হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কারা স্বদেশি কারা বিদেশি?

আতাহার হোসাইন:
বহির্দেশ থেকে ইংরেজসহ যে সকল জাতি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছেন, এদেশের মানুষকে শাসন করেছেন তাদের সবাইকে এক বাক্যে পরসম্পদলোভী বিদেশি লুটেরা, ডাকাত বলে প্রচার করা হয়। কি গানে, কি কবিতায়, কি সাহিত্যে, কি ইতিহাস বইয়ে কোথাও এর ব্যত্যয় নেই। আর জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় যারা এক ধাপ এগিয়ে তারা ‘বিদেশি’দের চলে যাওয়ার পরও সেই একইরকম মনোভাব পোষণ কোরে ঐ ‘বিদেশি’দের বর্তমান প্রজন্মকে এদেশ থেকে উৎখাত করতে অতিশয় তৎপর। এই ভূ-খণ্ডে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেছে তার পেছনে এই শ্রেণিটার এমন মনোভাব অনেকটাই দায়ী। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন আঙ্গিকে দেশি-বিদেশির স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক গোলাম আহমাদ মোর্তজা। তিনি তার ‘চেপে রাখা ইতিহাস’ বইটিতে বলেন, ‘আর্য এবং মুসলমান জাতি যারা নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষায় ভারতে এসে এখানে বাস করছেন, উন্নতি ও অবনতির শেষ ফল অর্র্থাৎ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ-সম্পত্তি ভারতেই রেখে শ্মশান কিংবা কবরের মাটিতে নিজেদের মিশিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁরাই স্বদেশি। আর ইংরেজ, যারা এসেছিল ভাগ্য পরীক্ষা করতে। তারা বণিকের বেশে তুলাদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত কোরে ভারত দখল কোরে ভারতের সম্পদ, শস্য, অর্থ যতটা সম্ভব নিংড়ে নিয়ে চলে গেছেন নিজেদের দেশে। তারা ব্রিটেনকে করেছেন অধিকতর সমৃদ্ধশালী। অতএব তারা বিদেশি হলেও কোনক্রমেই মুসলমান ও আর্যজাতি বিদেশি নয়।’
কারা দেশি আর কারা বিদেশি এই প্রশ্নের জবাবে জনাব গোলাম মোর্তজার এই মতটি একটি চরম সত্যকেই প্রতিভাত করে। আমি তার সঙ্গে একমত। প্রাচীন যুগের আর্য, উম্মতে মোহাম্মদীর অন্তর্ভুক্ত মোহাম্মদ বিন কাসেম, দীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আসা শাহজালাল (র:), শাহপরান (র:) প্রমুখ মহান ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের অনুসারীগণ, মুঘল, তাতার, তুর্কি ও পাঠান বংশীয় শাসকবর্গ বিদেশি নন, কারণ তারা এদেশে এসে আর ফিরে যান নি। নিজেদের মেধা, শ্রম সবকিছুকে উজাড় কোরে দিয়ে তারা এদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, এদেশের ইতিহাসকে স্বর্ণোজ্জ্বল করেছেন। সেই সাথে তারা এদেশের বুকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ কোরে এ দেশের মাটির সাথেই মিশে রয়েছেন। অন্যদিকে প্রবল জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের উপরোক্ত ‘বিদেশি লুটেরা’ তত্ত্বকে আমরা এই জন্য বর্জন কোরব যে তারা নিজেরা অতি দেশপ্রেমিক সেজে বাইরে থেকে আগত সকলকেই এক কাতারে ফেলে পরসম্পদলোভী বিদেশি শক্তি আখ্যা দিয়ে থাকেন। এর দ্বারা তারা প্রকারান্তরে নিজেদের জাতীয় উন্নতিতে সকলের অবদানকে অস্বীকার কোরে বসেন।
ইংরেজরা ছিল প্রকৃতই বিদেশি স্বার্থান্বেষী, দস্যুতাপরায়ণ বেনিয়া জাতি। তাদের মূল সরকার ছিল ব্রিটেনেই। সেখান থেকেই নিয়োগ দেওয়া হত বড় লাট, ছোট লাট, বিভিন্ন সরকারি বিভাগের কর্মকর্তা (আমলা) ইত্যাদি হিসেবে। তারা এদেশে এসে বাণিজ্য, শাসন-শোষণ, লুটপাট কোরে সম্পদ হাতিয়ে নিজেদের দেশকে উন্নত করেছে। আবার প্রায় সবাই দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়ে নিজ দেশে গিয়েই মৃত্যুবরণ করেছে। তাই নিঃসন্দেহে যারা এই তালিকায় পড়ে তারাই বিদেশি। কিন্তু যারা এখানে এসে আর কখনোই নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে যান নি তারা এদেশীয়দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। কেননা তারা এদেশ থেকে পাচার কোরে নিজ দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন নি।
ইউরোপীয় বিদেশিদের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ যখন বিদ্রোহ করেছিল তাদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন মুসলিমরা যাদের আজ বিদেশি বলে অপবাদ দেওয়া হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। এই সিপাহী বিদ্রোহের নেপথ্যে হাত ছিল পারস্য থেকে আগত মুঘলদের শেষ উত্তসূরি বাহাদুর শাহ জাফরের। কিন্তু কথিত স্বদেশিদের অনেকেই সেদিন ব্রিটিশরাজের বিপক্ষে অস্ত্রধারণ করতে ভয় পেয়ে তাদের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল। পরবর্তীতে বিদ্রোহে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে তার কবরে স্বরচিত যে এপিটাফ লেখা হয় তাতে নিজ ভূমি ভারতের প্রতি যে ভালবাসা ও প্রবল আকুলতা ফুটে উঠে তা ভেবে যে কোন কঠোর হৃদয়ের মানুষও বেদনায় আপ্লুত হতে বাধ্য।

