আমার দেয়া এই সঠিক দিক নির্দেশনা ও সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠা করো; এজন্যই তোমাকে পৃথিবীতে পাঠানো হোয়েছে (কোরান- সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। এ কাজ কেমন কোরে, কী প্রক্রিয়ায় তাঁর রসুল কোরবেন তাও তিনি তাঁকে জানিয়ে দিলেন- এ কাজের নীতি হিসাবে তিনি নির্দিষ্ট কোরে দিলেন; ইনিয়ে বিনিয়ে অনুরোধ কোরে নয়; এই দিক নির্দেশনা ও সত্যদীন যে অন্যান্য জীবন-ব্যবস্থার (দীন) চেয়ে উৎকৃষ্ট এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা কোরে নয়, মিটিং-মিছিল কোরে নয়, নির্বাচন কোরে নয়, দেয়ালে প্রচার পত্র সেটে নয়, স্লোগান দিয়ে নয়, যুক্তি-তর্ক কোরে নয়, তাবলিগ, প্রচার কোরে নয়; জেহাদ ও কেতাল, সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে। আরও বোললেন- তোমার জাতিকে, উম্মাহকে, মো’মেনদের যুদ্ধ কোরতে উদ্বুদ্ধ করো (সুরা আনফাল ৬৫)। আদেশ পেয়ে আল্লাহর রসুল বোললেন- আমি আদেশ পেয়েছি পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে যেতে যে পর্যন্ত না সমস্ত পৃথিবীর মানুষ আল্লাহর তওহীদ ও আমাকে আল্লাহর রসুল বোলে স্বীকার কোরে নেয় [হাদীস- আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে বোখারী, মেশকাত]। আল্লাহর এই আদেশ বাস্তবায়ন কোরতে যেয়ে তাঁর রসুল এক দুর্ধর্ষ মৃত্যুভয়হীন, অজেয় বাহিনী গঠন কোরলেন যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী এবং ঐ বাহিনী নিয়ে মাত্র সাড়ে নয় বছরের মধ্যে ১০৭টি যুদ্ধ কোরে সমস্ত আরব উপদ্বীপে আল্লাহর দেয়া সঠিক দিক নির্দেশনা ও সত্যদীন প্রতিষ্ঠা কোরে ইসলাম (শান্তি) প্রতিষ্ঠা কোরলেন। তাঁর সংগঠিত উম্মতে মোহাম্মদীও বুঝেছিলো, শুধু বুঝেছিলো নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি কোরেছিলো তাদের কর্ত্তব্য কী, উদ্দেশ্য কী, কেন তাদের আল্লাহর রসুল সংগঠিত কোরেছিলেন। তাই রসুলের পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর তাঁর উম্মাহ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার, দোকান-পাট, স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন এক কথায় পার্থিব সব কিছু ত্যাগ কোরে অস্ত্র হাতে পৃথিবীতে বের হোয়ে পোড়েছিলেন তাদের নেতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত কোরতে। আল্লাহর সেই কঠোর ধম্কি, সতর্কবাণী সর্বদা তাদের মনে ভয় জাগরিত, ভীত কোরে রাখতো যে আল্লাহ বোলেছেন- তোমরা জেহাদের অভিযানে বের হওয়া ত্যাগ কোরলে তোমাদের কঠিন শাস্তি দেব এবং তোমাদের বদলে অন্য জাতিকে মনোনীত কোরব; তোমরা তাঁর (আল্লাহর) কোন ক্ষতি কোরতে পারবেনা (কারণ) আল্লাহ সর্বশক্তিমান (সুরা তওবা- ৩৮, ৩৯)।
এখন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হোচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে পৃথিবীতে আল্লাহর দেয়া দিক নির্দেশনা ও সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠার মত বিশাল ও কঠিন কাজের জন্য আল্লাহর হুকুমে তাঁর রসুল যে বাহিনী গঠন কোরলেন, যার নাম হোল উম্মতে মোহাম্মদী তার চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য কি ব্যবস্থা করা হোল? এটা হোতে পারেনা যে আল্লাহ তাঁর রসুলকে উম্মাহ গঠন কোরতে আদেশ দিলেন, যুদ্ধকে ফরদে আইন কোরে দিলেন, পৃথিবীতে দীন প্রতিষ্ঠার নীতি ও প্রক্রিয়া হিসাবে যুদ্ধকেই নির্দিষ্ট কোরে দিলেন, কিন্তু তাদের জন্য যুদ্ধের কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দিলেন না। যে কথাটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে কোন কাজ কোরতে গেলেই সেই কাজের প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক, আল্লাহ সোবহানুতায়ালা কি এই কথাটা বোঝেন নি? তাহোলে এই দীনে সেই প্রশিক্ষণ কোথায়? প্রত্যেক জাতিরই সামরিক বাহিনী আছে এবং প্রত্যেকেরই যুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তাদের দৈনিক প্যারেড, কুচকাওয়াজ, অস্ত্রের ব্যবহারের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। ওগুলো ছাড়া কোন সামরিক বাহিনী নেই। তাহোলে আল্লাহর রসুল যে সামরিক বাহিনী গঠন কোরলেন, যে বাহিনী যুদ্ধ কোরে ৯ বছরের মধ্যে সমস্ত আরব উপদ্বীপ জয় কোরলো, তারপর মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে তৎকালিন পৃথিবীর দুই বিশ্বশক্তির সুশিক্ষিত বিশাল সামরিক বাহিনীগুলিকে যুদ্ধে পরাজিত কোরে অর্দ্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা কোরলো তারা এ সব কিছু প্রশিক্ষণ ছাড়াই করলো? এ হোতে পারে? অবশ্যই নয়। একথা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে, যে দীনে, জীবন-ব্যবস্থায় যুদ্ধকে ফরদে আইন, অবশ্য করণীয় কোরে দেয়া হোয়েছে (কোরান- সুরা বাকারা ২১৬) সে দীনে প্রশিক্ষণকেও অবশ্য করণীয়, ফরদে আইন কোরে দেয়া হবে। আল্লাহ ভুল করেন নি, তিনি সোবহান, তিনি সামান্যতম ভুলও কোরতে পারেন না, আর এতবড় ভুল তো কথাই নেই। তাহোলে সে প্রশিক্ষণ কোথায়?