রাকীব আল হাসান:
কোনো সন্দেহ নেই যে মুসলিম দাবিদার এই জাতিটা ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের দাসে পরিণত হবার পরও বহু লোক আল্লাহ ও তাঁর রসুলে (সা.) পরিপূর্ণ বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু সে বিশ্বাস ছিল ব্যক্তিগতভাবে, জাতিগতভাবে নয়। কারণ জাতিগতভাবে তাদের রাজনৈতিক আর্থ সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থা তো তখন ইউরোপীয়ান খ্রিস্টানদের হাতে এবং তারা ইসলামী ব্যবস্থা বদলে নিজেদের তৈরি ব্যবস্থা এই জাতির জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহর দেয়া রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা কেটে ফেলে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে তা বজায় রাখলে আল্লাহর চোখে মুসলিম বা মুমিন থাকা যায় কিনা এ প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর হচ্ছে- না, থাকা যায় না। কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন- তোমরা কি কোর’আনের কিছু অংশ বিশ্বাস কর, আর কিছু অংশ বিশ্বাস কর না? যারা তা করে (অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ সমূহের এক অংশ বিশ্বাস করে না বা তার উপর আমল করে না) তাদের প্রতিফল হচ্ছে এই পৃথিবীতে অপমান, লাঞ্ছনা এবং কেয়ামতের দিনে কঠিন শাস্তি। তোমরা কী করছ সে সম্বন্ধে আল্লাহ বেখেয়াল নন (সুরা আল বাকারা ৮৫)। লক্ষ্য করুন, আল্লাহ পরিষ্কার ভাষায় কী বলেছেন। তাঁর আদেশ নিষেধগুলির কতকগুলি মেনে নেয়া আর কতকগুলিকে না মানার অর্থ আল্লাহকে আংশিকভাবে মানা অর্থাৎ শেরক। তারপর বলছেন এর প্রতিফল শুধু পরকালেই হবে না এই দুনিয়াতেও হবে আর তা হবে অপমান ও হীনতা। আল্লাহ মুমিনদের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন উভয় দুনিয়াতে অন্য সবার উপর স্থান ও সম্মান। এ প্রতিশ্র“তি তাঁর কোর’আনের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এখন যদি এই লোকগুলিকে তিনি বলেন, তোমাদের জন্য এই দুনিয়াতে অপমান ও কেয়ামতে কঠিন শাস্তি, শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘শাদীদ’ ভয়ংকর তবে আল্লাহ তাদের নিশ্চয়ই মুমিন বলে স্বীকার করছেন না। যদিও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর আইন-কানুন (শরীয়াহ) তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলেন।
আল্লাহ কোর’আনে আরো বলেছেন- হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সম্পূর্ণভাবে ইসলামে প্রবিষ্ট হও (কোর’আন, সুরা বাকারা- ২০৮)। আকিদা বিকৃতি হয়ে যাওয়ার ফলে আজ আল্লাহর এই আদেশের অর্থ করা হয় এই যে, ইসলামের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি পালন কর। আসলে এই আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের অর্থাৎ যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে তাদের বললেন যে, ইসলামকে অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে সম্পূর্ণ ও পূর্ণভাবে গ্রহণ কর এর কোনো একটা অংশকে নয়। ব্যক্তিগত অংশকে বাদ দিয়ে শুধু জাতীয়, রাষ্ট্রীয় অংশটুকু নয়; কিম্বা জাতীয় অংশকে বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তিগত অংশটুকুও নয়। ঐ কথার পরই তিনি বলছেন- এবং শয়তানের কথামত চলো না। অর্থাৎ ঐ আংশিকভাবে ইসলামে প্রবেশ করলে তা শয়তানের অনুসরণ করা হবে, শয়তানের কথামত চলা হবে। শয়তান তা-ই চায়, কারণ আংশিকভাবে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে আল্লাহর আইন, বিধান প্রতিষ্ঠা না করে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে তা মেনে চললে সুবিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে না এবং অন্যায়, অশান্তি ও রক্তপাত চলতেই থাকবে। যেমন আজ শুধু পৃথিবীতে নয়, মুসলিম নামের এই জাতিতেও নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ও অন্যান্য খুঁটিনাটি পূর্ণভাবে পালন করা সত্ত্বেও পৃথিবীতে অশান্তির জয়জয়কার, বইছে রক্তের বন্যা। সুতরাং এই জাতি (উম্মাহ) যখন ইউরোপীয়ানদের কাছে যুদ্ধে হেরে যেয়ে তাদের দাসে পরিণত হলো এবং তাদের রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা যখন তাদের বিদেশী প্রভুরা পরিবর্তন করে তাদের নিজেদের তৈরি ব্যবস্থা প্রবর্তন করল, তখন এই জাতি কি আর মুসলিম রইল?