হায় জাফর! এতোই হতভাগ্য তুমি।
দাফনের জন্য হিন্দুস্থানে দু’গজ জায়গা পেলে না তুমি!
যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমার শত প্রিয়জন,
যেখানে কেটেছে আমার সুখ জীবন যৌবন।

এই করুণ আর্তি কি কোন ‘বিদেশি’ লোকের হতে পারে?
এতো গেল অতীত। এখন দেখা যাক স্বদেশি-বিদেশির এই সংজ্ঞায় বর্তমানে কারা কোন পর্যায়ে পড়েন। যারা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির রাজনৈতিক হর্তাকর্তা, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে অর্থ-কড়ি উপার্জন কোরে একটু জাতে উঠতে পারলেই দেশের সম্পদ পাচার কোরে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি ক্রয় করেন। রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতার মেয়াদ পার হওয়ার আগে আগে নতুন সরকারের হাতে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। অনেক সেনা অফিসারও এমন কাজ করেছেন অতীতে। এই শ্রেণির মানুষগুলি নিজেরা রাজনীতির মঞ্চে, টিভি টকশোতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে দেশপ্রেমের বুলি আউড়ালেও, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে রাজনীতি, দলাদলি, মারা-মারি, ছুরি চালানো, বোমা ফাটানোর মতো কাজকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বৈধতা দান করলেও তাদের নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে ঐসব দেশিয় স্কুল-কলেজগুলোতে পড়া-লেখা করান না, ছাত্র-রাজনীতিতেও জড়িত হতে দেন না। তারাসহ এদেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য কোরে অর্থ কামান কিন্তু নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে বেশি টাকা-পয়সা ব্যয় কোরে পড়া-লেখা করান বিদেশের স্কুল-কলেজগুলোতে। একাধিক বাড়ি-গাড়ি আগেই তারা বিদেশে কোরে রেখেছেন। ইংরেজরা যেমন তাদের শাসনকালে নিজেদের দেশ থেকে বেড়িয়ে আসতেন তেমনি সরকারি কর্মকর্তারা কিছুদিন পর পর সম্ভব হলে সরকারের কোষাগার খালি কোরে বিদেশভ্রমণ কোরে আসেন। ব্রিটিশরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নিজেদের দেশের আদলে এদেশীয় অবকাঠামো গড়ার প্রয়াস পেতেন। অনুরূপ কথিত ‘স্বদেশিগণ’ বিদেশের আদলে এদেশের হোটেল, বাড়ি-গাড়ি, অবকাঠামো গড়ে তুলতে চান। এদেশীয় শিল্পকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র থেকে সে সব দেশের ভাষা, শিল্পকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে বেশি ভালবাসেন। আড্ডায়, কথা-বার্তায়, উদাহরণে বিদেশিদের মতবাদ, বিদেশিদের চালচলনের প্রশংসা করেন এবং এরা ওসবের হুবহু কপি কোরে সেগুলোরই প্রয়োগ করতে চান। এগুলিই তাদের প্রগতিবাদিতা আর দেশপ্রেমের পরিচয়!
আজকে আমাদের সমাজের যারা উচ্চপর্যায়ের বাসিন্দা, তারা আমলাই হোন আর রাজনীতিকই হোন, তাদের মধ্যে আর লুটেরা বর্গি, ঠগি, ইংরেজ, ফিরিঙ্গিদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ওরা যেমন ছিল এরাও ঠিক একই রকম। সুতরাং গায়ের রঙে এদেশীয় হলেও তারা চরিত্রগত দিক থেকে প্রকৃত অর্থেই বিদেশি। তারা কেবল বিদেশিই নয়, তারা এদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত। সুতরাং তাদের ব্যাপারে প্রকৃত স্বদেশিদের সাবধান হওয়া একান্ত জরুরি।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...