যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে:
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে পবিত্র হজ্ব একটি। প্রতি বছর জেলহজ মাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ আরাফার ময়দানে সমবেত হন, আল্লাহর পবিত্র গৃহ তওয়াফ করেন। তারা সেখানে লাখ লাখ টাকা খরচ কোরে যান, তাদের বেশির ভাগই বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষ। তাদের বিশ্বাস এই হজ্ব তাদের সারা জীবনের করা সকল পাপকে ধুয়ে মুছে সাফ কোরে দেবে, তাদের আমলনামা হোয়ে যাবে শিশুর মতো নিষ্কলুষ। কিন্তু যে বিষয়টি কেবল হজের বেলাতেই নয়, সকল কাজের ক্ষেত্রেই পূর্বশর্ত সেটি হোচ্ছে সেই কাজটি কেন করা হোচ্ছে, সেটার উদ্দেশ্য কী সেটা জানা। কোন বস্তু বা বিষয়ের উদ্দেশ্য কী, সেটা দিয়ে কী হয় তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা কে বলা হয় আকিদা। যেমন একটি ঘড়ি দিয়ে কী হয় সেটাই যে জানে না, তাকে কেউ যদি একটি স্বর্ণের ঘড়িও উপহার দেয় সেটা তার কোনই কাজে লাগবে না, সেটা দিয়ে সে সময় দেখতে পারবে না। ইসলামের ছোটখাটো প্রতিটি বিষয়েই এই দীনের আলেমদের মধ্যে, ফকীহদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও তারা প্রত্যেকেই এই বিষয়ে একমত যে, আকিদা ঠিক না হোলে ঈমানের কোন দাম নেই। আর ঈমানেরই যদি দাম না থাকে, তাহোলে ঈমান ভিত্তিক সব আমল অর্থাৎ সালাহ, সওম, হজ্ব কোন কিছুরই কোন দাম থাকে না। তাই হজ্বে যাওয়ার আগে প্রথমেই জানতে হবে হজ্ব কেন, এর উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্যই যদি ঠিক না হয়, তাহোলে হজ্বের আহকাম যতো নিখুঁতভাবেই পালন করা হোক না কেন, সব অর্থহীন।
ইসলামের আর সব কাজের মতো আজ হজ্ব সম্বন্ধেও এই জাতির আকিদা বিকৃত হোয়ে গেছে। এই বিকৃত আকিদায় হজ্ব আজ সম্পূর্ণরূপে একটি আধ্যাত্মিক ব্যাপার, আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করার পথ। প্রথম প্রশ্ন হোচ্ছে- আল্লাহ সর্বত্র আছেন, সৃষ্টির প্রতি অণু-পরামাণুতে আছেন, তবে তাঁকে ডাকতে, তার সান্নিধ্যের জন্য এত কষ্ট কোরে দূরে যেতে হবে কেন? তার নিজের আত্মা তিনি মানুষের দেহের মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন (সুরা আল-হিজর ২৯)। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের মধ্যে তিনি রোয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বোলেছেন-নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অতি সন্নিকটে (সুরা বাকারা ১৮৬, সুরা সাবা ৫০, সুরা ওয়াকেয়াহ ৮৫)। তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে বোলছেন- আমি (মানুষের) গলার রগের (রক্তবাহী ধমনীর) চেয়েও সন্নিকটে (সুরা কাফ ১৬)। যিনি শুধু অতি সন্নিকটেই নয়, একবারে গলার রগের চেয়েও নিকটে তাকে ডাকতে, তার সান্নিধ্যের আশায় এতো দূরে এতো কষ্ট কোরে যেতে হবে কেন? যদি তর্ক করেন যে আল্লাহ চান যে আমরা তার ঘরে যাই, তবে জবাব হোচ্ছে প্রথমতঃ ঘরের মালিকই যখন সঙ্গে আছেন তখন বহু দূরে তার পাথরের ঘরে যাবার কী প্রয়োজন আছে, দ্বিতীয়তঃ আসল হজ্ব হয় আরাফাতের ময়দানে, আল্লাহর ঘর কা’বায় নয়। তার ঘর দেখানোই যদি উদ্দেশ্য হোয়ে থাকে তবে কা’বাকে হজ্বের আসল কেন্দ্র না কোরে কা’বা থেকে অনেক