শারমিন সুলতানা রুমকি
সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ‘ইনসাইডার মাংকি’। সেখানে দাবি করা হয়েছে- বিশ্বের ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে আছে সৌদি রাজপরিবার। মোট ৫০ নম্বরের মধ্যে পুরো ৫০ নম্বর নিয়ে তালিকায় এ শীর্ষস্থান লাভ করেছে সৌদ পরিবারটি। খবরটি মুসলিম বিশ্বের জন্য আনন্দদায়ক হতে পারতো যদি এই পর্বতপ্রমাণ সম্পদ থেকে এ জাতি কিছুটা হলেও লাভবান হতো। কিন্তু না, আল্লাহর দেওয়া প্রাকৃতিক সম্পদকে, জনগণের সম্পদকে নিজেদের পারিবারিক সম্পদে পরিণত করে অমানবিক ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত থাকা সৌদি রাজ পরিবার পৃথিবীর কোটি কোটি অভুক্ত, অর্ধভুক্ত, দারিদ্র্যপীড়িত মুসলমানের কোনো কাজে আসে নি। উপরন্তু সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বহুল উত্থাপিত একটি অভিযোগ হচ্ছে, তারা বিশাল ওই সম্পদের একটি বড় অংশ ব্যয় করে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা তৈরি, বিভিন্ন উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থায়ন ও ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যনীতি বাস্তবায়ন করার কাজে। বিগত কয়েক বছর ধরে সিরিয়ায় যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে তাতে অর্থনৈতিকভাবে সৌদি আরব ইন্ধন যোগাচ্ছে বলে জোর অভিযোগ আছে। সুতরাং সৌদি রাজপরিবারের এই বিশাল সম্পদের পাহাড় মুসলিম জাতির জন্য যতটা আনন্দদায়ক হতে পারতো, বাস্তবে ততটাই যন্ত্রণাদায়ক বললে অত্যুক্তি হয় না।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে সৌদি আরব শাসন করা এই রাজপরিবারের শাসকরা পরিচিত আল সৌদ নামে। পরিবারটির বর্তমান সম্পদের বাজারমূল্য ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার! পুরো সৌদি আরব রাষ্ট্রটিই আল সৌদ পরিবারের অঢেল স¤পত্তি ও আয়ের উৎস, যেটিকে তারা মনে করে ‘পরিবার নিয়ন্ত্রিত পারিবারিক স¤পত্তি’। তেলের খনি, মূল্যবান জায়গা, বড় বড় ব্যবসায়িক চুক্তি থেকে শুরু করে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সবকিছু থেকেই আয় করে এই রাজপরিবার।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা কত জঘন্যভাবে ব্যয় করে তা বলে শেষ করা যায় না। ভোগ-বিলাসিতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে থাকে সৌদি প্রিন্সরা। একদিকে যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত মুসলিম দেশগুলোর মানুষ ঘাস লতা পাতা খেয়ে প্রাণ রক্ষা করছে, সেখানে মুসলিম জাহানের স্বঘোষিত অভিভাবক সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা হীরাখচিত ও সোনা দিয়ে মোড়ানো গাড়িতে যাতায়াত করেন, স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো খাট-পালংক ও টয়লেট ব্যবহার করেন, ইউরোপ-আমেরিকার বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর একাই ভাড়া করে অবসর যাপন করেন। সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মুসলমানরা যখন আশ্রয়ের খোঁজে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছে, হাজারে হাজারে পানিতে ডুবে মরছে, খোলা আকাশের নীচে অভুক্ত দিনাতিপাত করছে, তাদের অসহায়ত্ব দেখে ইউরোপের খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো সাহায্যের হাত বাড়ালেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সৌদি রাজপরিবারের কাউকে সহানুভূতিসূচক ‘আহ’ শব্দটিও করতে শোনা যায় নি। এরাই নিজেদেরকে আল্লাহর রসুলের উত্তরসূরী দাবি করে।
আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী করেন- ‘যখন আমার উম্মাহ দশটা কাজ করবে, তখন তাদের উপর বিপদ নেমে আসবে।’ সেই দশটা কাজের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনি যেটা উল্লেখ করেন তাহলো- রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করা (আলী (রা.) থেকে, তিরমিযী)। আল্লাহর রসুলের সেই ভবিষ্যদ্বাণী বহু পূর্বেই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে, রাজতন্ত্রের ধারকরা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজেদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পদ বানিয়ে নিয়েছে, আর ওদিকে সমগ্র মুসলিম জাতির জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় বিপদ।
অনেকে মনে করেন ভোগ-বিলাসিতায় ব্যস্ত থাকলেও সৌদি আরব অন্যদের থেকে ভালো মুসলিম কারণ প্রথমত, সৌদি আরব হচ্ছে সেই পবিত্র ভূমি যেখানে আল্লাহর রসুল জন্মগ্রহণ করেছিলেন, দ্বিতীয়ত, সেখানে আল্লাহর দেওয়া দণ্ডবিধি অনুযায়ী দেশ শাসিত হয়। যারা এই দুইটি অজুহাত দাঁড় করিয়ে দেশটির ভোগবাদী রাজা-বাদশার অপকর্মকে জায়েজ করতে চান তারা ভুল করেন। প্রকৃত সত্য হলো- আরবদের জাতীয় জীবনে শরীয়াহ আইন (অবশ্য তাও বিকৃত) প্রচলিত থাকলেও ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ব্যবস্থা অন্যান্য ভাগের মতই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং প্রাক ইসলামিক যুগের মত রাজতন্ত্র, বংশতন্ত্র, গোষ্ঠিতন্ত্র ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেহেতু তারা গোষ্ঠিতন্ত্র, বংশতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে সুতরাং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সেখানে অচল হয়ে পড়েছে, কারণ ঐসব তন্ত্রে জাতীয় সম্পদের, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের মালিক হল রাজা বাদশাহরা। আর ইসলামে সরকারি কোষাগারের মালিক হলো সমস্ত জাতি। খলিফা শুধু রক্ষক, তত্ত্বাবধানকারী ও এই জীবনব্যবস্থার নিয়মানুসারে ব্যবহারকারী। অর্থাৎ , শুধু দণ্ডবিধি ছাড়া এই আরবরা অন্যান্য জাতীয় ব্যাপারে গায়রুল্লাহর অনুসারী অর্থাৎ মোশরেক। আর তাদের ওই বিকৃত দণ্ডবিধিও রাজপরিবারের কারও উপর প্রয়োগ হবে এমন চিন্তাভাবনা অলীক। সেগুলো কেবল ক্ষমতাহীন, প্রতিপত্তিহীন, সাধারণ আরবদের জন্য ও অনারব শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য।