শফিকুল আলম উখবাহ্ :
মানুষ এতটাই আত্মাহীন ও আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়েছে যে, যে যাকে যেভাবে পারছে প্রতারণা কোরে, পদপিষ্ঠ করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করছে। আমাদের চারপাশে এমন একটি বিষয় বা জিনিসও অবশিষ্ট নেই যাতে মিথ্যা মিশ্রিত নেই। বাতাস, পানি পর্যন্ত বিষাক্ত হয়ে গেছে। ন্যূনতম মনুষ্যত্ব না থাকায় তারা খাদ্যে বিষ মেশাচ্ছে, ঔষধে পর্যন্ত ভেজাল দিচ্ছে। মানুষ এমন এক দানবে পরিণত হয়েছে যে চার বছরের শিশুও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের ওপর ধনীর বঞ্চনায়, শোষণে, শাসিতের ওপর শাসকের অবিচারে, সরলের ওপর ধুর্তের প্রতারণায় পৃথিবী আজ মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শান্তি রক্ষার জন্য বিভিন্ন সংস্থা তৈরি কোরে, বিভিন্ন নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটার পর একটা আইন কোরে, জীবন-ব্যবস্থা পরিবর্তন করে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না হত্যা, ধর্ষণ, বেকারত্ব, রাজনৈতিক হানাহানি, দারিদ্র্য, সন্ত্রাস ও যুদ্ধের তাণ্ডব। একটি সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না, বরং দিন দিন নতুন নতুন সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মানব সভ্যতার এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, এমন অশান্তি (ফেতনা-Great Tribulation) সৃষ্টি হবে যে মানুষ মাটির উপরে থাকার চাইতে মাটির নিচে থাকাকে বেশী পছন্দ করবে (হাদিস-মুসলিম), মানুষ মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করবে, যে নিহত হবে সে জানবে না কেন সে মরলো, আবার যে হত্যা করবে সেও জানবে না কেন সে হত্যা করলো। হত্যাকারী ও নিহত উভয়েই জাহান্নামে প্রবেশ করবে (হাদিস-মুসলিম)। বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে, ‘মারণাস্ত্র, রোগ এবং ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা প্রচুর হবে [Ruling Your World by Sakyong Mipham, pg. 44] সনাতন ধর্মে এই সময়কে বলা হয়েছে ‘ঘোর কলি।’ দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়া এই নৈরাজ্য ও হানাহানির চূড়ান্ত রূপকেই বাইবেলে বলা হয়েছে( Armageddon, Apocalypse (Revelation 16:12-16) ইত্যাদি। এই সব ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে অনেক বড় বড় বই লেখা হয়েছে, আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে এ বিপদ থেকে উত্তোরণের উপায় কী?
নিশ্চিত ধ্বংসের পথে ধাবমান মানবজাতিকে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ। যিনি মানুষের স্রষ্টা, একমাত্র তিনিই জানেন কিভাবে মানুষ এই অনিবার্য ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারে। সেই উপায়টি হচ্ছে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক সত্যদীন যা রসুলাল্লাহর হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদী অর্ধেক পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে মানবজাতিকে অতুলনীয় শান্তি ও নিরাপত্তার স্বর্ণযুগ উপহার দিয়েছিলো। সেই প্রকৃত ইসলাম গত ১৩০০ বছরের কালপরিক্রমায় বিকৃত হতে হতে বর্তমানে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। তথাকথিত আলেম শ্রেণি এই বিকৃত ইসলামটিকে তাদের রুটি রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছেন। অখণ্ড উম্মতে মোহাম্মদী ফেরকা, মাজহাব, মাসলা মাসায়েল ইত্যাদির কূটতর্ক নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে; আরেকটি অংশ ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষকে ইসলামের বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। জাতির বৃহত্তম অংশটি শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঐ বিকৃত ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা করে যাচ্ছে। এর কোনটাই আল্লাহ, রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়, কেননা ইসলাম শব্দের আক্ষরিক অর্থই শান্তি। অর্থাৎ যারা ইসলামের অনুসারী হবে তারা শান্তিতে থাকবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ঠিক এর বিপরীত।
