শাহ আলম, জুড়ী প্রতিনিধি:
পৃথিবীতে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হিংসা, প্রতিশোধ ইত্যাদি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে অহরহই বিভেদের বীজ বপন করা হচ্ছে সমাজে। এদিকে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে মই হিসেবে ব্যবহার করছে ধর্মকে। ফলে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে মানুষ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু আসলেই কি ধর্ম মানুষকে বিভেদ ও শত্র“তার মন্ত্র শেখায়? কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- “স্থির হও ভাই। মূল ধর্ম এক বটে/ বিভিন্ন আধার। জল এক, ভিন্ন তটে/ ভিন্ন জলাশয়।” কবি নজরুল লিখেছেন- মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ। বস্তুত সকল ধর্মই এসেছে এক স্রষ্টার পক্ষ থেকে, সকল ধর্মের মহামানবগণ সেই একই স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত হয়েছেন। তাই সব ধর্মই মানবতার কথা বলে, মনুষ্যত্বের কথা বলে। ধর্মের এই সত্য, শাশ্বত, চিরন্তন রূপকেই মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন হেযবুত তওহীদের এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তিনি মানবজাতিকে এক পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর তুলে ধরা শিক্ষা ও ধর্মের সত্য রূপকে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে যামানার এমামের অনুসারীরা। গতকাল মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে হেযবুত তওহীদের এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর প্রস্তাবনার উপর আয়োজিত একটি সর্বধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তাগণ এসব কথা বলেন। “সকল ধর্মের মর্মকথা, সবার উর্ধ্বে মানবতা” শীর্ষক উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলার জুড়ী উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী মনি। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক দেশেরপত্রের সাব এডিটর শেখ মনিরুল ইসলাম, তৈয়বুন্নেছা খানম ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ অরুণ চন্দ্র দাস, উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রঞ্জিতা শর্মা, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জুড়ী উপজেলা সভাপতি অমূল্য চন্দ্র দাস, উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রিংকু রঞ্জন দাশ, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা, উপজেলা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি জনাব মামুনুর রশিদ সাজু প্রমুখ।
দৈনিক বজ্রশক্তি ও দৈনিক দেশেরপত্রের সৌজন্যে আয়োজিত উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কিশোর রায় চৌধুরী বলেন- ‘‘বজ্রশক্তি ও দেশেরপত্র নির্মিত ডকুমেন্টারি এবং দেশেরপত্রের সাব এডিটরের বক্তব্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার বলার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবুও কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আমি আপনাদের প্রস্তাবনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। আপনারা এগিয়ে যান। আমরা আপনাদের সাথে আছি। আপনাদের এই দূরন্ত চলার পথে আমরা আপনাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করবো। আমি নির্বাচনের পূর্বে এই কথাটিই বলেছিলাম যে, আমরা সবাই একই জাতি, ভাই ভাই। আপনারাও সেটাই তুলে ধরেছেন। এই প্রস্তাবনা অত্যন্ত সময়পোযোগী একটি পদক্ষেপ। সকলের উচিত দৈনিক বজ্রশক্তি ও দেশেরপত্র যে কাজ করছে তাতে সার্বিক সহযোগিতা করা।’
উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রিংকু রঞ্জন দাশ বলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলাদেশ গড়া, কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেয়নি ধর্মব্যবসায়ীরা। এই ধর্মব্যবসায়ীদের ছড়ানো বিভ্রান্তির কারণে আজ মানুষ শান্তিতে নেই। শান্তি পেতে হলে যার যার অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বজ্রশক্তি ও দেশেরপত্রের এই সময়পোযোগী উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই।’
