রিয়াদুল হাসান
পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে একমাত্র পছন্দনীয় জীবনব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম’। তিনি ইসলামকে তোমাদের দীন হিসাবে মনোনীত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামতকে পূর্ণ করেছেন। ইসলাম ছাড়া আর কোনো দীন গ্রহণ করা হবে না। এই আয়াতগুলির উপর ভিত্তি করে ইসলাম ধর্মের অনেক আলেম ওলামা অন্য ধর্মের অনুসারী মানুষের স্বর্গে যাবার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন এবং একমাত্র মুসলমানেরাই জান্নাতে যাওয়ার হকদার বলে প্রচার করেন। কিন্তু বাস্তবে এই আয়াতগুলির মর্মার্থ কী তা এখানে আলোচ্য বিষয়।
প্রথমেই আসি দীন এবং ইসলাম এই শব্দ দু’টির অর্থ প্রসঙ্গে। দীন শব্দের অর্থ হচ্ছে জীবনব্যবস্থা অর্থাৎ মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে গেলে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনীতিক, রাজনীতিক, বিচারিক বিধি-বিধান প্রয়োজন পড়ে সেগুলি হচ্ছে দীন। দীন হতে পারে মাত্র দুই প্রকার: আল্লাহর দেওয়া অথবা মানুষের তৈরি। আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী-রসুল-অবতারদের মাধ্যমে যে দীনগুলি পাঠিয়েছেন সেগুলির নাম তিনি দিয়েছেন ‘ইসলাম’। ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ শান্তি। এর তাৎপর্য হচ্ছে- এটি এমন এক জীবনব্যবস্থা যার পরিণামে মানবসমাজে নেমে আসবে অনাবিল শান্তি। তাই শান্তিই হচ্ছে সকল দীনের উদ্দেশ্য এবং উপরোক্ত আয়াত যেখানে আল্লাহ বলছেন যে, ‘ইসলাম’ ব্যতীত আর কোনো দীনকে কবুল করা হবে না, সেখানে তিনি এই শাশ্বত চিরন্তন জীবনবিধানকেই বুঝিয়েছেন যা তিনি তাঁর প্রত্যেক নবী-রসুলকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। নবী-রসুল-অবতারদের শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষের মনগড়া অন্যান্য যে জীবনবিধানগুলি যুগে যুগে সৃষ্টি করা হয়েছে সেগুলিকেই মহান আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। একজন নবীর আনীত শিক্ষা যখন কালক্রমে বিকৃত করে ফেলা হয় তখন আরেকজন নবী আসেন এবং সেই পূর্বতন নবীর প্রকৃত শিক্ষাকেই সত্যায়ন ও নবায়ন করেন। তাঁরা কেউই পূর্বতন নবীর মূল শিক্ষায় কোনো পরিবর্তন করেন না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মুসার (আ:) শিক্ষাকে সত্যায়ন করার জন্যই ঈসার (আ:) আবির্ভাব। ঈসা (আ:) নতুন কোনো বিধান নিয়ে আসেন নি, তাঁর প্রচারিত শিক্ষার (ইঞ্জিল) মধ্যে মানুষের জাতীয়-রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার মতো কোনো আইন-কানুন, অর্থনীতিক ব্যবস্থা বা দণ্ডবিধি পাওয়া যায় না। ধর্মের আত্মা হচ্ছে মানবতা, কিন্তু তওরাতের ধারক-বাহকদের কাছে মানবতার চেয়ে ধর্মের বিধিনিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার ফলে ধর্ম হয়ে পড়েছিল ভারসাম্যহীন। ঈসা (আ:) এসে আবার মানবতার পুনস্থাপনা করে ধর্মকে তাঁর যথাস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রচেষ্টা ইহুদি ধর্মব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রে সফল হতে পারে নি।
মহানবী মোহাম্মদ (দ:) যখন মদীনায় রাষ্ট্রগঠন করলেন তিনি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের উপর কোর’আনের বিধি-বিধান চাপিয়ে দেন নি। এবং ইহুদিরাও আল্লাহর রসুলকে শাসক হিসাবে মেনে নিলেও বিচারক হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আল্লাহর রসুলও তাদেরকে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তওরাতের বিধান দিয়েই বিচার করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তওরাতে যে বিধান দিয়েছেন সেই বিধান যদি ইহুদিরা মান্য করে সেটাই যথেষ্ট। বরঞ্চ আল্লাহ সেদিকেই তাদেরকে আহ্বান করেছেন, কোর’আন মানতে হুকুম করেন নি। কারণ তওরাতও আল্লাহরই হুকুম। তিনি পবিত্র কোর’আনে প্রশ্ন রেখেছেন যে, “তারা