মিনারুল ইসলাম:
আদম (আ.) থেকে শুরু করে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত আল্লাহ যত নবী রসুল (আ.) মানব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককেই যে মূল-মন্ত্র দিয়ে পাঠিয়েছেন তা হচ্ছে তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। স্থান, কাল ও পাত্রের বিভিন্নতার কারণে দীনের অর্থাৎ জীবনব্যবস্থার আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, ইবাদতের পদ্ধতি ইত্যাদি বিভিন্ন হয়েছে কিন্তু ভিত্তি, মূলমন্ত্র একচুলও বদলায় নি। সেটা সব সময় একই থেকেছে- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ। প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রসুলকে আল্লাহ এই দায়িত্ব দিয়েছেন- তারা যেন তাদের নিজ নিজ জাতিকে এই তওহীদের অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে নিয়ে আসেন।
পূর্ববর্তী নবীদের যে কারণে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর এই শেষ নবীকেও সেই একই উদ্দেশ্যে পাঠালেন- অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শান্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে। তাকে (সা.) নির্দেশ দিলেন- পৃথিবীতে যত রকম মিথ্যা জীবনব্যবস্থা, দীন আছে সমস্তগুলিকে নিষ্ক্রিয়, বাতিল করে এই শেষ জীবনব্যবস্থা তথা সত্যজীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে (সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। কারণ শান্তির একমাত্র পথই আল্লাহর দেয়া ঐ জীবন বিধান। আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ নবীকে শুধু নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি শেখাতে পাঠান নি, ওগুলো তাঁর সেই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে জাতির দরকার সেই জাতির চরিত্র গঠনের প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য দীনুল কাইয়্যিমা, সিরাতুল মুস্তাকীমকে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা। এই বিশাল দায়িত্ব, সমস্ত পৃথিবীময় এই শেষ জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করা এক জীবনে অসম্ভব। বিশ্বনবী (সা.) তাঁর নবীজীবনের তেইশ বছরে সমস্ত আরব উপদ্বীপে এই শেষ জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করলেন- ইসলামের শেষ সংস্করণ মানব জীবনের একটি অংশে প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু তাঁর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ হলো না, তাঁর দায়িত্ব সমস্ত পৃথিবী, সম্পূর্ণ মানব জাতি। যতদিন সম্পূর্ণ মানব জাতির উপর এই শেষ জীবন বিধান জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন মানুষ জাতি আজকের মতোই অশান্তি, যুদ্ধবিগ্রহ, অবিচারের মধ্যে ডুবে থাকবে- শান্তি, ইসলাম আসবে না এবং বিশ্বনবীর (সা.) উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বও পূর্ণ হবে না।
আল্লাহর রসুল (সা.) আংশিকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলে গেলেন এবং তাঁর বাকি কাজ পূর্ণ করার ভার দিয়ে গেলেন তাঁর সৃষ্ট জাতির উপর, তাঁর উম্মাহর উপর। প্রত্যেক নবী তাঁর উপর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন তার অনুসারীদের, তাঁর উম্মাহর সাহায্যে। কোন নবীই একা একা তার কাজ, কর্তব্য সম্পাদন করতে পারেন নি। কারণ তাদের প্রত্যেকেরই কাজ জাতি নিয়ে, সমাজ, জনসমষ্টি নিয়ে, ব্যক্তিগত নয়। কেউই পাহাড়ের গুহায়, নির্জনে, বা হুজরায় বসে তার কর্তব্য করেন নি, তা অসম্ভব ছিল। শেষ নবীর (সা.) বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। নবুয়ত পাবার মুহূর্ত থেকে ওফাত পর্যন্ত পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষটির জীবন কেটেছে মানুষের মধ্যে, জনকোলাহলে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে, সশস্ত্র সংগ্রামে- এ ইতিহাস অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। নবুয়তের সমস্ত জীবনটা বহির্মুখী- যে দীন তিনি আল্লাহর কাছে থেকে এনে আমাদের দিলেন সেটার চরিত্রও হলো বহির্মুখী সংগ্রামী। আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যে তার উম্মাহর উপর ন্যস্ত করে গেলেন তা যে তাঁর উম্মাহ পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল তাঁর প্রমাণ হলো তার