জুড়ী উপজেলা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি জনাব মামুনুর রশিদ সাজু বলেন- “এমামুয্যামান যে মহাসত্য তুলে ধরেছেন তা শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনিবার্য ছিল। এখন তাঁর শিক্ষাকে নিয়ে আমাদের আরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ধর্মব্যবসায়ীদের অন্যায়-অবিচার আর কূপমণ্ডকতায় মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। বিগত দিনে আমরা দেখেছি ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা কীভাবে মানুষ হত্যা করেছে, আগুনে ঝলসে দিয়েছে, পঙ্গু করেছে। এগুলো ধর্মের শিক্ষা নয়। ধর্মের প্রকাশ মানবতার মধ্য দিয়ে। তাই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নির্মূলে এমামুয্যামান যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা অত্যন্ত যুগপোযোগী। এটা ছাড়া আমাদের মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই। আমি সব সময় সর্ব অবস্থায় সর্বাত্মকভাবে আপনাদেরকে সহযোগিতা করবো।”
উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমূল্য চন্দ্র দাস বলেন, “দেশেরপত্র যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে তা যদি তারা ধরে রাখতে পারে তাহলে অবশ্যই তারা একদিন সফল হবে। প্রাথমিকভাবে অনেকেই এই পত্রিকার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছিল। কারণ ছিল ধর্মব্যবসায়ীদের অপপ্রচার। কিন্তু তাদের অপপ্রচার আজ ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে। দেশেরপত্র ও বজ্রশক্তি দিন দিন সামনে এগিয়ে চলছে। আমি আমার সাধ্যমতো তাদের কাজে সহযোগিতা করে যাবো। আমি দেশেরপত্র ও বজ্রশক্তিকে অনুরোধ করবো- ‘আপনারা বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী-গুনীদের সাথে বসুন। তাদেরকে আপনাদের উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত করুন।’
তিনি এমামুয্যামানের প্রস্তাবনার উপর যথাযথ সম্মান জানিয়ে বলেন, পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সূর্য ওঠে না, একই সূর্য সবাইকে আলো দেয়। ঠিক তেমনি প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদেরকে একজন স্রষ্টাই সৃষ্টি করেছেন। আমরা এক, আমরা একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই পিতা-মাতা আদম-হাওয়ার সন্তান। তাই আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে।”
জুড়ী উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রঞ্জিতা শর্মা বলেন, “আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে আমি গর্বিত। আজ উপস্থিত না থাকলে অনেক কিছু আমার অজানা থেকে যেতো। সকল ধর্মই এক স্রষ্টা থেকে আগত সত্য-শ্বাশ্বত সনাতন শিক্ষার ধারক। ৭১ সালে এদেশ স্বাধীন করেছিল সব ধর্মের মানুষ। শুধু মুসলমান বা হিন্দুরা নয়। সেদিনের প্রধান শক্তি ছিল ঐক্য। কিন্তু আজ আমরা সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারি নি ধর্মব্যবসায়ীদের কারণে।”
তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার অঙ্গিকার ব্যক্ত করে বলেন, দেশেরপত্র যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে সেটার সাথে আমরা সম্পূর্ণ একমত। আপনারা এগিয়ে চলেন, আমরা সাথে আছি। তিনি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক / কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক/ মানুষেতে সুরাসুর।
আমাদেরকে সেই মানুষ হতে হবে। মানবতাকে ধারণ করতে হবে। মানবতাই মানুষের পরিচয় নির্দিষ্ট করে।”