ইউরোপীয়ান খ্রিস্টানদের দাসে পরিণত হবার পরও এ জাতির চোখ খুলল না। মনে এ চিন্তাও এল না যে, একি? আমার তো অন্য জাতির গোলাম হবার কথা নয়। আল্লাহর প্রতিশ্র“তি তো এর উল্টো, আমাকেই তো পৃথিবীর সমস্ত জাতির উপর প্রাধান্য দেবার প্রতিশ্র“তি তিনি দিয়েছিলেন (সুরা নুর ৫৫)। আমরা যখন মুষ্টিমেয় ছিলাম তখন তো আমাদের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে নি। ঐ মুষ্টিমেয় যোদ্ধার কারণে আমরা পৃথিবীর একটা বিরাট অংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় কী হলো? সেই মুষ্টিমেয়র কাছে পরাজিত শত্র“ আজ আমাদের জীবন বিধাতা। এসব চিন্তা এ জাতির মনে এল না কারণ কয়েক শতাব্দী আগেই তাদের আকিদা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কোর’আন হাদিসে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতরা এ জাতির এক অংশের আকিদা এই করে দিয়েছিলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে খুঁটিনাটি শরীয়াহ পালন করে চললেই “ধর্ম পালন” করা হয় এবং পরকালে জান্নাত লাভ হবে। অন্যদিকে ভারসাম্যহীন বিকৃত তাসাওয়াফ অনুশীলনকারীরা জাতির অন্য অংশের আকিদা এই করে দিয়েছিলেন যে, দুনিয়াবিমুখ হয়ে নির্জনতা অবলম্বন করে ব্যক্তিগতভাবে আত্মার ঘষামাজা করে পবিত্র হলেই “ধর্ম পালন” করা হয় ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। জাতীয় জীবন কোন্ োআইনে চলছে, কার তৈরি দণ্ডবিধিতে (Penal code) আদালতে শাস্তি হচ্ছে তা দেখবার দরকার নেই। এই আকিদা (Attitude, Concept) দৃষ্টিভঙ্গি যে বিশ্বনবীর (সা.) শিক্ষার বিপরীত তা উপলব্ধি করার শক্তি তখন আর এ জাতির ছিল না। কারণ ফতোয়াবাজীর জ্ঞানই যে একমাত্র জ্ঞান, পৃথিবীর অন্যান্য কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, পণ্ডিতদের এই শিক্ষার ও ফতোয়ার ফলে এই জাতি একটি মুর্খ জাতিতে পর্যবসিত হয়ে গিয়েছিল, দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্থানে স্থানে কিছু সংখ্যক লোক বাদে সমস্ত জাতিটাই এই অজ্ঞানতার ঘোর অন্ধকারের মধ্যে বসে ভারবাহী পশুর মতো ইউরোপীয়ান প্রভুদের পদসেবা করল কয়েক শতাব্দী ধরে। এই কয়েক শতাব্দীর দাসত্বের সময়ে এই জাতির একটি বড় অংশ অকৃত্রিম হৃদয়ে তার খ্রিস্টান প্রভুদের সেবা করেছে। প্রভুরা যখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে তখন এরা যার যার প্রভুর পক্ষ নিয়ে লড়েছে ও প্রাণ দিয়েছে। যে মহামূল্যবান প্রাণ শুধুমাত্র পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে উৎসর্গ করার কথা সে প্রাণ এরা দিয়েছে ইউরোপীয়ান খ্রিস্টান প্রভুদের সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধে, প্রভুদের নিজেদের মধ্যে মারামারিতে। আল্লাহর শাস্তি কী ভয়ংকর!