ডা: জাকারিয়া হাবিব:
আদম (আ:) থেকে শুরু কোরে শেষনবী (সা.) পর্যন্ত আল্লাহ যে জীবন বিধান মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন, স্থান, কাল ভেদে সেগুলোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে প্রভেদ থাকলেও সর্বক্ষণ ভিত্তি থেকেছে একটি মাত্র। সেটা হচ্ছে তওহীদ, একমাত্র প্রভু, একমাত্র বিধাতা (বিধানদাতা) আল্লাহ। যার আদেশ নির্দেশ, আইন-কানুন ছাড়া অন্য কারো আদেশ, নির্দেশ, আইন-কানুন কিছুই না মানা। একেই আল্লাহ কোর’আনে বলছেন দীনুল কাইয়্যেমা। আল্লাহ মানুষের কাছে এইটুকুই মাত্র চান। কারণ তিনি জানেন যে, মানুষ যদি সমষ্টিগতভাবে তিনি ছাড়া অন্য কারো তৈরি আইন কানুন না মানে, শুধু তারই আইন-কানুন মানে তবে শয়তান তার ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্থাৎ মানুষকে দিয়ে অশান্তি, অন্যায় আর রক্তপাত অর্জনে ব্যর্থ হবে এবং মানুষ সুবিচারে, শান্তিতে (ইসলামে) পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে- অর্থাৎ আল্লাহ যা চান। কত সহজ। কাইয়্যেমা শব্দটা এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ চিরন্তন, শাশ্বত, সনাতন। আল্লাহ এই দীনুল কাইয়্যেমার কথা বলে বলছেন- এর বেশি তো আমি আদেশ করি নি (সুরা আল বাইয়েনাহ ৫)। ‘এর বেশি তো আমি আদেশ করি নি’ তিনি বলছেন এই জন্য যে, তিনি জানেন যে, ঐটুকু করলেই অর্থাৎ তার বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান মানুষ না মানলেই মানব জাতির মধ্যে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সামান্য দাবিটুকুই তিনি মানুষের কাছে আদম থেকে আজ পর্যন্ত কোরে আসছেন। পূর্ববর্তী বিকৃত জীবন-ব্যবস্থাগুলিতেও আল্লাহর দাবি ছিল ঐ সহজ সরল দাবি- দীনুল কাইয়্যেমা, তওহীদ। ভারতীয় ধর্মের অনুসারীদের তারা কোন ধর্মে বিশ্বাসী জিজ্ঞাসা করলে তার জবাব দেবেন সনাতন ধর্ম। সনাতন এবং কাইয়্যেমা একার্থবোধক- যা চিরদিন প্রবাহমান, চিরন্তন ও শাশ্বত এবং তা ঐ তওহীদ। এর গুরুত্ব এত বেশি যে একে আল্লাহ আমাদের জন্য শুধু প্রতি সালাতে নয় প্রতি রাকাতে অবশ্য কোরে দিয়েছেন সুরা ফাতেহার মধ্যে। “আমাদের সিরাতাল মুস্তাকীমে চালাও” মুস্তাকীম অর্থ সহজ, সরল ও শাশ্বত।
এইখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এসে যায়, তাহলো আল্লাহ কোর’আনে আমাদের বলে দিলেন যে, আমি তোমাদের একটি ভারসাম্যযুক্ত জাতি বানালাম (সুরা বাকারা ১৪৩)। এই ভারসাম্যের সাথে সিরাতাল মুস্তাকীম ও দীনুল কাইয়্যেমা সংশ্লিষ্ট ও সম্বন্ধ (Related, connceted)। সহজ, সরল চিরন্তন ছাড়াও সিরাতাল মুস্তাকীম শব্দের এক অর্থ হলো, মধ্যবর্তী, মাঝামাঝি- ঐ ভারসাম্যেরই অন্য অর্থ। আল্লামা ইউসুফ আলী এর অনুবাদ করেছেন ১) Straight (সরল) ২) Standard (মাঝামাঝি, মধ্যপন্থী) ৩) Definite (স্থির, নিশ্চিত) Permanent (চিরস্থায়ী শাশ্বত)।
ঝঃধহফধৎফ অর্থটির দিকে লক্ষ্য করুন। এই অর্থ হলো মধ্যবর্তী, মাঝামাঝি, মানে সর্বোৎকৃষ্টও নয়, সর্বনিুও নয়, সেই মধ্যপন্থী, ভারসাম্যযুক্ত। অর্থাৎ দীনুল কাইয়্যেমা, সিরাতাল মুস্তাকীম আল্লাহ আমাদের দিয়ে আসছেন মানুষ সৃষ্টির প্রথম থেকে যা হচ্ছে- ১) অত্যন্ত সহজ ও সরল, ২) মধ্যপন্থী ৩) চিরস্থায়ী শাশ্বত। এবং যে জাতি একে গ্রহণ করবে সে জাতি হবে ভারসাম্যযুক্ত (উম্মাতাও ওয়াসাতা)। একটা জাতির মধ্যে জ্ঞানী, চালাক, বোকা, সর্ব রকম মানুষই থাকবে, সব নিয়েই একটি জাতি। সুতরাং লক্ষ্য যদি জটিল হয় তবে সবার তা বোধগম্য হবে না। জাতির যে অংশটুকু শিক্ষিত ও মেধাবী, শুধু তাদেরই বোধগম্য হবে- সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হয়ে ঐ লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম করতে পারবে না। তাই আল্লাহ ও তার রসুল (সা.) যে জাতি সৃষ্টি করলেন তার ভিত্তি করলেন অতি সহজ ও সরল-তওহীদ, একমাত্র প্রভু হিসাবে তাকেই স্বীকার কোরে নেওয়া। এর নাম দিলেন দীনুল কাইয়্যেমা ও সিরাতাল মুস্তাকীম, চিরন্তন, সহজ সরল পথ। এটাই যে সব কিছু তা বোঝাবার জন্য অবশ্য কর্তব্য (ফরজ) কোরে দিলেন প্রতি