রুম্মানা খানম কণিকা
আমাদের আলেম সাহেবরা যে ধরণের আপাদমস্তক আবৃতকারী পর্দাপ্রথা নারীদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেই পর্দা কোর’আন, হাদিস মোতাবেক কতটুকু বৈধ এবং নারীদের জন্য এটি বাস্তব সম্মত কি না। এখানে ইসলামের একটি মূল নীতি উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটা হলো, এই দীনে কোন জবরদস্তি নেই। লা ইকরাহা ফিদ্দীন (সুরা বাকারা ২৫৬)।
সুতরাং কোন মানুষের উপরে কোন বিধান জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এই দীনের নীতি-বিরুদ্ধ। যেহেতু ইসলাম একটি প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থা তাই এর সকল বিধানই মানুষের জন্য সহজসাধ্য হবে। কিন্তু বিকৃত ইসলামের ধারকবাহকরা নারীর উপর কঠিন পর্দা আরোপ করতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে এখনও রাষ্ট্রের নির্ধারিত নিয়মে পর্দা করা না হলে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা পর্যন্ত করা হয় অর্থাৎ জবরদস্তি করা হয়। এর ফলে সে সব দেশের নারীরা ভিতরে ভিতরে ইসলামের বিরোধী। কিন্তু কোনো মানুষ যদি কোন নির্দিষ্ট ধরণের পোশাক পরতে রাজী না থাকে, তাকে সেটা পরতে বাধ্য করা দীনের একটি নীতি ভঙ্গ করা। আল্লাহ কোর’আনে বহুবার তাঁর রসুলকে বলেছেন, ‘আমি আপনাকে দারোগা করে পাঠাই নি। আপনি তো একজন উপদেশ দানকারী মাত্র।’ (সুরা গাশিয়া ২১)
আল্লাহ তাঁর রসুলকে বলছেন, মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনঅঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে। (সুরা নূর ৩১)
আল্লাহ আরও বলেন, “হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। (সুরা আহযাব- ৫৯)
সুতরাং আল্লাহ নারীদের স্বাভাবিক প্রকাশমান অঙ্গসমূহ অর্থাৎ হাত, পা, মুখমণ্ডল খোলা রাখতে বললেন যেন তাদেরকে চিনতে পারা যায় সেখানে কিভাবে হাত, পা, নাক, মুখ এক কথায় আপাদমস্তক ঢেকে কিম্ভূত কিমাকার মূর্তি সেজে পর্দা করেন। ওহুদ যুদ্ধে নারী সাহাবী উম্মে আম্মারা (রা:) যে নজিরবিহীন ভূমিকা রেখেছিলেন সে সম্পর্কে রসুলাল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, ‘ওহুদের দিন ডানে-বামে যেদিকেই নজর দিয়েছি, উম্মে আম্মারাহকেই লড়াই করতে দেখেছি।’ নবী করিম (সা:) নিজ হাতে সেদিন এই বীরাঙ্গণার ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিয়েছিলেন। তাঁর কাঁধ থেকে গল গল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। বেশ কয়েকজন বীর সৈনিকের নাম উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘আল্লাহর কসম! আজ তাদের সবার চেয়ে উম্মে আম্মারাহ বেশি বীরত্ব দেখিয়েছেন।’ আজকে আমাদের আলেম সাহেবরা যেভাবে পর্দা করার নির্দেশ দেন সে রকম পোশাক পরে কি উম্মে আম্মারা এমন যুদ্ধ করতে পারতেন? পারতেন না, কাজেই এটা প্রমাণিত হলো যে রসুলের নারী আসহাবরা এভাবে পর্দা করতেন না।
তাহলে এই বিকৃত পর্দা প্রথা কোথা থেকে আসল? ইসলাম যখন বিকৃত হয়ে গেল, তখন এই জাতির মধ্যে হাজার হাজার আলেম জন্ম নিল যারা এই দীনের প্রতিটি বিষয়কে চুলচেরা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মাসলা মাসায়েল আবিষ্কার করতে আরম্ভ করলো। এভাবে তারা লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েল ফতোয়া উদ্ভাবন করলো যেগুলির সঙ্গে এই জাতির মূল কাজের কোনই সম্পর্ক নেই। কয়েক শ’ বছর আগে এই জাতিটি যখন আল্লাহর শাস্তিস্বরূপ খ্রিষ্টানদের পদানত গোলামে পরিণত হলো তখন ঔপনিবেশিকরা মুসলিমদের প্রকৃত ইসলাম থেকে সরানোর জন্য একটি বিকৃত ইসলাম তৈরি করলো এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তা এই জাতিকে শেখালো। সেই মাদ্রাসার সিলেবাসে এই সব ব্যক্তিগত মাসলা-মাসায়েলের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হলো এবং জাতীয় জীবনের বিধানগুলির গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হলো। অন্যায়, অশান্তি, অবিচারের বিরুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বদলিয়ে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে শেখানো হলো। আর এই মাদ্রাসাগুলো থেকে বের হয়ে তথাকথিত আলেম-মাওলানারা ধর্মব্যবসা করে খেতে শুরু করলো, কারণ মাদ্রাসায় অন্য কোন উপায়ে রোজগার করার পদ্ধতি শেখানো হয় নি। এই ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের ওয়াজ নসিহতে নারীদের সম্পর্কে বয়ান করতে করতে বর্তমানের এই বিকৃত পর্দাপ্রথা সমাজে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে।
