আরিফুর রহমান টগর:
টাঙ্গাইল ব্যুরো কার্যালয় উদ্বোধন উপলক্ষ্যে টাঙ্গাইলের ভাসানী হলে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন টাঙ্গাইল-৫ আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন ছানু। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন টাঙ্গাইল পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি এবং টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাষচন্দ্র সাহা, টাঙ্গাইল পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হক আলমগীর, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান, টাঙ্গাইল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম, দেশেরপত্রের উপদেষ্টা এবং হেযবুত তওহীদের আমীর মসীহ উর রহমান এবং দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী। ‘একজাতি একদেশ- ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ’ এবং ‘ধর্মব্যবসা ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতির ইতিবৃত্ত’ শীর্ষক দু’টি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন দেশেরপত্রের টাঙ্গাইল ব্যুরো প্রধান মামুন পারভেজ।
ব্যুরো অফিস উদ্বোধন করেন টাঙ্গাইল পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি। তিনি তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘দেশেরপত্র যে শ্লোগানকে ধারণ করেছে সেখানে তাদেরকে থাকতে হবে। অতীতে অনেক পত্রিকা আমাদের দেশে এসেছে যারা সামাজিক পরিবর্তনের অঙ্গীকার সমৃদ্ধ শ্লোগান নিয়ে কাজ করেছে, কিন্তু কিছুদিন পরেই আর তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না, আমি চাই আপনাদের এই উদ্যোগ যেন বাস্তবায়িত হয়। মানুষ যেন এই পত্রিকাটির মাধ্যমে সত্য ও সুন্দর জীবনব্যবস্থার দিকে পথ চলার অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু শুধুমাত্র শ্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সফলতা আসবে না। এটা এক প্রকার যুদ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে একদিন বীরত্ব দেখালে লোকে তাকে বীর বলে না, যুদ্ধ জয় করতে হবে।’
ময়মনসিংহ অঞ্চলের হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি এবং জননেতা সুভাষচন্দ্র সাহা দেশেরপত্রকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, জঙ্গিবিরোধী, মৌলবাদবিরোধী এবং মানবতাবাদী পত্রিকা হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, “১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য, কিন্তু তখনও একটি শ্রেণি ছিল যারা ধর্মের নামে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তারা হিন্দুদের উপরে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। আমরা চাই না আমাদের দেশে ধর্মের নামে আর কোন বিভেদ থাকুক। আমরা ১৬ কোটি মানুষ, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম ও খ্রিস্টান সবাই মিলে যেন একটি ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি গড়তে পারি দেশেরপত্র সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে। আমরা তাদের এই আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। সব ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণে। তাই সবাই যেন ধর্মকে এবং নিজেদেরকে মানবতার কল্যাণে কাজে লাগায়। দেশেরপত্র যেন সফলভাবে এই আদর্শকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারে এটাই আমার আন্তরিক আশাবাদ।’
পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হক আলমগীর তার বক্তব্যে বলেন, ‘একাত্তর সালে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কলেমাকে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা ধর্মের নাম নিয়ে পাকিস্তানের দালালি করেছে, মুক্তিকামী জনতার সংগ্রামকে রুখে দিতে চেয়েছে। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষ সেদিন ঐক্যবদ্ধ একটি শ্লোগান তুলেছিল- আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ যেখানে শোনা যায় সেখানে আল্লাহ থাকেন, সেখানেই আল্লাহর সাহায্য আসে। ধর্মব্যবসায়ীরা আবার পুরোদমে মাঠে নেমেছে, আসুন আমরা তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই। আপনারা যে দু’টি প্রামাণ্যচিত্র দেখালেন সেগুলি প্রতিটি স্কুলে কলেজে দেখাতে পারলে দেশের তরুণ ও শিক্ষিত সমাজ তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে। স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিগুলিকে এখন আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর খান মেনু মানবজাতি ও ধর্মের ইতিহাস নিয়ে একটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন। তার বক্তব্যে বিভিন্ন ধর্মের সত্যরূপ এবং বিকৃতরূপের মধ্যে তুলনামূলক চিত্র এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোন ধর্মের কি বিধান সে বিষয়গুলি সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সত্যের পক্ষশক্তি হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে, ধারণ করতে হবে এবং সেটা আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ হলেও, দরিদ্র দেশ হলেও, সমস্যাপীড়িত দেশ হলেও ঐতিহাসিক গৌরবের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান একটি দেশ।’ তিনি যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর জঙ্গিবাদ নির্মূলের প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, ‘একটি আদর্শ দিয়েই আর একটি ভ্রান্ত আদর্শকে প্রতিহত করতে হয়, নৈরাজ্য দিয়ে নয়। সেই আদর্শ আছে দেশেরপত্রের কাছে। এজন্য আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সহমর্মিতা প্রয়োজন। একটি জাতির এক প্রজন্ম দেশ স্বাধীন করে পরবর্তী প্রজন্ম দেশকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা করার সুযোগ দেওয়া হয় নি। ছাত্রদের হাতে বইপুস্তক ও কলমের পরিবর্তে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রজন্মগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই ধারা থেকে জাতি আজও বেরিয়ে আসতে পারছে না। তাই এই জাতিবিনাশী রাজনৈতিক আদর্শ এবং ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
প্রধান অতিথির ভাষণে ছানোয়ার হোসেন ছানু (এম.পি) বলেন, “আপনারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন অর্থাৎ এক জাতি এক দেশ ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়া, আমি এই উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি কথা যোগ করতে চাই- এই ঐক্য হতে হবে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকে নিয়ে। রাজাকারদের অনেকেই এখন এ দেশে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের সরকার এই সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে বদ্ধপরিকর।” তিনি বাংলাদেশে ইসলামের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেন, “এদেশ হিন্দু প্রধান ছিল এবং হিন্দুরা বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়ে তাদের শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত ছিল। তাই যখন ইসলাম এদেশে এলো তখন এদেশের মানুষ ইসলামকে ধর্ম হিসাবে মেনে নিল। এজন্যই আমরা আজ মুসলমান। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলাম নিয়ে নোংরা ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে একটি শ্রেণি। আজকে আমাদের সমাজে সেই ধর্মব্যবসায়ীদের যে প্রভাব, অতীতে আরও অনেক বেশি প্রভাব ছিল। তাদের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার কারণ শিক্ষা-দিক্ষার প্রসার।”
তিনি আরও বলেন, ‘ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী নানা গোষ্ঠী নিজেদের মতবাদগুলি প্রচারের জন্য প্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছে, আপনি না চাইলেও নানা কৌশলে আপনাকে সেই সব মতবাদ জানাতে চাইছে।’ এসব মতবাদের ভালোমন্দ বোঝার জন্যও শিক্ষা-বিস্তারের কোন বিকল্প নেই বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের একটি আদর্শ আছে, আমাদের একটি রাজনৈতিক আদর্শ আছে। আমাদেরও ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতি আছে। সুতরাং কেউ আওয়ামী লীগকে নাস্তিক অপবাদ দিয়ে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার আদর্শের দিক থেকে আমরা আপনাদের সঙ্গে একমত। আপনারা মানুষের সঙ্গে মাঠে কাজ করুন, আমাদের আপনাদের পথ এক হলে আমরা সত্যের উপর সকলে ঐক্যবদ্ধ হবো ইনশা’আল্লাহ।’ সভাপতি মামুন পারভেজ সমাপনী ভাষণের মাধ্যমে সেমিনারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।