রাকাতে ঐ সিরাতাল মুস্তাকীমে চালাবার প্রার্থনা করা, যাতে প্রতিটি মুসলিমের সর্বক্ষণ এ সহজ সরল পথের কথা মনে থাকে এবং ঐ সহজ সরলতার ভিত্তি ছেড়ে জটিলতার দিকে সরে না যায়। এবং জাতির লক্ষ্যও স্থির কোরে দিলেন অতি সহজ ও সরল-ঐ দীনুল কাইয়্যেমাকে, সিরাতাল মুস্তাকীমকে সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরে পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করা। দুটোই বুঝতে সহজ। সহজ বলেই বিশ্বনবীর (সা.) সৃষ্ট অত্যন্ত অশিক্ষিত জাতিটি, যার মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা-যেতো তারাও ভিত্তি ও লক্ষ্য পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা থেকে চ্যুত হন নি এবং তারা সফলভাবে আল্লাহ রসুলের (সা.) উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে বহু দূর অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু অতি বিশ্লেষণের বিষময় ফলে ঐ দীনুল কাইয়্যেমা, সিরাতাল মুস্তাকীম হয়ে গেলো অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য এক জীবন-বিধান, যেটা সম্পূর্ণ শিক্ষা করাই মানুষের এক জীবনের মধ্যে সম্ভব নয়- সেটাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তো বহু দূরের কথা। জাতি লক্ষ্যচ্যুত তো আগেই হয়ে গিয়েছিল, তারপর ফকিহ ও মুফাস্সিরদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে জাতির মধ্যে ভয়াবহ বিভেদ সৃষ্টি হয়ে, বিভিন্ন মাজহাব ও ফেরকা সৃষ্টি হয়ে যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো তার ফলে পুনরায় একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেলো। এই জন্য রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছিলেন আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর।
অতি বিশ্লেষণ কোরে দীনের প্রাণশক্তি বিনষ্ট কোরে দেওয়ার কাজটা নতুন নয়. আমাদের পণ্ডিতরাই শুধু এ কাজ করেন নি। পূর্ববর্তী দীনগুলোতেও অতি-ধার্মিকরা গজিয়েছেন ও পাণ্ডিত্য জাহির কোরে তাদের দীনগুলোকে ধ্বংস কোরে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোর’আনে একটি উদাহরণ দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন তার নবী মূসার (আ:) জীবনী থেকে যেখানে আল্লাহ বনী ইসরাইলদের একটি গরু কোরবানি করতে আদেশ দিলেন। মূসা (আ:) যখন এই কোরবানির আদেশ বনী ইসরাইলদের জানিয়ে দিলেন তখন যদি তারা মোটামুটি ভালো একটি গরু এনে কোরবানি কোরে দিতো তাহলে তাতেই কাজ হয়ে যেত। কারণ কোরবানির গরুটা কেমন হবে সে সম্বন্ধে আল্লাহ কোন শর্ত দেন নি। কিন্তু আল্লাহ কোর’আনে বলছেন- বনী ইসরাইল তা করে নি। তারা মুসার (আ:) মাধ্যমে আল্লাহকে প্রশ্ন করতে লাগলো- গরুটার বয়স কত হবে, গায়ের রং কী হবে, সেটা জমি চাষের জন্য শিক্ষিত কিনা, জমিতে পানি দেয়ার জন্য শিক্ষিত কিনা, ওটার গায়ে কোন খুঁত থাকতে পারবে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি । তারা প্রশ্ন কোরে যেতে লাগলো আর আল্লাহ তাদের প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। তারপর যখন প্রশ্ন করার মতো আর কিছুই রইল না তখন স্বভাবতঃই ঠিক অমন একটি গরু পাওয়া দূরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। একটা সহজ সরল আদেশ- “একটা গরু কোরবানি করো” এটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এমন কঠিন কোরে ফেলা হলো যে, অমন গরু আর পাওয়া যায় না। এই জাতির মহা পণ্ডিতরাও বিশ্বনবীর (সা.) ওফাতের ৬০/৭০ বছর পর ঠিক ঐ কাজটাই মহা ধুমধামের সাথে আরম্ভ করলেন। দু’টি মাত্র আদেশ- আমাকে ছাড়া কাউকে মানবে না আমার দেয়া জীবন-বিধান ছাড়া আর কোন বিধান মানবে না, আর এই জীবন-বিধানকে সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করবে। সহজ, সরল দু’টি আদেশ। বিশ্বনবীর (সা.) উম্মাহ ইস্পাতের মতো কঠিন ঐক্য নিয়ে ঐ কাজ করতে আরব থেকে বের হয়ে অবিশ্বাস্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। পূর্ববর্তী দীনের পণ্ডিতদের মতো এ উম্মাহর পণ্ডিতরাও একে ধ্বংস কোরে দিলেন।