মোহাম্মদ জাকারিয়া হাবিব:
মানুষ মূলতঃ সামাজিক জীব, তাই তাকে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়। সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে গেলে মানুষকে স্বভাবতই একটি নিয়ম-কানুনের অর্থাৎ সিস্টেম এর মধ্যেই বাস করতে হয়। স্বভাবতই সেই সিস্টেমে একদিকে যেমন থাকবে আত্মিক উন্নয়নের ব্যবস্থা অন্যদিকে আইন কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদি সর্বপ্রকার ও সর্ববিষয়ে বিধানও থাকতে হবে। মানবজাতির স্রষ্টা যে সামাজিক জীব মানুষকে সৃষ্টি করলেন তার জন্য একটি নিখুঁত জীবনব্যবস্থাও দান করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত এই জীবনব্যবস্থারই নাম হচ্ছে দীন বা দীনুল হক অর্থাৎ সত্য দীন। মানবজাতি যদি কোন কারণে এটিকে গ্রহণ এবং তাদের জীবনে কার্যকরী না করে তবে অবশ্যই তাকে নতুনভাবে অন্য একটি জীবনব্যবস্থা তৈরি, প্রণয়ন করতেই হবে। কারণ একটি জীবনব্যবস্থা অর্থাৎ সিস্টেম ছাড়া পৃথিবীতে বাস করা মানবজাতির জন্য অসম্ভব। তাহলে মানবজাতির সম্মুখে দুইটি মাত্র পথ। একটি হল, স্রষ্টার দেওয়া নিখুঁত ত্র“টিহীন জীবনব্যবস্থা যেটি মানবজীবনে, আমাদের জীবনে কার্যকরী করলে অন্যায়, অবিচার,অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ, সংঘর্ষ, রক্তপাত প্রায় বিলুপ্ত হয়ে নিরাপদ ও শান্তিময় জীবন আমরা পাবো। এই শান্তিময় অবস্থাটির নামই স্রষ্টা দিয়েছেন ইসলাম, অর্থাৎ শান্তি।
দ্বিতীয় পথটি হল, স্রষ্টার দেওয়া জীবনবিধান (দীন) প্রত্যাখ্যান করলে মানবজাতিকে অবশ্যই নিজেদের জীবনবিধান নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে। স্বভাবতই এই জীবনবিধান নির্ভুল ও ত্র“টিহীন হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে মানবজাতি এই দ্বিতীয় পথটিকেই গ্রহণ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের জীবনবিধান দিয়ে তাদের জীবন পরিচালিত করছে এবং ফলে মানুষের জীবন অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ, সংঘর্ষ, রক্তপাতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। প্রশ্ন হতে পারে যে স্রষ্টার দেওয়া জীবনবিধান মানুষের সমাজ জীবনে প্রয়োগ ও কার্যকরী করা হলে জীবনে যে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হবে তার যুক্তি ও প্রমাণ কি? যুক্তি স্বয়ং স্রষ্টা দিয়ে দিয়েছেন, যে যুক্তির বিরুদ্ধে কোন জবাব নেই। তিনি বলছেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মতম বিষয়ও জানেন’ (সুরা মূলক-১৪)। আর প্রমাণও আছে, তা হল ইতিহাস। শেষ নবী মোহাম্মদের (দ:) মাধ্যমে যে শেষ জীবন বিধান স্রষ্টা প্রেরণ করেছিলেন তা মানবজাতির একাংশ গ্রহণ ও সমষ্টিগত জীবনে কার্যকরী করার ফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি অংশ অর্থাৎ নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে কী ফল হয়েছিল তা ইতিহাস। মানুষ রাতে শোওয়ার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, রাস্তায় ধনসম্পদ ফেলে রাখলেও তা পরে যেয়ে যথাস্থানে পাওয়া যেত, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আদালতে মাসের পর মাস কোন অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসতো না। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে গিয়েছিল। এই স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মত লোক পাওয়া যেত না। শহরে নগরে লোক না পেয়ে মানুষ মরুভূমির অভ্যন্তরে যাকাত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতো।
আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তায় বা তাঁর অসীম জ্ঞানের সম্বন্ধে যারা বিশ্বাসী নন তারা যুক্তি উত্থাপন করতে পারেন যে, চৌদ্দশ’ বছর আগে মানুষ সমাজের যে অবস্থা ছিল সেখানে হয়তো এই জীবনব্যবস্থা কার্যকরী হয়েছিল এবং ঐ অকল্পনীয় ফল দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের, প্রযুক্তির যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে জীবনে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এখন ঐ পুরনো ব্যবস্থা আর সেরূপ ফল দেখাতে পারবে না; এখন মানুষকেই চিন্তাভাবনা করে তার জীবনব্যবস্থা তৈরি করে নিতে হবে এবং আমরা তাই নিচ্ছি। এ কথায় আমার জবাব হচ্ছে, অবস্থার পারিপার্শ্বিকতায় বহু বিষয় বদলে যায়। অনেক বিষয় অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। কিন্তু অনেক বিষয় আছে যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত এর কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন: একটি মানুষের নাকে সজোরে ঘুষি মারলে তার নাক দিয়ে রক্ত বের হবে, লক্ষ বছর আগে এই ঘুষি মারলে তখনও রক্ত বের হতো, আজও বেরোয়, লক্ষ বছর পরেও মানুষের নাকে ঘুষি মারলে রক্ত বেরোবে। এর কোন পরিবর্তন নেই। জীবনের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদ ভিত্তিক পুঁজিবাদ মানুষ সমাজে যে ক্ষতি করে, ধনী-দরিদ্র্যের যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে তা লক্ষ বছর আগেও করত, এখনও করছে এবং আজ থেকে লক্ষ বছর পরেও এই সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি মানবজীবনে প্রয়োগ করলে একই বিষময় ফল সৃষ্টি করবে। আগুনের পোড়াবার শক্তি লক্ষ বছর আগে যা ছিল, আজও তাই আছে এবং লক্ষ বছর পরেও অপরিবর্তনীয়ভাবে তাই থাকবে। এমনি বহু জিনিস আছে যা শাশ্বত অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। যে ছাত্র সারা বছর লেখাপড়া করে সেই ছাত্র স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবে। অন্যদিকে যে ছাত্র ঠিকমত লেখাপড়া করে না সে কখনই ভালো ফলাফল করতে পারবে না। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এই নিয়মের কখনও ব্যতিক্রম হয় না। ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়’, ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’- এই প্রবাদবাক্যগুলিও শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়মকে প্রকাশ করছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোর’আনের একটি আয়াত প্রণিধানযোগ্য। মহান আল্লাহ সুরা নজমের ৩৪ নং আয়াতে মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করছেন- ‘মানুষ যা চায় তাই কি সে পায়?’ এর জবাব আল্লাহ নিজেই দিচ্ছেন একই সুরার ৩৯ নং আয়াতে- ‘মানুষ যা করে তাই পায়?’ – অর্থাৎ মানবজীবন কর্মফলের চক্রে বাঁধা। এই হচ্ছে প্রাকৃতিক আইন। এ কথাগুলি চৌদ্দশ’ বছর আগেও সত্য ছিল, আজও সমানভাবে সত্য আছে।
সর্বজ্ঞানী আল্লাহ এই শেষ জীবনবিধান (দীন) তেমনি সেইসব অপরিবর্তনীয় শাশ্বত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা পৃথিবীর বাকি আয়ুষ্কালের মধ্যে পরিবর্তন হবে না। এই জন্য এই দীনের এক নাম দীনুল ফেতরাহ বা প্রাকৃতিক দীন (কোর’আন, সুরা রূম, আয়াত-৩০)। এই জীবনব্যবস্থার প্রতিটি আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধ তিনি অতি সতর্কতার সঙ্গে ঐ সব অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাতে মানবজাতির বাকি আয়ুষ্কালের মধ্যে কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন না থাকে। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে পরিবর্তনীয় যা কিছু ইতোপূর্বে প্রেরিত জীবনব্যবস্থাগুলিতে ছিল তার কোনটিই এতে স্থান পায় নাই, এতে শুধু অপরিবর্তনীয় শ্বাশত প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলিই স্থান পেয়েছে। একটি উদাহরণ দেই। অতীত যুগে ভারতের মানুষের জন্য আল্লাহ যে দীন বা জীবনবিধান দান করেছিলেন, তাতে নারীদেরকে খুব ভোরে øান করতে হতো, যে নিয়ম আজও সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ মেনে চলছেন। খুব ভোরে নদীতে নেমে স্নান করার এই বিধান কি মেরু অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য প্রযোজ্য? কখনও নয়, তাহলে তারা ঠাণ্ডায় জমে মরে যাবে। শেষ ইসলামে আল্লাহ এই বিধানটি রাখেন নি। সুতরাং এই দীনটি কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর সম্পূর্ণ মানবজাতির জন্য প্রয়োগযোগ্য একটি দীন। যেভাবে আলো বাতাস, পানি, সূর্যালোক, অক্সিজেন ধর্ম-বর্ণ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং জীবনদায়ী তেমনি এই শেষ দীন ইসলাম। কাজেই চৌদ্দশ’ বছর আগে এই জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রয়োগে যে ফল হয়েছিল, বর্তমানে প্রয়োগ করলেও সেই অকল্পনীয় ফলই হবে।
