আসাদ আলী:
ছোটবেলায় পড়েছি- পানির অপর নাম হলো জীবন। আরও পড়েছি পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই নাকি পানি, মাত্র একভাগ মাটি। কী সাংঘাতিক কথা! যখন পড়েছি তখন বিস্ময়ের অন্ত ছিল না, কী? চারভাগের মাত্র একভাগ মাটি, বাকি সব পানি। তাহলে তো পানির আধিক্যই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। হাত বাড়ালেই যে পানির দেখা মেলে, এমনকি না বাড়ালেও যে পানি বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট, পুল-সেতু, গাছপালা সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সেই পানি আবার জীবন হয় কী করে? এত পানির দরকার কী? বেশি পানি না থাকলেই তো বন্যা হয় না, জলোচ্ছাস হয় না, বা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে মানুষ মরে না। অবশ্য তখন এটা ভাবা ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না। বছর ঘুরলেই দেখা মিলতো বন্যার। আজ এই নদীর পানি বেড়ে যায়, তো কাল ওই নদীর পানি বেড়ে যায়। তখন গ্রাম-গঞ্জের মেঠোপথ অদৃশ্য করে দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা যেত কূল-কিনারাহীন সর্বনাশা পানির দৌরাত্ম্য। আমরা কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা সে পানির নিষ্ঠুরতা না বুঝে উল্টো আনন্দ করতাম, পানিতে খেলে-সাঁতরে বেড়াতাম। কার বাড়ি ধ্বসে পড়ল, বা দোকান ভেসে গেল তার চেয়েও আমাদের কাছে বড় বিষয় ছিল আজকের বাঁশপাতার নৌকা চালানোর জন্য কোন জায়গাটিকে বেছে নেয়া যায় সেটা।
যাই হোক, পানি নিয়ে এত কথার কারণ নিছক আত্মজীবনী রচনা করা নয়। কারণ হলো পানি এখন বাঙালির জীবনযাত্রার সিডিউলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আর বাঙালি পানি ছাড়া চলবেই বা কী করে। ভাতে মাছে বাঙালি আর ভাত-মাছ দুটোতেই পানির কারবার। তাই বুঝি ইদানিং পানি শব্দটা বাঙালির যিকিরে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন পানির হাহাকার চলছে। আকাশে-বাতাসে, নদ-নদী, জলাশয়ে, পুকুরে-জমিতে সর্বস্থানেই এখন পানি নামক গুপ্তধন খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে। যদিও বা কোথাও একটু মেঘের আভা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সে মেঘে ‘ছলনা উঠেছে জেগে, এ নহে বাদল’। ড্রেনে বসবাসকারী নাগরিক ব্যাঙ গেয়ে উঠছে, ‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া’। গান শুনে আশায় বুক বাঁধার আগেই আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়। চাইছি বৃষ্টি, আসছে ঝড়। সে ঝড়ে ট্রেন পর্যন্ত লাইনচ্যুত হচ্ছে। কী বিপদেই না পড়েছি আমরা! এ পানিশূন্যতা থেকে একতলা থেকে দশতলানিবাসী বাবুরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ভাড়াটিয়ারা পানি না দেওয়ার কারণে ‘বদ-খাসলত বাড়িওয়ালাদের’ চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে (অবশ্যই আড়ালে) আর ভাবছে কিভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। এভাবে সবখানেই যখন পানি নিয়ে হইচই তখন আমাদের ভাঙাচোরা রাজনীতির মাঠেই বা পানি নিয়ে প্যাচাল হবে না কেন? কত ইস্যুই না এল-গেল, রাজনীতির মাঠে কত বৈশাখী ঝড় উঠল আর গ্রীষ্মের দাবদাহ গেল, হয়ে গেল কত শীতল যুদ্ধ, এখন বর্ষাও তো আসার দরকার।
