হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জাতির উদ্দেশ্যচ্যুতি ও দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি {পর্ব-৩}

মাননীয় এমামুযযামানের লেখা থেকে সম্পাদিত:

অতি বিশ্লেষণ কোরে দীনের প্রাণশক্তি বিনষ্ট কোরে দেওয়ার কাজটা আজকের নতুন নয়, শুধু আমাদের ধর্মীয় পণ্ডিত আলেম-মাওলানারাই যে এই কাজ কোরেছেন তাই নয়। পূর্ববর্তী দীনগুলোতেও অতি-ধার্মিকরা গজিয়েছেন ও পাণ্ডিত্য জাহির কোরে তাদের দীনগুলোকে ধ্বংস কোরে দিয়েছেন, এ সত্য রসুলাল্লাহর (দ:) হাদিস থেকে পেছনে দেখিয়ে এসেছি। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোর’আনে একটি উদাহরণ দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁর নবী মুসার (আ:) জীবনী থেকে যেখানে আল্লাহ বনী ইসরাইলদের একটি গরু কোর’বানি কোরতে আদেশ দিলেন। মুসা (আ:) যখন এই কোরবানির আদেশ বনী ইসরাইলদের জানিয়ে দিলেন তখন যদি তার মোটামুটি ভালো একটি গরু এনে কোরবানি কোরে দিতো তাহলে তাতেই কাজ হোয়ে যেতো। কারণ কোরবানির গরুটা কেমন হবে সে সম্বন্ধে আল্লাহ কোনো শর্ত দেন নি। কিন্তু আল্লাহ কোর’আনে বোলছেন- বনী ইসরাইল তা করে নি। তারা মুসার (আ:) মাধ্যমে আল্লাহকে প্রশ্ন কোরতে লাগলো- গরুটার বয়স কত হবে, গায়ের রং কী হবে, সেটা জমি চাষের জন্য শিক্ষিত কিনা, জমিতে পানি দেয়ার জন্য শিক্ষিত কিনা, ওটার গায়ে কোন খুঁত থাকতে পারবে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি (কোর’আন- সুরা আল-বাকারা ৬৭-৭১)। তারা প্রশ্ন কোরে যেতে লাগলো আর আল্লাহ তাদের প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। তারপর যখন প্রশ্ন করার মতো আর কিছুই রোইল না তখন স্বভাবতঃই ঠিক অমন একটি গরু পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হোয়ে দাঁড়ালো। একটা সহজ সরল আদেশ- “একটা গরু কোরবানি কর” এটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এমন কঠিন কোরে ফেলা হোল যে, অমন গরু আর পাওয়া যায় না। এই জাতির মহা পণ্ডিতরাও বিশ্বনবীর (দ:) ওফাতের ৬০/৭০ বছর পর ঠিক ঐ কাজটিই মহা ধুমধামের সাথে আরম্ভ কোরলেন। দু’টি মাত্র আদেশ- আমাকে ছাড়া কাউকে মানবে না আমার দেয়া জীবন-বিধান ছাড়া আর কোনো বিধান মানবে না, আর এই জীবন-বিধানকে সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরবে। সহজ, সরল দু’টি আদেশ। বিশ্বনবীর (দ:) উম্মাহ ইস্পাতের মত কঠিন ঐক্য নিয়ে ঐ কাজ কোরতে আরব থেকে বের হোয়ে অবিশ্বাস্য ইতিহাস সৃষ্টি কোরেছিলেন। পূর্ববর্তী দীনের পণ্ডিতদের মতো এ উম্মাহর পণ্ডিতরাও একে ধ্বংস কোরে দিলেন। 

