রাকীব আল হাসান:
বর্তমানে ‘মো’মেন’, ‘মুসলিম’ ও ‘উম্মতে মোহাম্মদী’এই তিনটিকে একার্থবোধক অর্থাৎ তিনটিই একই জিনিস হিসাবে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তিনটিই আলাদা, যদিও পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ইসলামের এ-রকম মৌলিক কিছু বিষয় সম্পর্কে আমাদের আকিদা সঠিক করে নেয়া দরকার।
আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ দুই ধরনের। তিনি বলছেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি, অতঃপর তাদের কেউ মো’মেন, কেউ কাফের (সুরা তাগাবুন-২)। অর্থাৎ মো’মেন না হওয়ার মানেই কাফের।
মো’মেন কে:- কোর’আনের বিভিন্ন স্থানে, মো’মেন ও মুসলিমদের আল্লাহ আলাদাভাবে সম্বোধন করা ছাড়াও মো’মেন কারা তা তিনি সুরা হুজরাতের ১৫নং আয়াতে পরিষ্কার করে দিয়েছেন – “প্রকৃত মো’মেন শুধু তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে বিশ্বাস করে, তারপর (ঈমান আনার পর) আর তাতে কোনো সন্দেহ করে না, এবং তাদের জীবন ও সম্পত্তি দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদ করে” (সুরা হুজরাত ১৫)। আল্লাহর দেয়া মো’মেনের সংজ্ঞায় দু’টি শর্ত দেয়া হলো; প্রথম শর্ত হচ্ছে আল্লাহ ও রসুলের ওপর ঈমান, অর্থাৎ তওহীদ, যার অর্থ হচ্ছে জীবনের সর্বাঙ্গনে সেটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি যাই হোক না কেন, যে বিষয়ে আল্লাহ বা তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য আছে, কোনো আদেশ-নিষেধ আছে সে বিষয়ে আর কাউকে না মানা। দ্বিতীয় শর্ত হলো ঐ তওহীদকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ অর্থাৎ সর্বাত্মক সংগ্রাম করা। বর্তমানে মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটিতে এ দু’টি শর্তের একটিও নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহর দেয়া এই সংজ্ঞা মোতাবেক এই জাতি কি মো’মেন? অবশ্যই নয়। আর মো’মেন না হওয়ার অর্থ হয় মোশরেক না হয় কাফের।
কাফের কে:- আল্লাহ কোর’আনে কাফেরের যে সংজ্ঞা দিচ্ছেন তা হলো – আল্লাহ যে আইন, বিধান নাযেল করেছেন তা দিয়ে যারা হুকুম করে না অর্থাৎ শাসনকার্য, বিচার ফায়সালা পরিচালনা (এখানে বিচার অর্থে আদালতের বিচার, শাসনকার্য সব বুঝায়, কারণ শব্দটা হুকুম) করে না তারাই কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা- ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এখানে আল্লাহ-রসুলের প্রতি বিশ্বাস ও কোনো প্রকার এবাদত করা বা না করার শর্ত রাখা হয় নি। অর্থাৎ যারা আল্লাহর আইন, বিধান দিয়ে শাসনকার্য ও বিচার ফায়সালা সম্পাদন করেন না তারা যত বড় আল্লাহ-বিশ্বাসীই হন, যত বড় মুসুল্লিই হন, যত বড় মুত্তাকি, আলেম, দরবেশ, পীর-মাশায়েখ হন না কেন কার্যত কাফের।
মোশরেক কে:- আল্লাহ বলেছেন “তবে কি তোমরা কেতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান করো? সুতরাং তোমাদের যারা এরূপ করে তাহাদের প্রতিফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা, অপমান এবং কেয়ামতের দিন কঠিনতম শাস্তি (সুরা বাকারা ৮৫)।” এখানে আল্লাহ পার্থিব জীবনেই যে শাস্তির কথা বলছেন, আজ মুসলিম বলে পরিচিত এই ১৬০ কোটি জনসংখ্যার অবস্থা কি ঠিক তাই নয়? আল্লাহর দেওয়া বিধানের কিছু মানা, কিছু না মানাই হলো শেরক। এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছেÑ“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না; এটা ছাড়া সব কিছু তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন (সুরা নেসা ৪৮, ১১৬)। আল্লাহর হুকুম থেকে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এই কয়েকটি বিধান এ জাতি ব্যক্তিগতভাবে পালন করে, তাও বিকৃতরূপে কিন্তু জাতীয় ও সমষ্টিগত জীবনে আল্লাহর দেওয়া বিধান যেমন অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি বাদ দিয়ে মানুষের তৈরি বিধান মেনে চলছে। সুতরাং এই জাতি আল্লাহর হুকুমের কিছু অংশ মানা আর কিছু অংশ না মানার কারণে কুফর ও শেরকে নিমজ্জিত হয়ে আছে।
মুসলিম: কোনো কিছু সসম্মানে গ্রহণ করে নেয়াকে বলা হয় তসলিম করে নেয়া। যারা আল্লাহর দেয়া দীনুল ইসলামকে সসম্মানে গ্রহণ করে নিয়ে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ করল, তারা মুসলিম। কোনো লোক বা জনসমষ্টি আল্লাহকে ও তাঁর দেয়া জীবন-ব্যবস্থাকে সত্যিকারভাবে বিশ্বাস না করেও মুসলিম হতে পারে। সমষ্টিগতভাবে একটি জনসমষ্টি বা জাতি আল্লাহর দেয়া দীনকে তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ করলে কিছু অবিশ্বাসী লোক সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরুদ্ধে যাওয়ার অসুবিধা ও বিপদ চিন্তা করে প্রকাশ্যে দীনকে তসলিম করে নিলে এরা মুসলিম হলো, কিন্তু মো’মেন হলো না। এদের সম্বন্ধেই আল্লাহ কোর’আনে তাঁর রসুলকে বলেছেন, ‘আরবরা বলে- আমরা বিশ্বাস করেছি (ঈমান এনেছি)। তাদের বলো- তোমরা বিশ্বাস করো নি বরং বলো আমরা তসলিম করেছি (বশ্যতা স্বীকার করেছি); কারণ ঈমান তোমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে নি (সুরা হুজরাত ১৪)। আল্লাহর কথা যে কত সত্য তা তাঁর রসুলের ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গেই বুঝা গেল। রসুলাল্লাহর ইন্তেকালের পূর্বেই সমস্ত আরব মুসলিম হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ আল্লাহর আইনের শাসনের অধীনে এসে গিয়েছিল। মহানবীর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে ঐ মুসলিম আরবের একটা বিরাট অংশ আল্লাহর দীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এটা ইতিহাস। যারা বিদ্রোহ করেছিল তারা মুসলিম হয়েছিল, মো’মেন হয় নি। আবু বকরের (রা.) নেতৃত্বে ঐ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করে সেদিন যারা ইসলামকে রক্ষা করেছিলেন, তারা ছিলেন মো’মেন।