দূরে এক খোলা মাঠকে কেন্দ্র কোরলেন কেন? তৃতীয় প্রশ্ন হোচ্ছে- ধোরে নিলাম আল্লাহ আরাফাতের ময়দানেই বোসে আছেন। সেখানে যেয়ে তার সামনে আমাদের উপস্থিত হবার জন্য তিনি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত কোরে দিয়েছেন কেন? আমাদের সঙ্গে না থেকে তিনি যদি আরাফাতের মাঠেই থেকে থাকেন তবে যে যখন পারে তখন সেখানে যেয়ে তো তার সামনে লাব্বায়েক বোলে হাজিরা দিতে পারে। তা না কোরে তিনি আদেশ দিয়েছেন বছরের একটা বিশেষ মাসে, একটা বিশেষ তারিখে তার সামনে হাজির হবার। একা একা যেয়ে তাকে ভালো ভাবে ডাকা যায়, নাকি সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়, অপরিচিত পরিবেশে, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকে ভালো ভাবে, মন নিবিষ্ট কোরে ডাকা যায়? কিন্তু অবশ্য কর্তব্য ফরদ কোরে দিয়েছেন একা একান্তে তাকে ডাকা নয়, ঐ বিশেষ তারিখে লক্ষ লোকের ঠেলাঠেলির মধ্যে।
বলা যায় জামাতে নামাযেরই বৃহত্তম সংস্করণ হজ্ব। এই দীনের সমস্ত জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হোচ্ছে এবাদতের স্থানগুলি অর্থাৎ মসজিদ, কারণ মোসলেমের জীবনের, জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করানো ও পৃথিবীতে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। সুতরাং মোসলেমের জীবনে ইহজীবন ও পরজীবনের, দেহের ও আত্মার কোন বিভক্তি থাকতে পারে না কারণ দেহ থেকে আত্মার পৃথকীকরণ বা আত্মা থেকে দেহ পৃথকীকরণের একটাই মাত্র পরিণতি-মৃত্যু। তাই এই জাতির সমস্ত কর্মকাণ্ড এক অবিচ্ছিন্ন এবাদত। জামাতে নামাযের উদ্দেশ্য হোলো মোসলেম পাঁচবার তাদের স্থানীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদে একত্র হবে, তাদের স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা পরামর্শ কোরবে, সিদ্ধান্ত নেবে, তারপর স্থানীয় এমামের নেতৃত্বে তার সমাধান কোরবে। তারপর সপ্তাহে একদিন বৃহত্তর এলাকায় জামে মসজিদে জুমা’র নামাযে একত্র হোয়ে ঐ একই কাজ কোরবে। তারপর বছরে একবার আরাফাতের মাঠে পৃথিবীর সমস্ত মোসলেমদের নেতৃস্থানীয়রা একত্র হোয়ে জাতির সর্বরকম সমস্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি সর্বরকম সমস্যা, বিষয় নিয়ে আলোচনা কোরবে, পরামর্শ কোরবে, সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায় থেকে ক্রমশঃ বৃহত্তর পর্যায়ে বিকাশ করতে করতে জাতি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু মক্কায় একত্রিত হবে। একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার কী সুন্দর প্রক্রিয়া।
আল্লাহ ও তার রসুল এ অপূর্ব সুন্দর প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট কোরে দিলেও তা এই জাতির ঐক্যকে ধোরে রাখতে পারলো না আকিদার বিকৃতির কারণে। এই দীনের অতি বিশ্লেষণ কোরে, সূক্ষ¥াতিসূক্ষ্ম মসলা-মাসায়েল উদ্ভাবন কোরে জাতিটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কোরে একে এক মৃতপ্রায় জাতিতে পরিণত কোরে দেওয়ার পরও এর সব রকম, অর্থাৎ জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদ ও কা’বাই ছিলো, কারণ তখনও এই দীনকে জাতীয় ও ব্যক্তিতে বিভক্ত করা হয় নি। তারপর যখন ঐ ঐক্যহীন, ছিন্ন-বিছিন্ন জাতিটাকে আক্রমণ কোরে ইউরোপীয় জাতিগুলি