মাননীয় এমামুযযামানের লেখা থেকে সম্পাদিত:
বিশ্বনবী (দ:) মানবজাতিকে যে জীবন-বিধান দীনুল ইসলাম দিয়ে গেছেন সেটা, আর আজ আমরা যেটাকে ইসলাম মনে কোরছি, নিষ্ঠা ভরে পালন কোরছি, এই দুটো শুধু সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস নয়, দু’টো পরস্পর বিরোধী। মহানবী (দ:) তাঁর আসহাবদের যা শিক্ষা দিয়েছেন, আজ আমাদের ওলামায়ে দীন, পীর মাশায়েখরা তার ঠিক উল্টো শিক্ষা দেন। এই জাতি যেটাকে ইসলাম বোলে মনে করে, সেটা প্রকৃত ইসলাম থেকে এত বিকৃত যে প্রকৃতটা বোঝানো অতি কঠিন হোয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা কোরছি। আমাদের আজ যারা ইসলাম শেখান তাদের ইসলাম সম্বন্ধে আকিদা বিকৃত। এই দীনের উদ্দেশ্য কী, ঐ উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া কী, দীনের মূল্যবোধের গুরুত্ব অর্থাৎ Priority কী এসব তাদের বিকৃত, উল্টাপাল্টা হোয়ে গেছে। এরা ওয়াজ করেন, শিক্ষা দেন-নামাজ পড়ো নামাজ পড়ো, যেন নামাজই উদ্দেশ্য। নামাজ উদ্দেশ্য নয়, নামাজ প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া। আল্লাহর এই বিরাট বিপুল সৃষ্টির মধ্যে এমন একটি জিনিস নেই যা উদ্দেশ্যহীন। যা কিছু উদ্দেশ্যহীন তা’ই অর্থহীন। যে নামাজকে আল্লাহ কোর’আনে আশি বারের চেয়েও বেশি উল্লেখ কোরেছেন তা কি অর্থহীন হোতে পারে? অবশ্যই নয়। তাহোলে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস নামাজ এর অর্থ কী, উদ্দেশ্য কী? এরা বলেন নামাজ এবাদত। এরা এবাদতের অর্থ বোঝেন না। এবাদত তো অনেক কিছুই, যে জন্য আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি কোরেছেন সেগুলো এবং আল্লাহ-রসুলের (দ:) নিষিদ্ধ কাজ ছাড়া আর সবই তো এবাদত। আল্লাহতো ওগুলোকে অত গুরুত্ব দেন নি। আশি বারের বেশি বলেন নি। অন্য দল বলেন, নামাজ হোল আল্লাহকে প্রভু বোলে স্বীকার করা, তাকে সাজদা করা। এর কোনটাই নয়। এই বিশাল অসীম সৃষ্টির যিনি স্রষ্টা, তিনি বে-নেয়ায। কারো কাছ থেকে কোন কিছুর তাঁর দরকার নেই। তিনি কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন। আমরা তাঁকে স্বীকার-বিশ্বাস কোরি বা না কোরি তাতে তাঁর কণা মাত্র আসে যায় না। সেই প্রবল প্রতাপ মহান প্রভু আমাদের নামাজেরও বিন্দুমাত্র মুখাপেক্ষী নন। তিনি আমাদের সালাত (নামাজ) প্রতিষ্ঠা কোরতে আদেশ দিয়েছেন আমাদেরই কল্যাণের জন্য, তাঁর নিজের কোন উপকারের জন্য নয়। আমাদের কল্যাণ অর্থ মানব জাতির কল্যাণ, শুধু মো’মেনদের, মোসলেমদের কল্যাণ নয়। কেমন কোরে তা ব্যাখ্যা কোরছি।
আল কোর’আনের সুরা আল ফাতাহ-২৮, সফ-০৯ এবং তওবা-৩৩ নং আয়াত অনুসারে – সমস্ত পৃথিবীতে যত রকম জীবনব্যবস্থা অর্থাৎ দীন আছে সে সমস্ত গুলিকে বাতিল, নিস্ক্রিয়, বিলুপ্ত কোরে এই শেষ ইসলামকে মানবজাতির উপর কার্যকর কোরে পৃথিবীময় শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য শেষ নবীকে (দ:) আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাঁর জীবনী ও ইতিহাস সাক্ষী যে, তাঁর পূত-পবিত্র জীবন ঐ একটি মাত্র কাজেই ব্যয় হোয়েছে। দু’টি কথা অতি পরিষ্কার। একটা হোচ্ছে, এক জীবনে ঐ কাজ অসম্ভব, এটা অতি মুর্খেও বুঝবে। দ্বিতীয়টি হোচ্ছে আল্লাহও জানেন তাঁর রসুলও (দ:) জানতেন যে পৃথিবীর মানুষকে বিনীতভাবে এই শেষ দীনকে গ্রহণ কোরতে ডাকলেই তারা গদ গদ হোয়ে তাদের বিকৃত ও অন্যায় জীবন-ব্যবস্থা, দীন ত্যাগ কোরে চলে আসবে না। শয়তান, এবলিস- যে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ কোরে রেখেছে সে-অত দুর্বল নয়। সে সর্বশক্তি দিয়ে মানুষকে প্ররোচিত কোরবে এই দীনের বিরোধিতা কোরতে এবং সে বিরোধিতা সর্ব উপায়ে। প্রথমটির জন্য সমাধান এই হোল যে বিশ্বনবী (দ:) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী একটি জাতি সৃষ্টি কোরলেন- যার নাম