আল্লাহ ও তাঁর রসুল মেয়েদের যে উদ্দেশ্যে হিযাব বা পর্দা করতে আদেশ দিয়েছেন তা হলো, আঁটশাট কাপড় পরে, অর্ধনগ্ন হয়ে যুবতী, তরুণী মেয়েরা ঘুরে বেড়ালে এ থেকে সমাজে নানারকম অন্যায়, অশান্তি সৃষ্টি হবে। এই অশান্তি যেন না হয় তাই ঐ হিযাবের আদেশ। এ কারণেই যেসব মেয়েদের বয়স বেশি হয়েছে, যারা প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা হয়েছেন অর্থাৎ যাদের দেখলে কোন প্রবৃত্তি উত্তেজিত হবে না তাদেরকে হিযাব করা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে (সুরা নূর ৬০)। অথচ আজকাল পথেঘাটে দেখবেন প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা মা, দাদীরা কিম্ভুতকিমাকার বোরকায় আপদমস্তক ঢেকে আছেন আর তাদের সঙ্গে আধুনিক, মেকআপ করা অর্ধ নগ্না মেয়ে, নাতনীরা বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে পর্দা করার আদেশ করা হয়েছে তার ঠিক বিপরিত করা হচ্ছে।
আজকের নারী:
ধর্মব্যবসায়ীরা যেভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীর অধিকার ও সম্মানকে ক্ষুণ্ণ করে চলেছেন তা নারীদেরকে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। অপরদিকে আছে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। টিভি স্যাটেলাইটের অশ্লীল সংস্কৃতি দেখে আমাদের মেয়েরা নিজেদেরকেও শোবিজ তারকা বলে কল্পনা করছে, তাদের জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, চালচলন ইত্যাদি অনুকরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পশ্চিমাদের অনুসরণ করে আমাদের পরিবারগুলিতেও এখন কথায় কথায় ডিভোর্স একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা। সমান অধিকার, সাবলম্বিতা, জীবনযাত্রার মানকে পশ্চিমাকরণ ইত্যাদির আশায় স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই রোজগারের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সন্তানেরা অনাত্মীয় পরিবেশে নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে বড় হয়। বড় হওয়ার এই সময়টাতে সঠিক পরিচর্যা না পেয়ে তারা বিপথগামী হয়। আমাদের কথা হচ্ছে, মানবজাতি যদি সত্যিই শান্তি চায়, তাদেরকে বর্তমানে প্রচলিত ভারসাম্যহীন বিকৃত ইসলাম এবং ভারসাম্যহীন পশ্চিমা জীবনব্যবস্থা দুটো থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই নারী তাদের প্রকৃত অবস্থান বুঝে নিক এবং মানবতার কল্যাণে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মহান সংগ্রামে তারাও পুরুষের পাশাপাশি তাদের সমস্ত শিক্ষা, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়–ক। আমরা ধর্মব্যবসায়ীদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছি, আমরা পশ্চিমাদের উশৃঙ্খল অসভ্যতাকেও প্রত্যাখান করেছি। আমরা চাই নারীরা নতুন বিশ্বসভ্যতা গড়ার সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি সমানভাবে অংশগ্রহণ করুক। আমাদের এই আহ্বানে বাংলার নারীরা যদি সত্য ও ন্যায়ের পথে ঐক্যবদ্ধ হন, তারা যদি বিকৃত ইসলামের অচলায়তন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারেন নব-সভ্যতার আলোকময় প্রাঙ্গণে, তারা যদি নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন মানবতার কল্যাণে- তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন অবহেলিত, অবজ্ঞাত এই বাঙালি জাতি পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে, পৃথিবীতে আমরা হব একটি পরাশক্তি, সারা বিশ্বকে আমরাই নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হব ইনশা’ল্লাহ।
প্রকৃত ইসলামে বিয়ে:
ইসলামের শরিয়ত মোতাবেক বিয়েতে তিনটি শর্ত অবশ্যপালনীয়-
১) ছেলে ও মেয়ের পূর্ণ সম্মতি [আবু হুরায়রা (রা:) থেকে মুত্তাফীকি আলাইহে],
২) দেনমোহর প্রদান করা (সূরা নিসা-৪),
৩) কমপক্ষে দুইজন সাক্ষী রাখা। কিন্তু আমাদের সমাজে বিয়েগুলিতে লাখ লাখ টাকা দেনমোহর লেখা হয় কিন্তু সেগুলি কখনোই পরিশোধ করা হয় না। উপরন্তু যৌতুক আদায়ের জন্য স্ত্রীর ওপর অবর্ণনীয় দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটে। বিয়েতে অপব্যয় অনেক পাত্র-পাত্রীর পরিবারের জন্য কষ্টকর পরিণতি ডেকে আনে। অথচ আল্লাহর রসুল বলেছেন, সর্বাপেক্ষা বরকত-পূর্ণ বিয়ে হলো যা সর্বাপেক্ষা কম কষ্টে সম্পন্ন হয় (বায়হাকী)।