রাকীব আল হাসান:
সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জোর করে তাদের থেকে শ্রম আদায় করার ইতিহাস মানব সভ্যতায় বহুল আলোচিত, অতি-প্রাচীন একটি বিষয়বস্তু। শ্রমিকদের বঞ্চিত হওয়া, অতঃপর অধিকার আদায়ের জন্য বিক্ষুব্ধ হওয়া, অসন্তোষ সৃষ্টি এবং দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন, কিছু প্রাণক্ষয়, মালিকের পক্ষ থেকে কিছু দাবি পূরণের আশ্বাসলাভ, অতঃপর আবার প্রতারিত ও বঞ্চিত হওয়া– এই চক্রে আবর্তিত হচ্ছে শ্রমিক সমাজ। স্বার্থকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় এ চক্র থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। সঙ্গতভাবেই যে প্রশ্নটি এসে যায়– এইভাবে সভা, সেমিনার, লাল হেডব্যান্ড বেঁধে র্যালী, গলা বিদীর্ণকারী শ্লোগান, টক শো, গণসঙ্গীতের আসর, সরকারি ছুটি ইত্যাদি আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিবস পালন করে শত শত বছরে শ্রমিকদের কতটা অধিকার আদায় হয়েছে, সমাজে তাদের সম্মান কতটুকু বেড়েছে? এইসব আনুষ্ঠানিকতা করে শ্রমিকের মুক্তি আসে নি, আরও হাজার বছর এভাবে এসব করে গেলেও আসার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তাহলে এই বঞ্চনা কি শ্রমিকের নিয়তি? এর কি কোনো শেষ নেই? অতীতকালে এই শ্রমিকদেরকে বলা হতো দাস, গোলাম। এখন দাসের বদলে শ্রমিক, কর্মী এবং এমন আরও সুন্দর সুন্দর সুশীল শব্দ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সুন্দর শব্দের অন্তরালে এখনও সেই ক্রীতদাসের নিপীড়িত প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই নির্যাতিত অবহেলিত শ্রমজীবী মানুষগুলি, তখনই সমাজের শোষক শ্রেণির যাঁতাকলের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে যখন আল্লাহর কোনো নবী-রসুলের দ্বারা ঐ সমাজে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে ফেরাউনের শাসনাধীন বনী ইসরাঈলের কথা বলা যায়। ফেরাউন বনী ইসরাইল গোত্রের লোকদেরকে চরম অবমাননাকর কঠোর পরিশ্রমের কার্যে নিযুক্ত করেছিল। সেই কাজ আদায়ের জন্য তারা বনী ইসরাইলের লোকদের উপরে জঘন্যতম নির্যাতন ও উৎপীড়ন চালাত (সুরা ইব্রাহীম)। বাইবেলের পাতায় পাতায় সেই নির্যাতনের বিবরণ উল্লেখিত আছে। তাদেরকে ফেরাউনের দাসত্ব থেকে উদ্ধার করতেই আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন মুসাকে (আ:)। মানবজাতির স্রষ্টা আল্লাহ। কিসে মানুষ অন্যায় অবিচার শোষণ থেকে বেঁচে একটি শান্তিময় প্রগতিশীল সমাজে বাস করতে পারবে তা সবচেয়ে ভালো কে জানবেন? তিনি বলছেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মতম বিষয়ও জানেন (কোর’আন, সুরা মুল্ক ১৪)। এই কথার কোনো জবাব আছে কি? কী ব্যবস্থা, নিয়ম-কানুন সমাজে প্রতিষ্ঠা করলে মানুষ ‘মানুষ’ হিসাবে তার পূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারবে, বঞ্চিত হবে না এটা সবচেয়ে ভালো জানেন স্রষ্টা আল্লাহ। সেই ব্যবস্থা তিনি যুগে যুগে তার নবী রসুলগণের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে প্রেরণ করেছেন যার ধারাবাহিকতায় শেষ জীবনব্যবস্থা হিসাবে এসেছে মহানবী (দ.) এর উপরে নাজিলকৃত ইসলামের সর্বশেষ সংস্করণটি। সেই জীবনব্যবস্থা কায়েমের ফলে তদানীন্তন অর্ধ-পৃথিবীতে অতুলনীয় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে শান্তি কেমন ছিল?
শেষ নবী মোহাম্মদের (দ.) মাধ্যমে যে শেষ জীবন বিধান স্রষ্টা প্রেরণ করেছিলেন তা মানবজাতির একাংশ গ্রহণ ও সমষ্টিগত জীবনে কার্যকরী করার ফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি অংশ অর্থাৎ নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে কী ফল হয়েছিল তা ইতিহাস। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পূর্ণ নিরাপত্তা যাকে বলে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একজন যুবতী মেয়ে শত শত মাইল পথ একা ভ্রমণ করত, তার মনে কোনো প্রকার ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হতো না। মানুষ রাতে শোওয়ার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, রাস্তায় ধনসম্পদ হারিয়ে ফেললেও তা পরে যেয়ে যথাস্থানে পাওয়া যেত, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আদালতে মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসত না। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে গিয়েছিল। এই স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেত না। শহরে নগরে লোক না পেয়ে মানুষ মরুভূমির অভ্যন্তরে যাকাত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াত। এটি ইতিহাস। মানবরচিত কোনো জীবনব্যবস্থাই এর একটি ভগ্নাংশও মানবজাতিকে উপহার দিতে পারে নি। এই অকল্পনীয় শান্তিময় অবস্থা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? এর একমাত্র কারণ, মানুষ মানব রচিত সকল ব্যবস্থা, বিধান প্রত্যাখ্যান করে তার স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ এবং জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে সামগ্রিকভাবে প্রয়োগ করেছিল অর্থাৎ ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া আর কারও বিধান গ্রহণ করি না’ এই মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করেছিল। সেই জীবন ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করে যতো রকম উপায়েই চেষ্টা প্রচেষ্টা করা হোক মানবসমাজে শান্তি, সঙ্গতি ও শৃঙ্খলা আসবে না, শ্রমখাতেও আসবে না। কারণ, ভুল চিকিৎসা। অর্থাৎ যে অসুখের জন্য যে ঔষধ তা প্রয়োগ না করে রোগীকে সান্ত্বনাসূচক অন্য ঔষধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। রোগীও আরোগ্যের আশায় সেই ঔষধই সেবন করে যাচ্ছে। আসলে রোগ সারানো ডাক্তারের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য নিজের স্বার্থকে সমুন্নত রাখা। এটা রোগী বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না যে, তারা একটি হীন চক্রান্তের শিকার।