আপনাকে কেমন করে বিচারক নিয়োগ করবে অথচ তাদের কাছে তওরাত রয়েছে। তাতে আল্লাহর নির্দেশ আছে। অতঃপর তারা পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা কখনোই বিশ্বাসী নয়। আমিই তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে রয়েছে হেদায়াত ও আলো। আল্লাহর আজ্ঞাবহ নবী, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদিদেরকে ফায়সালা দিতেন। কেননা তাদেরকে এই ঐশীগ্রন্থের তত্ত্বাবধান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তারা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব তোমরা মানুষকে ভয় কারো না, আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী ফায়সালা (হুকুম) করে না, তারাই কাফের (সুরা মায়েদা ৪৩-৪৪)।
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট হলো যে, কেবল কোর’আন দিয়েই যে ফায়সালা দিতে হবে তা আল্লাহ বলেন নি, তিনি বলেছেন ‘আনযালাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান। বেদ, তওরাত, জিন্দাভেস্তা, ত্রিপিটক, যবুর, ইঞ্জিলও আল্লাহর অবতীর্ণ, সুতরাং সেগুলি দিয়ে ফায়সালা দিলেও সেটা ইসলামেরই ফায়সালা, সেটাই সমাজে শান্তি আনবে। আর কাফের তো তারাই যারা আল্লাহর কোনো বিধান দিয়েই ফায়সালা দিতে রাজি না, যারা নিজেদের মনগড়া বিধানের পক্ষপাতী। সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সেটা শান্তি আনবে না।
একইভাবে আল্লাহ ঈসা (আ:) এর উপর অবতীর্ণ ইঞ্জিলের অনুসারীদেরকে কোর’আনের বিধান মানতে জোর করেন নি। তিনি বলেছেন, ‘আমি মরিয়ম তনয় ঈসাকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে পথপ্রদর্শন করে এবং এটি মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াতসহ উপদেশবাণী। ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই ফাসেক (অবাধ্য) (সুরা মায়েদা ৪৬-৪৭)।
একইভাবে বৈদিক ধর্ম যখন আত্মাহীন হয়ে গিয়েছিল তখন সর্বজীবে করুণার বাণী নিয়ে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ (আ:)। স্বামী বিবেকানন্দ গৌতম বুদ্ধকে নবী ঈসার (আ:) সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “বুদ্ধদেব এর শিষ্যগণ তাঁহাকে ঠিক ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। ইহুদিধর্মের সহিত খ্রিস্টানধর্মের যে সম্বন্ধ, হিন্দুধর্ম অর্থাৎ বেদবিহিত ধর্মের সহিত বর্তমানকালের বৌদ্ধধর্মের প্রায় সেইরূপ সম্বন্ধ। যীশুখ্রিস্ট ইহুদি ছিলেন ও শাক্যমুনি (বুদ্ধদেব) হিন্দু ছিলেন। শাক্যমুনি নতুন কিছু প্রচার করিতে আসেন নাই। যীশুর মতো তিনিও (পূর্ব ধর্মমতকে) ‘পূর্ণ করিতে আসিয়াছিলেন, ধ্বংস করিতে আসেন নাই।’” [বিশ্বধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত বক্তৃতা]।
একটি বৃক্ষের মধ্যে বহু শাখা প্রশাখা ও অসংখ্য পত্র-পল্লব থাকে, কিন্তু সেগুলি সব একই বৃক্ষের পরিচয় বহন করে, তারা একই বৃক্ষের অংশ হিসাবে পরিচিত হয়। বৃক্ষে যে ফল ধরে তার নামে ঐ বৃক্ষের নামকরণ হয়। তেমনি আল্লাহ যে জীবনব্যবস্থা যুগে যুগে নাজেল করেছেন সবগুলি মূলত একই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা এবং সেই বৃক্ষের ফল হচ্ছে শান্তি। ফলের নামে এই দীনরূপ বৃক্ষের নাম আল্লাহ রেখেছেন ইসলাম বা শান্তি। উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, একমাত্র যে জীবনব্যবস্থায় শান্তি আসবে সেটাই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা। একই বৃক্ষের ভিন্ন শাখায় যেমন পৃথক ফল ধরে না, তেমনি কোনো ধর্মেই অশান্তি হয় না, সকল ধর্মই শান্তিময়। তাই আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (দ:) পর্যন্ত যে শাশ্বত জীবনব্যবস্থা আল্লাহ পাঠিয়েছেন সেগুলি আলাদা আলাদা দীন নয়, সেগুলি একই দীন। এজন্য এর আরেক নাম দীনুল কাইয়্যেমাহ বা সনাতন জীবনব্যবস্থা- যে জীবনব্যবস্থা আদি, নিত্য, চিরন্তন, যা ছিল-আছে-থাকবে। খানিক আগে যে কথাটি বলে আসলাম যে, প্রতিটি ধর্মের মূল শিক্ষায় এবং ভিত্তিতে কোনো পার্থক্য আসে নি। সেই মূল শিক্ষা হচ্ছে- স্রষ্টার শর্তহীন আনুগত্যই শান্তির মূল। তাদের উপাসনা পদ্ধতি যতই আলাদা হোক, উপাস্য তো আলাদা নয়। প্রতিটি ধর্মের মানুষ যদি সেই সৃষ্টিকর্তার বিধান মেনে চলতে সম্মত থাকে, সেই বিধান বেদেরই হোক, তওরাতেরই হোক, ইঞ্জিলেরই হোক, যবুরেরই হোক বা কোর’আনেরই হোক তারা অবশ্যই সামগ্রিক জীবনে শান্তির দিকে ধাবিত হবে।
