শফিকুল আলম উখবাহ
ঐক্য অনৈক্যের উপর জয়লাভ করবে এটি একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এটা যেমন কোনো পরিবারের জন্য সত্য, তেমনি একটি জাতির জন্যও সত্য। একটি জাতির মানুষগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তারা যে কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। এর উদাহরণ ১৯৭১। এদেশের সৈনিক, কৃষক, তাঁতি, মুটে, ছাত্র শিক্ষকসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ সেদিন পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক চাপানো বহুবিধ জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে শান্তিময় দেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। কিন্তু পরবর্তী ৪৩ বছরে সেই ঐক্য আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে ধরে রাখতে পারি নি। ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির ফতোয়াবাজি, অপরাজনীতি আর পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমরা হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে হানাহানি, মারামারি, দলাদলি, হত্যা-রক্তপাতে নিমজ্জিত হয়ে গেছি। আজও আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ। কিন্তু ৪৩ বছর যদি আমরা সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারতাম তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা হতাম পৃথিবীর একটি শীর্ষস্থানীয় জাতি। সেই অতীতের ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে যদি আমরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতিসত্তায় পরিণত হব, তাহলে আমাদেরকে সেই প্রাকৃতিক নিয়মটি কাজে লাগাতে হবে-অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ষোল কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা জাতির মধ্যে বিরাজমান মূল বিভক্তিগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার উপায় হিসাবে কিছু ঐক্যসূত্র প্রস্তাব করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, যদি এ ঐক্যসূত্রগুলো সাধারণ মানুষের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়, তাহলে ষোল কোটি বাঙালিকে ধর্ম-বর্ণ, রাজনীতিক পরিচয় নির্বিশেষে সহজেই ঐক্যবদ্ধ করা যাবে। আজ আমাদের সামনে যে জাতীয় সংকট এবং আমাদের অতীতের ৪৩ বছরের ব্যর্থতা, এ থেকে আমরা যদি উত্তরণ করতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই ন্যায়-সত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যায়, অসত্য, বিভক্তি সৃষ্টিকারী উপাদানগুলো যথা ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতি, পশ্চিমা সভ্যতার চাপিয়ে দেওয়া মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে কারণ কোনো অন্যায়, অসভ্যতা, মিথ্যা মানুষকে আর যা-ই হোক শান্তি দিতে পারে না। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেও ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে যদি তাদেরকে কিছু মহাসত্য বোঝানো হয়, আমরা সমস্ত মানবজাতি একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই পিতা-মাতা আদম হাওয়ার সন্তান। সুতরাং আমরা এক পরিবার, আমরা প্রত্যেকে ভাই-ভাই। তাই আমাদের মধ্যে ধর্মীয় বা রাজনীতিক কোনো বিভক্তি থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়। বিভক্তি স্রষ্টার কাম্যও নয়। তাই সকল ধর্মেই আছে ঐক্যের শিক্ষা। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে ধর্মকেই বিভেদের প্রাচীরে রূপ দিয়েছে। তারা সর্বদা অন্য ধর্মের অনুসারীদেরকে জাহান্নামী, কাফের ইত্যাদি বলে থাকে, অন্য ধর্মের নবী, রসুল, অবতার ও উপাস্যকে গালিগালাজ করে। অথচ সব ধর্মই আল্লাহর প্রেরিত, ধর্ম প্রবর্তকগণও একই স্রষ্টার পক্ষ থেকে আগত। তাই তারা সকলেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাদেরকে এই শ্রদ্ধার স্থান দিলে ধর্মে ধর্মে যে বিভেদ তা দূর হওয়া সম্ভব।