এখানে একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার। আমি ফিকাহ বা ফকিহদের বিরুদ্ধে বোলছি না। কারণ কোর’আন ও হাদিস থেকে জীবন বিধানের নির্দেশগুলি একত্র ও বিন্যাস কোরলে যা দাঁড়ায় তাই ফিকাহ- অর্থাৎ ফিকাহ ছাড়া কোনো মোসলেমের জীবনব্যবস্থা অনুসরণ অসম্ভব। আমার বক্তব্য ঐ ফিকাহর অতি বিশ্লেষণ, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ যা আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ:) কঠোরভাবে নিষেধ কোরে দিয়েছেন। আমাদের ফকিহরা যদি কোর’আন-হাদিসের মৌলিক আদেশ নিষেধগুলিকে সুন্দরভাবে শ্রেণি বিন্যাস কোরেই ক্ষান্ত হোতেন এবং লিখতেন যে এই-ই যথেষ্ট- এরপর আর অতিরিক্ত বিশ্লেষণে যেও না, কারণ আল্লাহ বোলেছেন দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না এবং রসুলাল্লাহও (দ:) নিষেধ কোরেছেন, তাহলে তাদের কাজ হোত অতি সুন্দর। ইসলামকে প্রকৃতভাবে সেবা করা হোত এবং আল্লাহর কাছ থেকে তারা পেতেন প্রচুর পুরস্কার। কিন্তু দুর্ভাগ্য হোচ্ছে তারা তা করেন নি। তারা আজীবন কঠিন পরিশ্রম কোরে আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলি ও বিশ্বনবীর (দ:) কাজ ও কথাগুলিকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম বিশ্লেষণ কোরতে কোরতে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা পূর্ণভাবে পালন করা প্রায় অসম্ভব এবং কেউ চেষ্টা কোরলে তার জীবনে অন্য আর কোনো কাজ করা সম্ভব হবে না, এ দীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের তো প্রশ্নই আসে না। কারণ ফকিহরা তাদের ক্ষুরধার প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যেকে হাজার হাজার মাসলা-মাসায়েল সৃষ্টি কোরেছেন। প্রধান প্রধান গণের এক এক জনের সিদ্ধান্তের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। জাতি ঐ মাসলা-মাসায়েলের মাকড়সার জালে জড়িয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হোয়ে গেছে, স্থবির হোয়ে গেছে।
এই পঙ্গুত্ব, স্থবিরত্ব থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ এই দীনকে কোরলেন অতি সহজ ও সরল, সেরাতুল মোস্তাকীম, দীনুল কাইয়্যেমা। কোন বিষয়েই আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান, কারো নিয়ম-কানুন মানি না, শুধু এইটুকুমাত্র। এ যে কত গুরুত্বপূর্ণ, কত জরুরি তা বোঝাবার জন্য বোললেন, এর বেশি তো আমি তোমাদের কাছে চাইনি (কোর’আন- সুরা আল বাইয়েনা ৫)। এতেও সন্তুষ্ট না হোয়ে তিনি সেরাতুল মোস্তাকীমকে প্রতি রাকাতে অবশ্য পাঠ্য কোরে দিলেন, যাতে প্রতিটি মোসলেম মনে রাখে যে, আমার দীন অতি সহজ, অতি সরল, আমি যেন কখনও একে জটিল না কোরে ফেলি, জটিল কোরে ফেললে আমার দীনের সর্বনাশ হোয়ে যাবে। এই সেরাতুল মোস্তাকীমের সহজতার, সরলতার মহাগুরুত্ব উপলব্ধি কোরে রসুলাল্লাহ (দ:) এক হাদীসে বোললেন- দীন সহজ, সরল (সেরাতুল মোস্তাকীম), একে নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি কোরবে তারা পরাজিত হবে। অন্য হাদীসে বোললেন, জাতি ধ্বংস হোয়ে যাবে (হাদিস- আবু হোরায়রা (রা:) থেকে মোসলেম)। এই সাবধানবাণীতেও আশ্বস্থ না হোতে পেরে বিশ্বনবী (দ:) আরও ভয়ংকর শাস্তির কথা শোনালেন। বোললেন- কোর’আনের কোনো আয়াতের অর্থ নিয়ে বিতর্ক কুফর। এবং কোনো অর্থ নিয়ে মতান্তর উপস্থিত হোলে আমাদেরকে কী কোরতে হবে তারও