হোল উম্মতে মোহাম্মদী এবং তাকে নির্দেশ দিলেন যে পৃথিবী থেকে তাঁর চলে যাবার পর তারা যেন তাঁর সেই সংগ্রাম তেমনি চালিয়ে যায়, যেমন তারা তাঁর বর্তমানে তাঁর (দ:) সঙ্গে থেকেই চালিয়েছে। এটিই হোচ্ছে তাঁর সুন্নাহ। বোললেন তাঁর এই সুন্নাহ যে ত্যাগ কোরবে সে তাঁর (দ:) কেউ নয়, তিনিও (দ:) তার কেউ নন (হাদিস)। দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান হোল এই যে, যে জাতিটি তিনি সৃষ্টি কোরলেন সে জাতিটি যেন ঐক্যে, উদ্দেশ্য অর্জনের আপসহীন সংকল্পে, শৃঙ্খলায়, আত্মত্যাগে, মহত্ত্বে এবং সর্বোপরি যুদ্ধবিদ্যায় এমন পারদর্শী ও দক্ষ হয় যে সে জাতি অপরাজেয় হোয়ে যায়। জাতিটির ঐ চরিত্র সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া হোল সালাহ, যাকে আমরা ফারসি ভাষায় বোলি নামাজ। আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে উপলব্ধি কোরে বিশ্ব নবী (দ:) বোললেন, “আমি (আল্লাহর) আদেশ প্রাপ্ত হোয়েছি সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত— না সমস্ত পৃথিবীর মানুষ স্বীকার করে যে বিধানদাতা (এলাহ) একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয়, আমি তাঁর রসুল, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয় (হাদিস: আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা:) থেকে বোখারী, মেশকাত)।” অর্থাৎ ঐ সর্বাত্মক সংগ্রামের উদ্দেশ্য হোচ্ছে, (ক) আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, আল্লাহর পাঠানো শেষ জীবন-বিধান ছাড়া অন্য সর্বপ্রকার বিধান প্রত্যাখ্যান করা, (খ) সালাহ প্রতিষ্ঠা করা, ও (গ) যাকাত দেয়া। এটাই কোর’আনে উল্লেখিত দীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতাল মোস্তাকীম (কোর’আন- সুরা আল বাইয়ানা – ৫)। এই দীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতুল মোস্তাকীমকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরতে যে সংগ্রাম কোরতে হবে সেই সংগ্রাম করার জন্য যে চরিত্র প্রয়োজন সেই চরিত্র সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া হোল সালাহ।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি কাজের দু’টি ভাগ থাকে, একটি উদ্দেশ্য অন্যটি ঐ উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া। এই শেষ ইসলামকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা হোচ্ছে উদ্দেশ্য। প্রক্রিয়া হোচ্ছে জেহাদ-সংগ্রাম (সর্ব রকমের সংগ্রাম, বুঝিয়ে, লিখে, বক্তৃতা কোরে, কথা বোলে ইত্যাদি সর্ব উপায়ে) এবং জেহাদ করার শিক্ষা-প্রশিক্ষণ হোচ্ছে সালাহ। অর্থাৎ সালাহ উদ্দেশ্য নয় উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ-ট্রেনিং। যদি উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়া হয় তবে প্রশিক্ষণ বা প্রক্রিয়ার আর কোন অর্থ থাকে না। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, আপনি দূরে কোনো স্থানে যাবেন। যাওয়া আপনার অত্যন্ত জরুরি। মনে কোরুন যেখানে যাওয়া আপনার অতি প্রয়োজন সে স্থানটা এত দূরে যে হেঁটে যাওয়া যায় না, হয় সাইকেলে না হয় গাড়িতে যেতে হবে। আপনি সাইকেল বা গাড়ি চালাতে জানেন না। আপনি আপনার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একটি গাড়ি বা সাইকেল কিনলেন এবং তা চালাতে শিক্ষা কোরলেন। তাহোলে আপনার উদ্দেশ্য হোল ঐ নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া, প্রক্রিয়া হোল সাইকেল বা গাড়ি এবং ওটা চালানো হোল আপনার প্রশিক্ষণ। মনে কোরুন যখন আপনি ঐ সাইকেল বা গাড়ি চালানো শিখছেন তখন আপনি আপনার ঐ নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানের কথা ভুলে গেলেন। তাহোলে আপনার ঐ শিক্ষা, সাইকেল বা গাড়ি চালানো সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ, যে কারণে, যে উদ্দেশ্যে আপনি ঐ সাইকেল বা গাড়ি চালানো শিখছিলেন তাই-ই আপনার মনে নেই। আপনি অতি স্বল্প সময়ে ঐ সাইকেল বা গাড়ি চালানোতে অতি দক্ষ হোয়ে গেলেও আপনার উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না। আপনার প্রশিক্ষণ নিরর্থক।