দাসে পরিণত কোরে খণ্ড খণ্ড কোরে এক এক জাতি এক এক খণ্ডকে শাসন ও শোষণ করতে শুরু কোরলো তখন ঐ শাসনের সময় জাতির জীবনকে জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে ভাগ করা হোলো অর্থাৎ দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করা হোল এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে জাতি একটি মৃত জনসংখ্যায় পরিণত হোলো। নামায ও হজ্ব হোয়ে গেলো ‘এবাদত’, ব্যক্তিগত উপাসনা, যেখানে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক কোন কিছুর স্থান নেই। আল্লাহর আইন ও দণ্ডবিধির তো কোন প্রশ্নই উঠে না, কারণ সেগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে ইউরোপীয় খ্রিস্টান ইহুদিদের তৈরি আইন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হোলো। ঐ সময় থেকেই দুই এলাহ গ্রহণ করার ফলে এই জাতি কার্যতঃ মোশরেক ও কাফের হোয়ে আছে। যদিও আকিদার বিকৃতির কারণে তা উপলব্ধি করার মতো বোধশক্তিও অবশিষ্ট নেই।
একথা ইতিহাস যে, খোলাফায়ে রাশেদুন হজ্বের সময় বিভিন্ন স্থান থেকে আগত হাজীদের কাছ থেকে তাদের অবস্থা, সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন, সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতেন, তাদের নিজ নিজ এলাকায় শাসন কর্তারা, গভর্নররা কে কেমন ভাবে শাসন করছেন সে সম্বন্ধে তাদের অভিমত ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। হাজীদের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদ ও তাদের সাথে পরামর্শ কোরে গভর্নর বদলি ও প্রশাসকদের মদীনায় তলব কোরে কৈফিয়ৎ চাওয়ার ঘটনাও এই জাতির ইতিহাসে রোয়েছে। কিন্তু বর্তমানের মহা-মোসলেম, মহা-আবেদরা হজে গিয়ে রসুল (দ:), সাহাবা (রা:) ও খলিফাদের মতো রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার, দণ্ড ও এ সব দুনিয়াদারী কাজের কাছ দিয়েও যান না, মসজিদে যাওয়ার মতই চুপচাপ যান, চুপচাপ হজ্ব কোরে চুপচাপ বাড়ি ফিরে আসেন। সমস্ত পৃথিবী থেকে মোসলেমরা এক কেন্দ্রে এসে একত্র হোলেও সেখানে তারা নিজেদের অর্থাৎ এই মহাজাতির জাতীয় কোন সমস্যা নিয়ে পরামর্শ করার মতো দুনিয়াদারীর রাজনীতি করেন না। যে জন্য পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে এত কষ্ট কোরে এত লোককে আল্লাহ একটি মাঠে সমবেত কোরলেন সেই জাতীয় উদ্দেশ্যই আজ হজে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বর্তমানের বিকৃত আকিদার মোসলেমরা, মহা আবেদরা আত্মার উন্নতির জন্য হজ্ব কোরতে যান। চুপচাপ যান, চুপচাপ ফিরে আসেন। অন্যের সমস্যা, অন্যের বিপদে তাদের কী আসে যায়? বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য জাতি দ্বারা মোসলেমরা লাঞ্ছিত হোচ্ছে হোক, মরছে মরুক, বাড়ি ঘর ছাড়া হোচ্ছে হোক, না খেয়ে মরছে মরুক, হাজার হাজার মোসলেম মেয়েরা ধর্ষিতা হোয়ে গর্ভবতী হোচ্ছে, হোক, তাতে হাজীদের কী আসে যায়? তাদের আত্মার ধোয়ামোছা হোলেই হোলো। অথচ বিশ্বনবী (দ:) বোলেছেন- এই জাতিটি একটি শরীরের মত, এর কোথাও ব্যথা হোলে তা সমস্ত শরীরকে অসুস্থ করে [বোখারী, মোসলেম, মেশকাত]। অর্থাৎ পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা এই উম্মাহর যে কোন স্থানে আঘাত লাগলে তা সমস্ত শরীরে অনুভূত হয়। এই জাতির পিতা এই জাতির যে সংজ্ঞা দিলেন সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী আজকের হাজীরা কি তার উম্মতের হাজী? এদের হজ্বের উদ্দেশ্য যেন কেবল নামের আগে ‘আলহাজ্ব’ উপাধি সংযোজন করা।
