ডা: মো: জাকারিয়া হাবিব
সওমের মাস আসলে যেভাবে ব্যাপক আয়োজন শুরু হয়, মনে হয় যেন সওমই ইসলামের একমাত্র কর্তব্য। গণমাধ্যমগুলি ক্রোড়পত্র বের করে, প্রতিদিন পত্রিকায় বিশেষ ফিচার, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা শুরু হয়। টেলিভিশনে জাদরেল মওলানা, মৌলভীরা আলোচনার ঝড় তোলেন। কিছু ডাক্তার আসেন সওমের উপকারিতা বোঝাতে। সারারাত চলে হামদ ও নাত, শেষরাতে সেহরী অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে যেন এক এলাহি কাণ্ড। এটা প্রশংসাযোগ্য, কারণ ইসলামের একটি বিষয় যত বেশি আলোচিত হবে, সেটা মানুষের জীবনেও তত বেশি আচরিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যেখানে আল্লাহ কোর’আনে সওম ফরদ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন মাত্র একবার আর সওম পালনের নিয়ম কানুন উল্লেখ করেছেন আর দুই/তিনটি আয়াতে, আর জিহাদ ও কিতাল (সংগ্রাম) ফরদ হওয়ার কথা বলা হয়েছে বহুবার আর এর বিবরণ দেওয়া হয়েছে প্রায় সাতশ’র মতো আয়াতে। জিহাদ-কিতাল সংক্রান্ত সব আয়াত একত্র করলে আট পারার মতো হয়ে যায়। মুমিনের সংজ্ঞার মধ্যেও আল্লাহ জিহাদকে অন্তর্ভুক্ত কোরে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন শুধুমাত্র তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ঈমান আনার পর আর সন্দেহ পোষণ করে না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে (সূরা হুজরাত ১৫)।’ এ সংজ্ঞাতে আল্লাহ সওমকে অন্তর্ভুক্ত করেন নাই, জিহাদকে করেছেন। শুধু তাই নয়, সওম পালন না করলে কেউ ইসলাম থেকে বহিষ্কার এ কথা আল্লাহ কোথাও বলেন নি, কিন্তু জিহাদ না করলে আল্লাহ কঠিন শাস্তি দিবেন এবং পুরো জাতিকে অন্য জাতির গোলামে পরিণত করবেন (সূরা তওবা ৩৯)। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, জিহাদ ছাড়া ইসলামের এমন কোন আমল নেই যা পালন না করলে ইসলাম থেকে বহিঃষ্কার হবার কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ বলেছেন, ‘কুতিবা আলাইকুমুল কিতাল- তোমাদের জন্য কিতাল (সংগ্রাম) ফরদ করা হলো (সূরা বাকারা ২১৬, ২৪৬, সূরা নিসা ৭৭)। ঠিক একই শব্দমালা ব্যবহার কোরে আল্লাহ সওমকেও ফরদ করেছেন- কুতিবা আলাইকুম সিয়াম (সূরা বাকারা ১৮৩)। একেবারে শব্দে শব্দে এক, কেবল এক স্থানে বলা হয়েছে কিতাল, আরেক স্থানে সিয়াম। আল্লাহ কোনও বিষয়ে একবার মাত্র হুকুম দিলেও সেটা অবশ্যই ফরদ ও গুরুত্বপূর্ণ কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে বিষয়টি একইভাবে ফরদ করা হলো এবং সেই কাজের বিষয়ে শত শত বার বলা হলো সেটির গুরুত্ব আর দুই তিনটি আয়াতে যে বিষয়টি বলা হলো এই উভয় কাজের গুরুত্ব কি সমান? নিশ্চয়ই নয়। মহান আল্লাহ কোর’আনে শত শতবার জিহাদ কিতাল সম্পর্কে বলার পরও এ প্রসঙ্গে কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। মিডিয়াতে তো প্রশ্নই ওঠে না, এমন কি যে ইমাম সাহেব মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে সিয়ামের ফজিলত নিয়ে সুরেলা ওয়াজে শ্রোতাদের মোহিত করেন, তিনিও ভুলেও জিহাদের নাম উচ্চারণ করেন না।
এর কারণ কী? এর কারণ সওম অতি নিরাপদ একটি আমল যা করলে সুঁইয়ের খোঁচাও লাগার আশঙ্কা নেই। এতে জীবনের ঝুঁকি নেই, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই, কোন কোরবানীরও প্রশ্ন নেই। পক্ষান্তরে জিহাদ এমন একটি কাজ যা করতে গেলে জীবন ও সম্পদের সম্পূর্ণ কোরবানী প্রয়োজন। আরেকটি কারণ হলো আজকের, দুনিয়াময় যে ইসলাম চালু আছে এটা আল্লাহ ও রসুলের ইসলাম নয়। ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা মাদ্রাসা বসিয়ে নিজেরা সিলেবাস পধৎৎরপঁষধস তৈরি কোরে এই জাতিকে যে বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে এটা সেই ইসলাম। এতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা তওহীদ নেই, দীনুল হক প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নেই, কোন জাতীয় আইন-কানুন নেই, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি নেই; অর্থাৎ নামাজ, রোজা আর ব্যক্তিগত আমলসর্বস্ব অন্যান্য ধর্মের মতোই একটি ধর্মে পরিণত হয়েছে। এই ধর্মের পণ্ডিতদের, আলেমদের কাছে দীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামাজ, রোজা, দাড়ি, টুপি ইত্যাদি আর তওহীদ ও জিহাদ একেবারেই নি®প্রয়োজন। অর্থাৎ যে দু’টি বিষয় ছাড়া মানুষ মুমিনই হতে পারবে না সে দু’টিকেই বাদ দেওয়া হয়েছে। মানুষ নামাজ পড়–ক বা রোজা রাখুক, আগে তো চাই মুমিন হওয়া, কাফেরের জন্য তো আর নামাজ রোজার দরকার নেই। সুতরাং যে ইসলামে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই আর জিহাদ নেই, সেই ইসলাম একটি মৃত, আল্লাহর রসুলের ইসলামের বিপরীতমুখী ধর্ম। এই বিকৃত ধর্মের উপাসনা ও আনুষ্ঠানিকতাগুলি মানুষ পালন করে আল্লাহর কাছ থেকে বিনিময় ও জান্নাত পাওয়ার আশায়। পবিত্র রমজান মাসে এই সমস্ত আমলের প্রতিদান অন্য সব মাসের চেয়ে সত্তর গুণ হবে এই আশায় ধর্মপ্রাণ মানুষ ফরদ, ওয়াজেব, সুন্নাহ, নফল, মোস্তাহাব ইত্যাদি সর্বপ্রকার আমল প্রচুর পরিমাণে কোরে থাকেন এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করছেন বলে পরিতৃপ্ত থাকেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাদের কোন আমলই আল্লাহর দরবারে গৃহিত হবে না। এর কারণ তওহীদহীন ইসলাম ইসলামই নয় এবং এই জাতি আল্লাহর দেওয়া মুমিনের সংজ্ঞা মোতাবেক মুমিনও নয়। আরেকটি মারাত্মক বিষয় হচ্ছে গুরুত্বের ওলটপালট। আল্লাহ এবং তাঁর রসুল যে বিষয়ের অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন, এই বিকৃত ইসলামে তাকে একেবারে গুরুত্বহীন কোরে ফেলা হয়েছে; পক্ষান্তরে আল্লাহ-রসুল যে কাজের গুরুত্ব দিয়েছেন কম, সেটিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।