এরপর তৈয়বুন্নেছা খানম ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ অরুণ চন্দ্র দাস বলেন, “এটা সময়পোযোগী পদক্ষেপ। সবাই রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, এটা ঠিক না। তিনি ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, আমরা ব্রিটিশদের আসার আগে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। বৃটিশ আসার আগে আমাদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছিল না। হিন্দুদের উৎসবে মুসলমানরা আসতো, মুসলমানদের উৎসবে হিন্দুরা যোগ দিতো। কিন্তু বণিক বৃটিশরা তাদের স্বার্থে আমাদের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করেছে, ধর্মব্যবসায়ী সৃষ্টি করেছে। এদেরকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এদের শেখানো অনৈক্যকে পরিহার করতে হবে। আমাদেরকে আবার শাস্ত্রের বিধানে ফিরে যেতে হবে, তবেই শান্তি পাবো। এমামুয্যামান সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন। একমাত্র তাঁর দেখানো পথই মানুষের মুক্তির সন্ধান দিতে পারে।”
তিনি সব ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সময় এসেছে এখন আমাদের বিকৃত শিক্ষা বাদ দিয়ে স্রষ্টার শিক্ষা মেনে নিতে হবে। আমরা সবাই এক পিতা-মাতার সন্তান, এই সত্যকে যদি আমরা মেনে নিই তাহলে আর আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না, অনৈক্য দাঙ্গা-ফাসাদ থাকে না। সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্র্যরে সম্পর্ক তৈরি হবে প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে। এক ভাই কি তার ভাইকে হত্যা করতে পারে? একে অপরের সাথে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করতে পারে, রক্ত ঝরাতে পারে? এই চেতনাটি আমাদের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। আমরা মানুষ, একই পিতা-মাতার সন্তান একে অপরের ভাই- এটাই হলো আমাদের প্রধান পরিচয়।
তিনি বলেন- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। প্রত্যেক ধর্ম মানবতার কথা বলে। এই বোধ যদি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় তাহলে আমরা সকল ধর্মের অনুসারী মানবজাতি একে অপরের ভাই ভাই হয়ে যাবো। আমি পন্নী সাহেবের কথার মধ্যে পৃথিবীর বড় বড় সব মণীষীদের মিল খুঁজে পাই। বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতি থেকে একমাত্র তিনিই মানুষকে মুক্তি দিতে পারেন। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে একদিন বাংলাদেশ-ই হবে পৃথিবীর মডেল।’
সভাপতির বক্তব্যে জনাব আজির উদ্দিন আহমদ বলেন, “আমাকে এমন একজন মানুষ দেখান যার রক্ত সাদা। পারবেন না, কারণ সব মানুষের রক্ত লাল। সবাই একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই পিতা-মাতার সন্তান। বর্তমানে আমাদের চরিত্রে পশুত্ব প্রকট হয়ে আছে। তাই এত অশান্তি। এখন প্রয়োজন মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন। মানবতাহীন মানুষ প্রকৃতপক্ষে কোনো ধর্মেরই অনুসারী নয়।
তিনি আরও বলেন- আমাদের পন্নী সাহেব পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে সঠিক পথে উঠিয়ে আনার আহ্বান করছেন। আমরা তাঁর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। যেহেতু আমরা সবাই একই পিতা-মাতার সন্তান, সেহেতু আমাদের সবাইকে একই স্রষ্টার বিধানের আশ্রয় নিতে হবে। ব্রিটিশরা আমাদের বিরুদ্ধে বহু ষড়যন্ত্র করেছে। তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা না দিয়ে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতাম, তাহলে আজ বিশ্বে এক পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত হতাম। আমরা যদি শান্তিতে থাকতে চাই তবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। বিশ্ব যখন অশান্তিতে পতিত তখন যুগে যুগে স্রষ্টা মহামানব পাঠান। এমামুয্যামান এমনই একজন ব্যক্তি। আসুন আমরা পন্নী সাহেবের নেতৃত্বে এক হয়ে যাই, মানবতাবাদী হয়ে যাই।”এছাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা তার বক্তব্যে বজ্রশক্তি ও দেশেরপত্রের উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং সর্বাবস্থায় সত্য প্রকাশে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
উক্ত অনুষ্ঠানে “সকল ধর্মের মর্মকথা, সবার উর্ধ্বে মানবতা” এবং “এক জাতি এক দেশ ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আজির উদ্দিন আহমদ এবং সঞ্চালনা করেন দেশেরপত্রের প্রতিনিধি শাহ আলম এবং তানভীর আহমদ।