প্রকৃত ইসলামের বৃক্ষের সন্নিকটেই দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি বৃক্ষ যার ফলগুলি বিষাক্ত। এটা হচ্ছে মানবরচিত জীবনব্যবস্থা যার চিরন্তন ফল অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাত, ঘৃণা। এই বিষবৃক্ষকে আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করবেন। এ কথাই তিনি বলেছেন যে, ইসলাম (শান্তি) ছাড়া আর কোনো দীন গ্রহণ করা হবে না।
মানবজাতির শান্তির জন্য যে বিধি বিধান প্রয়োজন তা আল্লাহ অগণিত প্রেরিতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শেষ রসুল মোহাম্মদ (দ:) এর উপর অবতীর্ণ পবিত্র কোর’আনের মাধ্যমে ইসলাম নামক জীবনব্যবস্থার শেষ ইষ্টকখানা সংযুক্ত হয়েছে। আর নতুন কোনো বিধান আসবে না, বিধান আসার পর্ব শেষ। একেই আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করলাম। শেষ নবীর উপর আল্লাহ যে দায়িত্ব দিয়েছেন সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেছেন, “তিনি তাঁর রসুল প্রেরণ করেছেন পথনির্দেশ ও সত্য জীবনব্যবস্থা সহকারে যেন রসুল একে অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থার উপরে বিজয়ী করে”। এখানেও আল্লাহ হিন্দু-বৌদ্ধ-ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মকে নির্মূল করতে বলেন নি, কেবল বলেছেন জাতীয় জীবনে যেন মানুষের মনগড়া বিধান না চালু থাকে, সেখানে যেন আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদেরকে যেন স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। রসুলাল্লাহর হাতে গড়া জাতিটি যেখানেই সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানেই অন্য ধর্মের উপাস্য ও উপাসনালয়কে সুরক্ষা দিয়েছেন- এর বহু দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত আছে। তবে শেষ নবী এবং শেষ বিধান এসে গেলেও বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে থেকে ধর্ম-সংস্কারক, মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হতেই পারে, তবে তাঁদেরও কাজ হবে সেই অধর্মের বিনাশ ও সাধুদিগের পরিত্রাণ।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমরা যদি সত্যিই চাই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক, তাহলে মানবজাতিকে যে ভাবেই হোক শান্তির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যারা নাস্তিক বা নিরিশ্বরবাদী তারাও শান্তি চান, যারা ধার্মিক তারাও শান্তি চান। তাই মানবতার পক্ষে, শান্তির পক্ষে আস্তিক-নাস্তিক, সংশয়বাদী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। শান্তি আসবে স্রষ্টার বিধানে এটা অব্যয়, অক্ষয় এবং ঐতিহাসিক সত্য। আল্লাহর বিধান মান্য করার অনিবার্য্য ফল শান্তি ও নিরাপত্তা। আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসীরাও যদি তাদের জীবনে আল্লাহর বিধান মান্য করে অবশ্যই তাদের সমাজ থেকেও সকল অন্যায়, অবিচার লুপ্ত হয়ে শান্তি কায়েম হবে। তবে পৃথিবীতে শান্তিতে থাকা আর পরকালে জান্নাতে যাওয়া নিশ্চয়ই এক বিষয় নয়। পরকালের সঙ্গে বিশ্বাস জড়িত। স্বর্গে যাবার জন্য আল্লাহ যে বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে বলেছেন সেগুলি বিশ্বাস করতে হবে। এখানেই প্রশ্ন, ইসলামের শেষ সংস্করণ এসে যাওয়ার পরও ইসলাম গ্রহণ না করে, পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাসে স্থির থেকে কেউ কি স্বর্গে যেতে পারবেন?