নির্দেশ তিনি আমাদের দিচ্ছেন। বোলছেন, কোনো মতান্তর উপস্থিত হোলে তা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও (হাদিস- মোসলেম, মেশকাত)। অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে যখনই মতান্তর উদ্ভব হবে তখনই চুপ হোয়ে যাবে, কোনো তর্ক-বিতর্ক কোরবে না। অর্থাৎ বিতর্কে যেয়ে কুফরি কোরবে না, এবং যে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই সেই সেরাতুল মোস্তাকীম, দীনুল কাইয়্যেমাকে আঁকড়ে ধোরে থাক, এখানে লক্ষ্য করার একটা বিষয় আছে, দীনের ব্যাপার নিয়ে বিতর্ককে আল্লাহর রসুল (দ:) কোন পর্যায়ের গুনাহ, পাপ বোলে আখ্যায়িত কোরছেন। চুরি নয়, হত্যা নয়, ব্যভিচার নয়, বোলছেন- কুফর। যার চেয়ে বড় আর গোনাহ নেই, শুধু তাই নয় যা একজনকে এই দীন থেকেই বহিষ্কৃত কোরে দেয়। এতবড় শাস্তি কেন? শেষ নবীর (দ:) হাদিস থেকেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। তিনি বোলছেন- তোমরা কি জান, ইসলামকে কিসে ধ্বংস কোরবে? এই প্রশ্ন কোরে তিনি নিজেই জবাব দিচ্ছেন- শিক্ষিতদের ভুল, মোনাফেকদের বিতর্ক এবং নেতাদের ভুল ফতোয়া। যে কাজ ইসলামকেই ধ্বংস কোরে দেয় সে কাজের চেয়ে বড় গোনাহ আর কি হোতে পারে! তাই বিশ্বনবী (দ:) এই কাজকে কুফ্রি বোলে সঠিক কথাই বোলছেন।
এই জাতির মহা দুর্ভাগ্য। আল্লাহর ও তাঁর রসুলের (দ:) এতসব কঠোর সতর্কবাণী এই উম্মাহর পণ্ডিতদের কিছুই মনে রোইল না। তারা সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম কোরে কোর’আন-হাদীসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ কোরে এক বিরাট ফিকাহ শাস্ত্র গড়ে তুললেন। এদের মণীষার, প্রতিভার, অধ্যবসায়ের কথা চিন্তা কোরলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হোয়ে আসে, কিন্তু তাদের ঐ কাজের ফলে এই উম্মাহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হোয়ে ধ্বংস হোয়ে গেলো। শত্র“র কাছে পরাজিত হোয়ে গেলো।
ফিকাহর যে অতি বিশ্লেষণ করা হোয়েছে তার পক্ষে একটি যুক্তি আছে এবং সে যুক্তি আমি সম্পূর্ণ স্বীকার কোরি। সেটা হোচ্ছে ইসলামের আইন-কানুনের বিচারালয়ে ব্যবহার। অর্থাৎ বিচারালয়ে এই আইনের সূক্ষ্ম প্রয়োগ যাতে কোনো নিরাপরাধ শাস্তি না পায়। অনৈসলামিক যেসব আইন বর্তমানে পৃথিবীতে চালু আছে, অর্থাৎ মানুষ-রচিত আইনগুলি, এগুলিও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ কোরেই বিচরালয়গুলিতে বিচার করা হয়- উদ্দেশ্য সেই একই- সুবিচার। কিন্তু সে জন্য কোন দেশেই জ্ঞানের অন্যান্য সমস্ত শাখাকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা কোরে সেই দেশের সংবিধানের এবং আইনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক কোরে দেয়া হয় নি। শুধু যারা আইনজ্ঞ হোতে চান, আইনজীবী হোতে চান তারা স্ব-ইচ্ছায় ঐ বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেন, ডিগ্রী নেন এবং তারপর আদালতে যোগ দেন। অর্থাৎ চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য, শিক্ষা, সাংবাদিকতা ইত্যাদির মতো আইনকেও একটি বিশেষ (ঝঢ়বপরধষরংবফ) জ্ঞান হিসাবে শিক্ষা করেন। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় পণ্ডিতরা তা না কোরে জাতির মধ্যে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি কোরে দিলেন যে আইনজ্ঞ হওয়াই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ, জ্ঞানের অন্যান্য শাখা শিক্ষা করার কোনো প্রয়োজন এ জাতির নেই। এই কাজের আবশ্যম্ভাবী পরিণতি যা হবার তাই হোল, জাতি জ্ঞানের অন্যান্য শাখাসমূহে যে বিস্ময়কর জ্ঞানচর্চা কোরে পৃথিবীর শিক্ষকের আসন লাভ কোরেছিলো তা ছেড়ে দিয়ে একটি মুর্খ, অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হোল। উদাহরণরূপে বলা যায় যে, আজকের কোনো রাষ্ট্রে যদি শিক্ষা নীতি এই করা হয় যে, সেই রাষ্ট্রের সংবিধান ও ঐ সংবিধান নিসৃতঃ আইন-কানুন ও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই একমাত্র শিক্ষার বিষয়বস্তু হবে, বর্তমানের মাদ্রাসা শিক্ষার মতো, তবে কী হবে? নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তাহলে বিদ্যালয়গুলিতে নিচু ও প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই ঐ বিষয় একমাত্র পাঠ্যবিষয় করা হবে। দু’এক প্রজন্মের মধ্যেই ঐ রাষ্ট্রের লোকজন শুধু তাদের দেশের সংবিধান ও আইন-কানুনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া আর কিছুই জানবে না, অন্যান্য সব বিষয়ে অজ্ঞ হোয়ে যাবে। জাতির যা ভাগ্য হওয়া উচিত তাই হোল- অন্য জাতির কাছে পরাজিত হোয়ে যে সংবিধান ও আইন-কানুন নিয়ে এত বিশ্লেষণ করা, সেই আইন-কানুন বাদ দিয়ে বিজয়ী জাতির আইন-কানুন গ্রহণ করা হোল। নিজেদের আইন-কানুন সংবিধান শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো রকমে টিকে রোইল। যে আইন শিক্ষাকেই একমাত্র শিক্ষণীয় বোলে ঘোষণা করা হোল, মোসলেম দুনিয়াতে আজ সেই আইনে বিচার হয় না, বিচার হয় পাশ্চাত্যের মানুষের তৈরি, গায়রুল্লাহর আইনে, দণ্ড হয় পাশ্চাত্যের দণ্ডবিধি মোতাবেক অর্থনীতি পরিচালিত হয় পাশ্চাত্যের সুদভিত্তিক অর্থনীতি মোতাবেক। অথচ এ সবই ফিকাহ শাস্ত্রের আওতাধীন। তবুও এদের মাদ্রাসগুলিতে অন্ধের মত এগুলো পড়িয়ে যাওয়া হোচ্ছে, শিক্ষা দেয়া হোচ্ছে। যে আইনের প্রয়োগই নেই সেই আইনই শিক্ষা দেয়া হোচ্ছে, পরীক্ষা নেয়া হোচ্ছে। কী নিষ্ঠুর পরিহাস! অতি বড় সুন্দরী না পায় বর, অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর। তাই আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ:) বারবার সতর্ক কোরে দিয়েছেন দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য। কাউকে বাড়াবাড়ি কোরতে দেখলেই রাগে বিশ্বনবীর (দ:) পবিত্র মুখ লাল হোয়ে যেতো। কারণ তিনি জানতেন যে, অতি বড় সুন্দরী ও অতি বড় ঘরনীর মত অতি বড় মোসলেম না পায় দুনিয়া না পায় জান্নাত।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...