কোন লোক যদি একটি মহান, বিরাট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সারাজীবন আপ্রাণ চেষ্টা, অবিশ্বাস্য ত্যাগ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি সৃষ্টি করেন, তবে তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় তার সৃষ্ট জাতিটাকে কী উপদেশ দিয়ে যাবেন? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তিনি তার শেষ উপদেশে সেই সব বিষয় উল্লেখ কোরবেন যে সব বিষয়ের উপর তার জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর কোরবে এবং তার অবর্তমানে যে সব বিষয়ে জাতির ভুল ও পথভ্রান্তি হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই নয় কি? বিদায় হজ্বে বিশ্বনবীর ভাষণ মনযোগ দিয়ে পড়লে যে বিষয়টা সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় হোয়ে ওঠে সেটা তার জাতির ঐক্য সম্বন্ধে তার ভয় ও চিন্তা। স্বভাবতঃই কারণ জীবনের সবকিছু কোরবান কোরে অসহনীয় অত্যাচার সহ্য কোরে সারা জীবনের সাধনায় একটি জাতি সৃষ্টি কোরলে এবং সেই জাতির উপর তার আরদ্ধ কাজের ভার ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় একটা মানুষের মনে ঐ ভয়, ঐ শঙ্কাই সবচেয়ে বড় হোয়ে দাঁড়াবে। কারণ ঐক্য ভেঙ্গে গেলেই সবশেষ, জাতি আর তার আরদ্ধ কাজ করতে পারবে না, শত্র“র কাছে পরাজিত হবে। তাই তাকে বিদায় হজ্বের ভাষণে বোলতে শুনি- হে মানুষ সকল! আজকের এই দিন (১০ই জ্বেলহজ্ব), এই মাস (জ্বেলহজ্ব) এই স্থান (মক্কা ও আরাফাত) যেমন পবিত্র, তোমাদের একের জন্য অন্যের প্রাণ, সম্পদ ও ইজ্জত তেমনি পবিত্র (হারাম)। শুধু তাই নয়, এই দিন, এই মাস ও এই স্থানের পবিত্রতা একত্র কোরলে যতখানি পবিত্রতা হয়, তোমাদের একের জন্য অন্যের জান-মাল-ইজ্জত ততোখানি পবিত্র (হারাম)। খবরদার! খবরদার! আমার (ওফাতের) পর তোমরা একে অন্যকে হত্যা কোরে কুফরী করো না। শেষ নবী এই সাবধান বাণী একবার নয়- পুনঃপুনঃ উচ্চারণ কোরলেন এবং শেষে আসমানের দিকে মুখ তুলে বোললেন – হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক- আমি আমার দায়িত্ব পৌঁছে দিলাম। (ইবনে আব্বাস (রা:) এবং ইবনে ওমর (রা:) থেকে- বোখারী)। এখানে লক্ষ্য কোরুন, নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটিকে, অর্থাৎ জাতির ঐক্যকে নষ্ট বা ক্ষতি করাকে শেষ নবী কোন্ শ্রেণির গোনাহের পর্যায়ে ফেলছেন। একেবারে কুফরের পর্যায়ে। আজ বিশ্ব নবীর সেই জাতি, ‘উম্মাহ’ চল্লিশটির বেশি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে, শিয়া-সুন্নীতে, মাজহাবে-মাজহাবে, ফেরকায়-ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তপাত কোরে রসুলাল্লাহ বর্ণিত কুফরের মধ্যে বাস কোরেও প্রতি বছর হজ্ব করতে যাচ্ছে কোথায়? সেই খানে, সেই মাসে এবং সেই দিনে যাদের একত্রিভূত পবিত্রতা ও সম্মান তারা অবিশ্রান্ত ভাবে অপবিত্র করছে এবং তা কোরেও হজ্বের সামান্যতম খুঁটিনাটিও অতি দক্ষতার সাথে পালন কোরে আত্মপ্রীতি লাভ করছে যে তাদের হজ্ব কবুল হয়েছে। তাদের ঐ আশা যে কতখানি