কাজী নজরুল ইসলাম
এ-প্রশ্নের সর্বপ্রথম উত্তর, আমরা চাকুরীজীবী। মানুষ প্রথম জন্মে তাহার প্রকৃতিদত্ত চঞ্চলতা, স্বাধীনতা ও পবিত্র সরলতা লইয়া। সে চঞ্চলতা চির-মুক্ত, সে-স্বাধীনতা অবাধ-গতি, সে-সরলতা উন্মুক্ত উদার। মানুষ ক্রমে যতই পরিবারের গন্ডী, সমাজের সঙ্কীর্ণতা, জাতির-দেশের ভ্রান্ত গোঁড়ামি প্রভৃতির মধ্য দিয়া বাড়িতে থাকে, ততই তাহার জন্মগত মুক্ত প্রবাহের ধারা সে হারাইতে থাকে, ততই তাহার স্বচ্ছপ্রাণ এইসব বেড়ীর বাঁধনে পড়িয়া পঙ্কিল হইয়া উঠিতে থাকে। এ-সব অত্যাচার সহিয়াও অন্তরের দীপ্ত স্বাধীনতা ফুটিয়া উঠিতে পারে, কিন্তু পরাধীনতার মত জীবন-হননকারী তীব্র হলাহল আর নাই। অধীনতা মানুষের জীবনী-শক্তিকে কাঁচাবাঁশে ঘুণ ধরার মত ভুয়া করিয়া দেয়। ইহার আবার বিশেষ বিশেষত্ব আছে, ইহা আমাদিগকে একদমে হত্যা করিয়া ফেলে না, তিল তিল করিয়া আমাদের জীবনী-শক্তি, রক্ত-মাংস-মজ্জা, মনুষ্যত্ব বিবেক, সমস্ত কিছু জোঁকের মত শোষণ করিতে থাকে। আখের কল আখকে নিঙড়াইয়া পিষিয়া যেমন শুধু তাহার শুষ্কছ্যাবা বাহির করিয়া দিতে থাকে, এ-অধীনতা মানুষকে তেমনি করিয়া পিষিয়া তাহার সমস্ত মনুষ্যত্ব নিঙড়াইয়া লইয়া তাহাকে ঐ আখের ছ্যাবা হইতেও ভুয়া করিয়া ফেলে। তখন তাহাকে হাজার চেষ্টা করিয়াও ভালমন্দ বুঝাইতে পারা যায় না। আমাদেরও হইয়াছে তাহাই। আমাদিগকে কোন স্বাধীন-চিত্ত লোক এই কথা বুঝাইয়া বলিতে আসিলেই তাই আমরা সাফ বলিয়া দিই, ‘‘এ-লোকটার মাথা গরম!”
সারা বিশ্বে বাঙালীর এই যে সকল দিকেই সুনাম, কিন্তু তবুও আমরা কেন এমন দিন-দিন মনুষ্যত্ব বর্জিত হইয়া পড়িতেছি? কেন ভন্ডামি, অসত্য, ভীরুতা, আমাদের পেশা হইয়া পড়িয়াছে? কেন আমরা কাপুরুষের মত এমন দাঁড়াইয়া মার খাই? ইহার মূলে ঐ এক কথা, আমরা অধীন-আমরা চাকুরী-জীবী। দেখাইতে পার কি, কোন জাতি চাকুরী করিয়া বড় হইয়াছে? আমরা দশ-পনর টাকার বিনিময়ে মনুষ্যত্ব, স্বাধীনতা অনায়াসে প্রভুর পায়ে বিকাইয়া দিব, তবু ব্যবসা-বাণিজ্যে হাত দিব না, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াইতে চেষ্টা করিব না। এই জঘন্য দাসত্বই আমাদিগকে এমন ছোট হীন করিয়া তুলিতেছে। যে দশ টাকা পায় সে যদি পাড়াগাঁয়ে গিয়া অন্তত: মুদি, ফেরিওয়ালার ব্যবসা করে, তাহা হইলেও সে বিশ পঁচিশ টাকা অনায়াসে উপার্জন করিতে পারে। ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয়, আদতে আমরা ইচ্ছাই করিব না, চেষ্টাই করিব না, কৃষি, শিল্প যত বেশী, সে-জাতির মধ্যে স্বাধীন-চিত্ত লোকের সংখ্যা তত বেশী, আর কাজেই যে-জাতির জনসংঘের অধিকাংশেরই চিত্ত স্বাধীন, সে জাতি বড় না হইয়া পারে না। ব্যষ্টি লইয়াই সমষ্টি।
আমরা আজ অনেকটা জাগ্রত হইয়াছি, আমরা মনুষ্যত্বকে এক আধটুকু বুঝিতে পারিতেছি, কিন্তু আমাদের এ মনুষ্যত্ববোধ, এ-শক্তি স্থায়ী হইতেছে না, শুধু ঐ চাকুরী-প্রিয়তার জন্য।সোডা-ওয়াটারের মত আমাদের শক্তি, আমাদের সাধনা, আমাদের অনুপ্রাণতা এক নিমিষে উঠিয়াই থামিয়া যায়, শোলার আগুনের মত জ্বলিয়াই নিভিয়া ছাই হইয়া যায়। আমরা যদি বিশ্বে মানুষ বলিয়া মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে চাই, তবে আমাদের এ-শক্তিকে, এ সাধনাকে স্থায়ী করিতে হইবে, নতুবা “যে তিমিরে সে-তিমিরে।”এবং তাহা করিতে হইলে সর্বপ্রথমে আমাদিগকে চাকুরী ছাড়িয়া পর পদলেহন ত্যাগ করিয়া স্বাধীনচিত্ত উন্নত শীর্ষ হইয়া দাঁড়াইতে হইবে; দেখিয়াছ কি, চাকুরীজীবীকে কখনও স্বাধীন-চিত্ত সাহসী ব্যক্তির মত মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে? তাহার অন্তরে শক্তিকে যেন নির্মমভাবে কচলাইয়া দিয়াছে, ঐ চাকুরী, অধীনতা, দাসত্ব। আসল কথা, যতক্ষণ না আমরা বাহিরে স্বাধীন হইব, ততক্ষণ অন্তরের স্বাধীন-শক্তি আসিতেই পারে না।