এর জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, অবশ্যই তাদেরও জান্নাতে যাওয়ার পথ খোলা আছে। এক্ষেত্রে শর্ত হলো, তাদেরকে শেষ নবী ও শেষ গ্রন্থ কোর’আনকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। এটি শাশ্বত সত্য যে, বিশ্বাসী হিসাবে পরিগণ্য হতে হলে ধর্মের কয়েকটি মূল বিষয়ের উপর বিশ্বাস থাকতেই হবে। সেগুলি হচ্ছে: আল্লাহর উপর, মালায়েকদের উপর, সকল ঐশীগ্রন্থের উপর, সকল নবী-রসুলগণের উপর, কেয়ামত দিবসের উপর, ভাগ্যের ভালো-মন্দের নিয়ন্ত্রক আল্লাহ এ কথার উপর এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর। তাই শেষ নবী এবং শেষ কেতাবের উপর অবিশ্বাস রেখে জান্নাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তেমনিভাবে পূর্ববর্তী কোনো নবী-রসুল-অবতার এবং তাঁদের আনীত কেতাবের প্রতিও অবিশ্বাস রেখে জান্নাতে যাওয়ার আশা করে লাভ নেই। এটাই রসুলাল্লাহ সুস্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘আমার আহ্বান যার কানে পৌঁছালো সে যদি আমার উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করে তবে সে অবশ্যই জাহান্নামী।’-হাদিস
প্রমাণ হিসাবে আমরা আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান বাদশাহ নাজ্জাশিকে গ্রহণ করতে পারি। তিনি রসুলাল্লাহকে সত্য নবী এবং কোর’আনকে আল্লাহর বাণী বলে স্বীকার করে নিলেও কার্যত ইসলাম কবুল করেন নি, তবে সত্য প্রচারে অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। নাজ্জাশী ইন্তেকাল করেছিলেন তাবুক যুদ্ধের পর নবম হিজরীতে। আল্লাহর রসুল নাজ্জাশীর এন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবাদেরকে বলেন- ‘তোমরা তে ামাদের ভাইয়ের জানাযা পড় যিনি তোমাদের দেশ ব্যতীত অন্য দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন।’ রসুলাল্লাহ যখন জানাযায় দাঁড়ালেন তখন কয়েকজন মুনাফেক মন্তব্য করে যে, রসুলাল্লাহ একজন কাফেরের জানাযা পড়াচ্ছেন। এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ সুরা আল ইমরানের ১৯৯ নং আয়াত নাজেল করলেন, যেখানে বলা হয়েছে- ‘গ্রন্থধারীদের কেউ কেউ এমনও রয়েছে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং যা কিছু তোমার উপর অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু তাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোর উপর, আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত থাকে এবং আল্লাহর আয়াতসমুহকে স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে সওদা করে না, তারাই হলো সে লোক যাদের জন্য পারিশ্রমিক রয়েছে তাদের পালনকর্তার নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ যথাশীঘ্র হিসাব চুকিয়ে দেন।’ সুতরাং নাজ্জাশী মুসলমান না হয়েও শেষ নবীকে আত্মা থেকে বিশ্বাস করে তাঁকে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাহায্য করার জন্য জান্নাতবাসী হয়েছেন। সুতরাং একই কথা হিন্দু-বৌদ্ধ-ইহুদিসহ সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।