ঐক্যের বন্ধন যে কোনো বস্তুর অস্তিত্বের প্রধান শর্ত। পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো একে অপরের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকে বলেই বস্তু পদার্থ গঠিত হয়। পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে বিরাজিত আকর্ষণ শক্তির নাম আন্তআণবিক শক্তি যা তাপ প্রয়োগে হ্রাস পায়। ফলে পদার্থটির অবস্থা পরিবর্তিত হয়। যেমন এক পাত্র পানিকে যদি চুলায় উত্তপ্ত করা হয় এক সময় পানির অণুগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব বেড়ে যায় এবং একটা পর্যায়ে পানি বাষ্প হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
তেমনিভাবে স্বার্থ হচ্ছে জাহান্নামের আগুনের মতো যা মানুষের মধ্যকার সব মানবিক গুণাবলীকে ভস্ম করে দেয়, বলা যায় আন্ত-মানবিক শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। পরিণামে মানুষের সাথে মানুষের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি যা একটি সংগঠনের ভিত্তি তা ভেঙে পড়ে। সেটা যে কোনো দেশের সরকারি দলই হোক বা বিরোধী দলই হোক বা একটি পরিবারই হোক – প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রাকৃতিক নিয়মটি প্রযোজ্য।
এ দেশের ঐতিহ্যবাহী দলটির সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস এক সূত্রে গাঁথা – এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু মানুষ বাস করে বর্তমানে, তাই গৌরবের ইতিহাসের চেয়ে তাদের বর্তমান ভূমিকাই অধিক তাৎপর্যের। দীর্ঘদিন ধরে নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে স্বার্থ নিয়ে বিশ্রী হানাহানি, ঈর্ষা, শত্রুতা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
পদের জন্য বা মনোনয়নের জন্য নিজের দলের কর্মীদেরকে তারা হত্যা করছে। বিরোধীদের দ্বারা তাদের যত কর্মী নিহত হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি নিহত হয়েছে নিজের দলের লোকের হাতে। রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলের পক্ষে এহেন কলঙ্ক থেকে তারা কীভাবে মুক্তি পাবেন? তাদের কর্মীদের স্বার্থ নিয়ে এই দ্বন্দ্ব দ্বারা তারা স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকেও কলঙ্কিত করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এ কলঙ্ক তাদের একার উপরে বর্তালে আমার কোনো বক্তব্য ছিল না। কিন্তু তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, তারা যেহেতু জনগণের সমবায়ে গঠিত রাষ্ট্রটির পরিচালন তাই, জনগণের রক্ষণের প্রতি তারা দায়বদ্ধ, শুধু মধু আহরণ করার সুযোগ দিতে তাদেরকে নির্বাচিত করে নি। একাত্তর সনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি এসবই দলটির জনপ্রিয়তার ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু অমর হয়েছেন জাতির মুক্তির জন্য তার নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা আর অপরিসীম ত্যাগের জন্য। অমরত্বের মূলমন্ত্র অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের উপলব্ধি করতে হবে।
একাত্তর সালে পুরো জাতি তাদের উপর জাতির পরিচালনা ও রক্ষণের দায়বদ্ধতা সোপর্দ করেছিল। বর্তমান সরকারি দল হিসাবেও তা থেকে তারা মুখ ফেরাতে পারে না। কিন্তু স্বার্থের আগুনে তাদের যাবতীয় গুণাবলী বা®পীভূত হয়ে যাচ্ছে, তাদের সাংগঠনিক ঐক্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
এটা চিরন্তন সত্য যে, ক্ষমতা কারো চিরকাল থাকে না। তাই স্বার্থ নয় জনভিত্তিই রাজনীতিকদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত। দলীয় ঐক্য আর মানুষের ভালোবাসা থাকলে কোনো গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগকে অতিক্রম করতে পারবে না। এজন্য সর্বপ্রথম তাদেরকে নিঃস্বার্থ হয়ে প্রকৃত জনসেবার মানসিকতা নিয়ে (বুলি নয়) কাজ করতে হবে, কেননা স্বার্থই তাদেরকে অন্তর্কোন্দলের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এমন অবস্থায় পানি যেমন বা®প হয়ে যায়, তেমনি আওয়ামী লীগ কেন, যে কোনো দলই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। কীভাবে মিলিয়ে যাবে তা বুঝতে হলে প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বাথ পার্টির দিকে দৃষ্টিপাত করুন অথবা কর্নেল গাদ্দাফির কথা ভাবুন। তাদের পার্টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, নেতাদের কবর পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেছে।
কোনো জাতির মধ্যে যখন রাজনীতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ চলতে থাকে তখন জনতাও বিভক্ত হয়ে যায়। মানুষের শান্তি নিরাপত্তা ব্যহত হয়, অপরাধ বাড়তে বাড়তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়, সরকারের জনভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন স্বার্থবাজ, অপরাজনীতিক, ধর্মব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীরা তাদের অভিসন্ধি পূরণের সুযোগসন্ধানে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গিদের আধিপত্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে প্রতিটি দেশে থাকা তাদের সমর্থকরাও উজ্জীবিত হয়ে উঠছে। যুদ্ধের পরিণতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভিনদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, সাগরে ডুবে মরছে। তাদেরও সব ছিল কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারার কারণে আজ তারা সব হারিয়েছে। আমাদের দেশেও জঙ্গিবাদের প্রবল হুমকি আছে। এ থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য ষোল কোটি মানুষকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করা অপরিহার্য। এ কাজটি করার জন্য দায়িত্ব রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে সরকারের ও সরকারি দলের। তারা যদি এ কর্তব্যকে উপেক্ষা করে স্বার্থচিন্তায় মগ্ন থাকে, একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত থাকে তবে অচিরে তারাও ইতিহাসে পরিণত হবে এ কথা বলতে ভবিষ্যদ্বক্তা হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
শরিফুল ইসলাম
আমীর, হেযবুত তওহীদ, মেহেরপুর