বিশ্বনবী (দ:) দুনিয়া থেকে চলে যাবার ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত সালাত সম্বন্ধে উম্মতে মোহাম্মদীর আকিদা ঠিক ও নির্ভুল ছিলো অর্থাৎ এটা উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ। ঐ সময়ের পর এই উম্মাহ তাঁর উদ্দেশ্য ভুলে গেলো এবং জেহাদ ত্যাগ কোরল। উদ্দেশ্য ত্যাগ করার পর উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ স্বভাবতঃই অর্থহীন হোয়ে গেলেও ওটাকে ত্যাগ করা হোল না, কারণ কোর’আন ও হাদিসে এর উপর গুরুত্ব এত বেশি দেওয়া হোয়েছে যে- একে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। তখন সালাহকে অন্য অর্থ করা হোল, অন্য রূপ দেয়া হোল। মহানবীর (দ:) প্রকৃত সুন্নাহ তাঁর জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘জেহাদ’কে বাদ দিয়ে তাঁর ব্যক্তি জীবনের খুঁটিনাটি অভ্যাসগুলিকেই যেমন সুন্নাহ হিসাবে নেওয়া হোয়েছিলো, তেমনি সালাহ, নামাজের প্রকৃত অর্থ চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ হিসাবে বাদ দিয়ে একে অন্যান্য ধর্মে উপাসনা বোলতে যা বোঝায় সেই অর্থে নেয়া হোল। অর্থাৎ সালাত আত্মার উন্নতির, আল্লাহর নৈকট্যের প্রক্রিয়া। এই অর্থ এবং বর্তমানের অন্যান্য বিকৃত ধর্মগুলির উপাসনার অর্থের মধ্যে কোন তফাৎই নেই। অন্যান্য ধর্মের আকিদায় ধর্ম অর্থই আধ্যাত্মিক ব্যাপার, দুনিয়ার বিরোধী, সুতরাং উপাসনা অর্থই স্রষ্টাকে পূজা, তাঁর সামনে নত হওয়া, পার্থিব বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর ধ্যান করা। গবেষণার দরকার নেই, নামাজকে শুধু বাইরে থেকে দেখলেই ঐ আকিদা-ধারণা হাওয়ায় মিশে যায়। বহু জনসমাবেশে, সামরিক কায়দায় লাইনের পর লাইনে দাঁড়িয়ে সার্জেন্ট মেজরের (ঝবৎমবধহ, সধলড়ৎ) হুকুমের মত ইমামের তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে রুকু, সাজদা কোরে ওঠ-বস কোরে, মনে মনে কোর’আন আবৃত্তি কোরে, ইমামের হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে ডাইনে বায়ে মুখ ঘুরিয়ে আর যা-ই হোক, নিবিষ্ট মনে যে আল্লাহকে ধ্যান করা যায় না এ সত্য বুঝতে সাধারণ জ্ঞানের (ঈড়সসড়হ ংবহংব) বেশি প্রয়োজন হয় না। যদি সন্দেহ হয় তবে খুব মনসংযোগ কোরে নামাজ পড়তে চেষ্টা কোরে দেখতে পারেন- দেখবেন নামাজে ভুল হোয়ে যাবে। বর্তমানে যে আকিদায় নামাজ পড়া হয়, তা নামাযের প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়। নামাজ একটা ছাঁচ (গড়ঁষফ)। মানুষের বিভিন্ন রকম চরিত্রকে এই ছাঁচে ঢালাই কোরে একটি বিশিষ্ট চরিত্রের জাতি সৃষ্টি করা হোচ্ছে এর উদ্দেশ্য, যে জাতি দিয়ে পৃথিবীতে শেষ ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা হবে, বিশ্বনবীর (দ:) উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করা হবে, পৃথিবীতে পূর্ণ শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত হবে, তাঁর (দ:) ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ উপাধি অর্থবহ হবে। তাই নামাজ এত গুরুত্বপূর্ণ, তাই আল্লাহ ও রসুল একে এতবার তাকিদ দিয়েছেন। যে চরিত্র সৃষ্টি না হোলে জাতি ঐ মহাকর্তব্য পূর্ণ কোরতে পারবে না সেই চরিত্র সৃষ্টি কত প্রয়োজনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নামাজকে এত গুরুত্ব দেয়া হোয়েছে। কিন্তু নামাজ উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ। উদ্দেশ্যই যদি বিসর্জন দেয়া হয় তবে প্রশিক্ষণ অর্থহীন। (চোলবে)