উম্মাহর পরবর্তী কার্যক্রমের ইতিহাস। কারণ বিশ্বনবীর (সা.) লোকান্তরের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উম্মাহ তাদের বাড়িঘর, স্ত্রী-পুত্র, ব্যবসায়-বাণিজ্য এক কথায় দুনিয়া ত্যাগ করে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করতে দেশ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল। মানুষের ইতিহাসে এমন ঘটনা নেই যে, একটি সম্পূর্ণ জাতি এক মহান আদর্শ পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পার্থিব সব কিছু ত্যাগ করে দেশ থেকে বের হয়ে পড়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা তদানীন্তন পৃথিবীর দুইটি মহাশক্তিকে সশস্ত্র সংগ্রামে, যুদ্ধে পরাজিত করে সমগ্র মধ্য এশিয়ায় আল্লাহর আইনের শাসন কার্যকরী করেছিল। ঐ মহাশক্তিশালী সাম্রাজ্য দুইটি ছিল রোমান ও পারসিক, একটি খ্রিষ্টান অপরটি অগ্নি উপাসক। সংখ্যায়, সম্পদে, সামরিক বাহিনীর সংখ্যায়, অস্ত্রশস্ত্রে, এক কথায় সবদিক দিয়ে ঐ দুইটি বিশ্বশক্তি ছিল ঐ শিশু জাতির চেয়ে বহুগুণে বড় কিন্তু তবুও তারা ঐ সদ্যপ্রসূত ছোট্ট জাতির সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। খ্রিষ্টান শক্তিটি পরাজিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকেই পালিয়ে গেল; আর অগ্নি উপাসক শক্তিটি আল্লাহর দীনকে স্বীকার করে নিয়ে ঐ নতুন জাতির অর্ন্তভূক্ত হয়ে গেল; আজ যেটাকে আমরা ইরান বলি। তারপর ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ঐ জাতিটি তখনকার দিনের অর্ধেক পৃথিবী জয় করে আল্লাহর আইনের শাসনের অধীনে নিয়ে এলো। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যায়, সুবিচার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এক কথায় শান্তি। সমাজে কোনো লোক না খেয়ে থাকত না। স¤পদের এমন প্রাচুর্য তৈরি হয়েছিল যে, দান গ্রহণ করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। এমন সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, একজন যুবতী মেয়ে সমস্ত গায়ে অলংকার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ অতিক্রম করতে পারত, তার মনে একমাত্র আল্লাহ এবং বন্য জন্তু ছাড়া অন্য কিছুর ভয় জাগ্রত হতো না। ঘুমানোর সময় মানুষ ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজন বোধ কোরত না। মানুষ অতি সংগোপনে, রাতের অন্ধকারেও আল্লাহর ভয়ে অন্যায়, মন্দ কাজ থেকে তাঁরা বিরত থাকত। ফলে আদালতে মাসের পর মাস ‘অপরাধ সংক্রান্ত’ কোন অভিযোগ আসত না। স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে মানুষ অন্যত্র চলে যেত। আল্লাহর দেওয়া সত্য জীবনব্যবস্থার প্রভাবে সত্যবাদিতা, আমানতদারি, পরোপকার, মেহমানদারি, উদারতা, ত্যাগ, দানশীলতা ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মানুষের চরিত্র পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাদের ওয়াদার মূল্য ছিল তাদের জীবনের চেয়েও বেশি। প্রকৃত ইসলাম আইয়ামে জাহেলিয়াতের বর্বর, কলহবিবাদে লিপ্ত, অশ্লীল জীবনাচারে অভ্যস্ত জাতিটিকেই এমন সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছিল যে তারা অতি অল্প সময়ে পৃথিবীর সকল জাতির শ্রেষ্
ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
তাঁর (সা.) জাতি ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত তার কাজ চালিয়ে গেছে। তারপর তারা ঐ কাজে বিরতি দিল, কারণ ঐ উদ্দেশ্যটা ভুলে গেল। তাদের দৃষ্টি, তাদের প্রকৃত লক্ষ্য, যে লক্ষ্য আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন তা থেকে ঘুরে যেয়ে যে সহজ-সরল দীনকে সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার কথা সেটাকে চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে ব্যাপৃত হয়ে পড়লো এবং পরিণামে জাতিটির মধ্যে বহু মাজহাব, ফেরকা, দল, মত সৃষ্টি হয়ে তা শত শত ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। পরিণামে জাতিটি ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু এই ধ্বংস হবার কারণ শুধু পণ্ডিতদের ঐ অতি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই নয়। আরও একটি প্রধান কারণ আছে আর তা হলো এই দীনুল কাইয়্যিমাতে, সিরাতুল মুস্তাকীমের মধ্যে বিকৃত সুফী মতবাদ অর্থাৎ ভারসাম্যহীন অধ্যাত্মবাদের অনুপ্রবেশ।