হাস্যকর তা বোঝার শক্তিও অবশিষ্ট নেই। আবার সেই ইরাকীর কথা মনে এসে যাচ্ছে যে হজ্বের সময় পোকা-মাকড়-মাছি হঠাৎ মেরে ফেললে কি কাফ্ফারা দিতে হয় সে ফতোয়া জানতে আবদুল্লাহ এবনে ওমরের (রা:) কাছে গিয়েছিলো এবং আব্দাল্লাহ (রা:) বোলেছিলেন- কী হাস্যকর। যে ইরাকীরা রসুলাল্লাহর নয়নের মনি হোসাইনকে (রা:) হত্যা কোরেছে তারা পোকা-মাকড়-মাছি মারা কাফ্ফারার ফতোয়া জানতে চায়। এমনকি এই জাতির পঞ্জিকাটাও আর জাতীয় ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হয় না, শুধু ‘ধর্ম-কর্মের’ ব্যাপারে ওটা কোনমতে টিকে আছে, সব কাজে খ্রিস্টানদের পঞ্জিকা অনুসরণ করা হয়। অন্যদিকে বিদায় হজ্বের ভাষণে যে সব বিষয়ে মহানবী ইঙ্গিত মাত্র করেন নি, সেই সবগুলি অর্থাৎ দাড়ি, টুপি, মোজা, পাজামা, টাখনু, তসবিহ, তাহাজ্জুদ, কুলুখ, যিকর, ছোট খাট সহজ অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুন্নাহ, ডান পা প্রথমে ফেলে মসজিদে ঢোকা, ডান পাশে শোওয়া, নফল নামায, নফল রোজা, মেসওয়াক ইত্যাদি নিয়ে এই জাতি মহাব্যস্ত, ঐগুলি কোরেই তারা ভেবে রেখেছেন জান্নাত এর দরজা তাদের জন্য খুলে রাখা হোয়েছে। হজ্বও তাদের প্রায়ান্ধ দৃষ্টিতে তাই ব্যক্তিগত ‘এবাদত’। তারা চুপচাপ যান, পুংখানুপুংখ ভাবে হজ্বের সমস্ত আ
নুষ্ঠানিকতাগুলো কোরে চুপচাপ যার যার বাড়িতে ফিরে যান। ওখানে হঠাৎ কেউ এ জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক সমস্যার কথা তুললে এই মহা আবেদরা মহাখাপ্পা হোয়ে তাকে থামিয়ে দেন, দরকার হোলে পিটিয়েও থামান।
আজ যে ব্যক্তিগত ‘এবাদতের’ আকিদায় হজ্ব করা হয় তা যে আল্লাহর ও তার রসুলের উদ্দেশ্য নয় তার আর একটা প্রমাণ হোলো মক্কা ও আরাফাতের চারদিক দিয়ে বহু কিলোমিটার জুড়ে একটি এলাকাকে অমোসলেমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। এই নিষিদ্ধ করণের উদ্দেশ্য কী? মোসলেমদের হজ্ব করার দৃশ্য অমোসলেমদের দেখাতে মোসলেমদের ক্ষতি কী? মোসলেমদের জামাতের নামাযের দৃশ্য সাম্যের, মানুষে মানুষের ভ্রাতৃত্বের, ঐক্য ও শৃঙ্খলার এক অপূর্ব দৃশ্য। শুধু নামাযের দৃশ্য দেখেই বহু অমোসলেম মুগ্ধ হোয়ে ইসলাম সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়ে পড়াশোনা কোরে মোসলেম হোয়ে গেছে। তা হোলে এই নিষিদ্ধ করণের কী অর্থ? এক কথায় এর অর্থ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা। যে জাতিটি দুনিয়ার অন্য সবরকম জীবনব্যবস্থা ভেঙ্গে আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত সে জাতির বার্ষিক মহা সম্মেলনে অবশ্যই বহু বিষয়ে আলোচনা, পরামর্শ হবে, সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যেগুলো অতি গোপনীয়। এই গোপনীয়তাকে অমোসলেমদের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য এই সতর্কতা। নইলে যে জীবন-ব্যবস্থা, দীনকে সমস্ত পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেবার কথা সেটার কেন্দ্রস্থলকে আড়াল কোরে রাখার কোন মানে হয় না। হজ্ব যদি জাতীয়, রাজনৈতিক সামরিক ইত্যাদি গোপনীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার না হোতো, শুধু আধ্যাত্মিক, ব্যক্তিগত ব্যাপার হোতো তবে ঐ নিষিদ্ধকরণ উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন।