মোহাম্মদ আসাদ আলী
যে যত ধর্ম মেনে চলে, তার সাথে তত বেশি অধর্ম করা যায়- শকুনির এই কথাটি ‘মহাভারত’ থেকে জেনেছিলাম। তারপর আর ভুলি নি। কোনোদিন ভুলবও না। ধর্ম-অধর্মের চিরন্তন লড়াইয়ে অধর্ম কীভাবে ধর্মের উপর আধিপত্য লাভ করার স্পর্ধা দেখায় তার গুঢ় রহস্য নিহিত আছে এই একটি বাক্যে।
যারা মহাভারত পড়েছেন তারা জানেন- ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কখনও মিথ্যা বলে না, ওয়াদার খেলাপ করে না, ছলনা করে না- এই গুণগুলো শকুনিকে স্বস্তি দিত। কেননা যুধিষ্ঠিরের এই ধর্মচেতনাকে কাজে লাগিয়ে শকুনি তার অভিসন্ধি বাস্তবায়ন করত। খুব সহজেই যুধিষ্ঠিরকে ধর্ম সঙ্কটের মুখোমুখী করা যেত, ধর্ম বাঁচাতে গিয়ে অর্থাৎ সত্য বলতে গিয়ে বা ওয়াদা পালন করতে গিয়ে এমন কাজ করতে হতো যা শকুনির চালবাজিকে সহজ ও সফল করে দিত। যুধিষ্ঠিরের সহজ-সরল ধর্ম পরাজিত হতো শকুনির ছলনাময়ী অধর্মের কাছে। এভাবে পরাজিত হতে হতে একসময় নিজেদের ন্যায্য অধিকার হারিয়ে রাজ্যহারা পর্যন্ত হতে হয়েছে পাণ্ডবদের, মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়েছে স্ত্রী দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। প্রাণসঙ্কটের মুখোমুখী হতে হয়েছে অনেকবার।
এক পর্যায়ে যুধিষ্ঠিরের সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার ধর্ম যখন অধর্মের ছলচাতুরি ও নানাবিধ চক্রান্তের কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়ল, পাণ্ডবরা রাজ্যহারা হয়ে বনে-বাদাড়ে ঘুরতে লাগল, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলো, তখন এগিয়ে এলেন অবতার শ্রীকৃষ্ণ। শিক্ষা দিলেন- ধর্ম কোনো মৃত চিন্তার নাম নয়, ধর্ম কোনো অপরিবর্তনীয় প্রথা নয়, ধর্ম হলো জীবনের নাম। জীবন গতিময়, ধর্মও গতিময়। যা মানুষকে শিকলে আবদ্ধ করে রাখে, অধর্মের সামনে অসহায়ভাবে মাথা নত করতে শেখায় তা কখনো ধর্ম হতে পারে না। প্রকৃত ধর্ম মানুষকে কোথাও আবদ্ধ করে না, বরং মুক্ত করে, জগতকে অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেয়।
তিনি গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম ও গুরু দ্রোণাচার্যের ব্যক্তিগত ধর্মকে সত্যের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেললেন। তিনি শেখালেন- সমাজ যখন অধর্ম দ্বারা আক্রান্ত হয়, মানুষ দুঃখ-কষ্টে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, তখন আর ব্যক্তিগত ধর্ম বলে কিছু থাকে না। সমাজকে যে কোনো উপায়ে অধর্মের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করাই তখন প্রধান ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। জগতের অকল্যাণ হবে জানার পরও প্রতিশ্রুতির দোহাই দিয়ে অন্যায়কে মেনে নেওয়া ধর্ম নয়, তখন প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গাটাই ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে সত্য বললে জগতের অকল্যাণ হবে সেখানে সত্য না বলাই ধর্ম। ধর্ম-অধর্ম কাজ দ্বারা নির্ণিত হয় না, হয় উদ্দেশ্য দ্বারা। জগতের কল্যাণে ছল-চাতুরি-প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া অধর্ম নয়, অন্যদিকে যে কাজে জগতের অকল্যাণ হয় তা যতই সততার সাথে করা হোক তা অধর্ম।
তিনি আরও শেখালেন- সন্ন্যাসী হবার জন্য রাজ্য ছেড়ে বনে-জঙ্গলে যাবার দরকার নেই, নিঃস্বার্থভাবে, কামনাহীনভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করেও সন্ন্যাসী হওয়া যায়। খাবার খাওয়া অন্যায় নয়, অন্যায় খাবারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়া। সন্তান-সন্ততি জন্ম দেওয়া অন্যায় নয়, অন্যায় সন্তান-সন্ততির প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়া।
এভাবে শ্রীকৃষ্ণ যখন স্থবির ও প্রাণহীন ধর্মে প্রাণের সঞ্চার করলেন ধর্মের শক্তি এতটাই বেড়ে গেল যে, অধার্মিকদের সমস্ত চক্রান্ত, সমস্ত শক্তি, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি মাটির সাথে মিশে গেল। ধর্ম আর অসহায় থাকলো না। যে যত ধর্ম মেনে চলবে, তার সাথে তত বেশি অধর্ম করা যায়- শকুনির এই বাক্যটিও মিথ্যা প্রমাণিত হলো।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আজ আমরা যে ধর্মের চর্চা করছি তা ওই যুধিষ্ঠিরীয় ধর্ম, যা অসত্যের কাছে মাথা নত করতে শেখায়, চারদিকে অন্যায়ের সীমাহীন দৌরাত্ম্য দেখার পরও নির্জীব হয়ে ঘরে বসে থাকতে শেখায়। আক্ষরিক অর্থেই আজ যে যত ধর্ম মেনে চলে অধর্মের মোকাবেলায় সে যেন তত বেশি অসহায়। সবাই ব্যক্তিগত ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত, ওদিকে সমাজ গেছে রসাতলে। প্রাণহীন এই মৃত ধর্মে যতদিন না প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে, ধর্ম তার পূর্ণ শক্তি ফিরে পাচ্ছে ততদিন কারও মুক্তি নেই।