আজ পৃথিবীতে ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র তৈরি যে সিস্টেম চলছে তার কী ফল আমরা দেখছি? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ চরম অশান্তিতে নিমজ্জিত, মানবসমাজ পশুর সমাজে পরিণত হয়ে, বহু আগেই এই গ্রহ তার বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, এখন কেবল জীবনের বোঝা টেনে যাওয়া। এই জীবন আমাদের কর্মফল। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় গণতন্ত্র নামক দীনের বা জীবনব্যবস্থার তীর্থভূমি আমেরিকায় প্রতি মিনিটে ২৪ জন করে নারী ধর্ষিত হয় [তথ্যসূত্র: NSVS, July-2013] এই হিসাবে মাত্র এক বছরে ১,২৬,১৪,৪০০ (এক কোটি ছাব্বিশ লক্ষ চৌদ্দ হাজার চারশত) জন নারী শুধু আমেরিকাতেই ধর্ষিত হয়। অন্যান্য অপরাধের হিসাব করলে রীতিমত মাথা ঘুরে যাবে। টাইম্স অব ইন্ডিয়ার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০০৭-২০০৮ এ সমগ্র ভারতে শুধুমাত্র খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩২,৭১৯ টি। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের ৩৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন রাশিয়ার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। যেখানে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাই দুর্নীতিগ্রস্ত সেখানে সাধারণ জনগণের কী অবস্থা? অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিবাজ ‘শিক্ষিত’ শ্রেণি হা-করে বসে আছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে একই চিত্র।
স্বভাবতই আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হলে প্রাকৃতিক কারণেই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘোটবে। ধীরে ধীরে অপরাধের মাত্রা প্রায় ২-৩% এ নেমে আসবে। এর কারণ হচ্ছে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এতে যেমন কঠোর শাস্তির বিধান আছে, তেমনি আছে নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রক্রিয়া। ইসলামের অর্থনীতি বাস্তবায়নের ফলে ধনী নির্ধনের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন কমে আসবে। প্রত্যেক মানুষই মোটামুটি স্বচ্ছল হয়ে যাবে, ফলে অভাবের জন্য তাকে চুরি করতে হবে না। আল্লাহ বলছেন, ধনীদের সম্পদে দরিদ্র্যের হক রয়েছে এবং যাকাত দিলে ধনীর সম্পদ পবিত্র হয়, দান করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একটি সমাজের ধনীরা যখন তাদের সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে আকূল হয়ে ওঠে তখন সেই সমাজে কেউ অন্তত দারিদ্র্যের কারণে চুরি করবে না এটা সহজেই বোঝা যায়। তারপরও যদি কোন অপরাধমনস্ক মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে চুরি করেও থাকে, আল্লাহর বিধান মোতাবেক শাস্তি প্রদত্ত হলে তাকে দেখে সেই অপরাধটুকুও এক পর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। সুতরাং সিস্টেমই মানুষকে সৎ করে দেবে।
আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:) এর উপর অবতীর্ণ এই সত্যদীন আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মতই নিখুঁত ও অবিকৃত। আল্লাহর সৃষ্টি কেমন নিখুঁত, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিতে কোন ত্র“টি দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও; কোন খুঁত দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ- তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে (সুরা মুলক ৩/৪)। আল্লাহর দেওয়া সত্যদীনও এমনই নিখুঁত। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব মানুষের, তারা কি এভাবেই তাদের জীবন কাটিয়ে যাবে, এমন একটি নারকীয় পরিবেশে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রেখে যাবে, নাকি তাদেরকে একটি স্বর্গীয় পৃথিবী উপহার দিয়ে যাবে।