আগের দিনে বৃষ্টির অপেক্ষায় মানুষ হা-হুতাশ করতো, ধর্ম-কর্মে মনোযোগ দিতো, গান গাইতো- ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই’। কিন্তু এখন কি আর সেই দিন আছে? এখনকার মানুষ বেশি বাস্তববাদী, বস্তুবাদী। আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য যে বিশ্বাস লাগে তার এখন মহা আকাল। তাছাড়া স্রষ্টা মানবজাতিকে পানি তো কম দেন নি, বিশ্বের চার ভাগের একভাগই তিনি পানি দিয়ে ভরে রেখেছেন। কিন্তু যে বৈশ্বিক সিস্টেমে আমাদের বসবাস তাতে স্রষ্টা দিলেই কি সৃষ্টি কপালে তা জুটতে পারে? স্রষ্টার দেওয়া পানি মাঝপথে আটকে দিচ্ছে মানুষরূপী ভুত প্রেতের দল সেটার দায়িত্ব তো আর স্রষ্টা নেবেন না। কাজেই স্রষ্টার কাছে পানি চাওয়ার মুখ কই? তাই পানির জন্য এখন রাজনীতিকরা আন্দোলন আর লংমার্চের শরণাপন্ন হচ্ছেন। আর হবেন না-ই বা কেন, আন্দোলন ছাড়া কোন কিছু কি পাবার উপায় আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, হল দখল, কোটা বাতিল, কৃষি সুবিধা, ব্যবসা সুবিধা, চিকিৎসা সুবিধা থেকে শুরু করে কারও ফাঁসী বা কারও মুক্তির দাবি যেটাই দরকার হোক, আপনি সারাদিন কেঁদে-কেটে চোখের পানি দিয়ে গঙ্গা-মেঘনা-যমুনা বানিয়ে ফেললেই কে দেখতে আসছে। তারচেয়ে দুটো বাসে আগুন দিন দেখবেন ফায়ার সার্ভিস সব পুড়ে যাওয়ার পর পানি নিয়ে আসবে।
কিছুদিন আগে যেই না পানির দাবিতে আন্দোলন শুরু হতে যাচ্ছে, সবেমাত্র তারা কাঁছা বেঁধেছে আর যায় কই! পানি এসে হাজির। বাঙালির মুখে দেঁতো হাসি। একেক জনের হাসির মানে একেক রকম। বেড়ার ওপারে যে হাসি তার মানে আবার অন্যরকম। আমরা পাবলিকরা প্রমাণ পেলাম, মহান এই নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে আমরা আমজনতা যতই নষ্ট-ভ্রষ্ট বাক্যব্যয় করি, যতই তাদের কর্মকাণ্ডকে বিশেষ কোন প্রাণীর ঝগড়া-মারামারির সাথে তুলনা করি না কেন, তারা কিন্তু কাজেরও বটে। শত অনুরোধ, মিনতি আর মানত করে যে পানি আনা গেল না সে পানিকে তারা হুমকি-ধামকি দিয়ে এনে ফেললেন!
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। আর তিস্তায় যখন পানির হাহাকার তখন আমাদের তৃষ্ণার্ত নদীচরের সঙ্গে এ যেন কোন স্যাডিস্টের নিষ্ঠুর তামাশা। মাটি ও মানুষের সঙ্গে এহেন নিষ্করুণ নিষ্ঠুরতায় রবি ঠাকুর কি লিখতেন? হয়তো লিখতেন, ‘এসেছিলে তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে”।
কি জানিয়ে গেল পানি? সে জানিয়ে গেল সে আমাদের নয়। যেটুকু সময় সে ছিল, সে কার দেন-দরবারের ফসল তা নিয়েও শুরু হয়েছিল কাড়াকাড়ি। তারা একটি প্রবাদ মনে করিয়ে দিলেন-Success has many fathers, failure is an orphan. পানি আনার সাফল্যটা অতি দ্রুতই এতিম বাচ্চায় পরিণত হল, গরম গরম ঝাঁঝাল বক্তব্য তখনও শুরু হয় নি, টিভি টকশোতে ঝড় তোলার জন্য টকশোওয়ালাদের সবেমাত্র দরকষাকষি চলছে, ওদিকে পানিই হাওয়া। পানি যেন বলতে চাইছে- আগে তোমরা কৃতিত্ব ভাগাভাগি শেষ করো, পরে আমি আসবো কি না সিদ্ধান্ত নেব। বলবে না কেন? পানিরও তো লজ্জা বলে কথা আছে, কে চায় ‘ভাগের মা’ হতে?
ঝড় উঠলে বক মরে, ফকিররাও কেরামতির সদ্ব্যাবহার করে নেয় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা ভণ্ড ফকির নয়, তারা সত্য সত্যই কেরামতি জানেন। তারা বক মরার জন্য ঝড়ের মুখ চেয়ে বসে থাকেন না, তারা আন্দোলন, ভাঙচুর, জ্বালও পোড়াও জানেন। এখন সে পথেই তারা হাঁটার জন্য আঁটঘাট বাঁধছেন। এখন দেখার বিষয়, যদি সত্যই তাদের কেরামতি ঘটানোর ক্ষমতা থাকে তাহলে এবার তা দেখানোর সুযোগ এসেছে, আর যদি তারা এমন ফকির হন যে, ঝড় ছাড়া কিছু করতে পারেন না, তাহলে তাদের জানা উচিত যে, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায় এবং তারা সেখান থেকে ইতোমধ্যেই ‘উপযুক্ত অভিজ্ঞতা’ নিয়ে ফিরে এসেছেন।