“এই অশান্তিময় অবস্থা ও আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহকে জীবনের একমাত্র ইলাহ, হুকুমদাতা হিসাবে মেনে নেওয়া ছাড়া আর বিকল্প নাই।” এটাই বাঁচার একমাত্র পথ।
এই পথ যদি আমরা গ্রহণ করি তবে শেষ হবে এই শ্বাসরুদ্ধকর বিশ্বব্যবস্থার। অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে উদিত হবে এক নতুন সভ্যতা। সেই সভ্যতার রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে বিশ্বে থাকবে না কোন মারামারি, অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, এক কথায় অশান্তি। সাদা-কালো, তামাটে সমস্ত বনি আদম হবে একটি জাতি, এক পরিবার। একটি মানুষ ইচ্ছা করলে পৃথিবীর যে কোন স্থানে ভ্রমণ করতে পারবে, কেউ তাকে বাধা দিবে না। পৃথিবীর সকল অনিয়ম দূর হয়ে প্রকৃতির সর্বত্র যেমন শৃঙ্খলা বিরাজিত তেমনি মানবজীবনের সর্ব অঙ্গনে চূড়ান্ত শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল করে আল্লাহ এই জীবন-ব্যবস্থাটি প্রণয়ন করেছেন, তাই এই দীনের এক নাম দীনুল ফেতরাহ বা প্রাকৃতিক দীন। আগুন-পানি ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদানগুলি যেমন পৃথিবীর সকল মানবজাতির জন্য অবশ্য প্রয়োজন এবং সবার উপযোগী, তেমনি এই জীবনব্যবস্থাও পৃথিবীর সর্বত্র প্রযোজ্য, প্রয়োগযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিদায়ক। এজন্যই আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:) এর উপাধি আল্লাহ দিয়েছেন রহমাতাল্লিল আলামীন। তাঁর উপর নাযিলকৃত জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে সমস্ত পৃথিবী হবে আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ। সেই রহমতের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহর রসুল বলছেন, আল্লাহ পৃথিবীকে এমন ন্যায় ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দিবেন ঠিক ইতঃপূর্বে পৃথিবী যেমন অন্যায় ও অশান্তিতে পরিপূর্ণ ছিলো (হাদিস-আবু দাউদ)। কোন দুইজন ব্যক্তির মধ্যেও কোন শত্রুতা থাকবে না (হাদিস-মুসলিম)। ইঞ্জিলে বলা হয়েছে নেকড়ে ও ভেড়া একত্রে বিচরণ করবে (Isaiah 11:6). আর সনাতন ধর্মে একে বলা হচ্ছে সত্যযুগের পুনরাবর্তন (বিষ্ণু পুরাণ)। প্রশ্ন হতে পারে, একদিকে আমরা বলছি ভয়াবহ ধ্বংস অনিবার্য আরেক দিকে জানাচ্ছি নতুন সভ্যতার সুসংবাদ, এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো মানবজাতির সামনে এখন দু’টিই নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। একটি হলো, নিজেদের কাজের ফলে যে ধ্বংস তারা নিজেদের জন্য ডেকে এনেছে তাতে তারা পতিত হবেই – যা কেবল সময়ের ব্যাপার। দ্বিতীয়তঃ এই ধ্বংস থেকে বাঁচার জন্য একটা উপায় আল্লাহ দিয়েছেন, যারা এই উপায়টি গ্রহণ করে নেবে তারা রক্ষা পাবে। আর যারা তা গ্রহণ করবে না তারা স্বাভাবিকভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা বেঁচে যাবে তাদের হাতেই গড়ে উঠবে বর্ণিত শান্তিময় নতুন সভ্যতার পৃথিবী।
পরিশেষে বলতে চাই, জীবনব্যবস্থা (System of life) তো অনেক পরিবর্তন ও প্রয়োগ করে দেখা হলো কিন্তু ফল কি হলো তা এখন সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এখন বাকি আছে চূড়ান্ত ধ্বংস-আর এই ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধারের কথাই আমরা বলছি। তাই অন্ততঃ বাঁচার জন্য আল্লাহর সত্যদীন গ্রহণ করে নিন। মানবজাতিকে বাঁচতে হলে আল্লাহ রসুলের প্রকৃত ইসলাম, সত্যদীন গ্রহণ করতেই হবে, আর তা না হলে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হতেই হবে। এখন শুধু অপেক্ষা।