রুম্মানা খানম কণিকা:
সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদানকে উল্লেখ না করে কোনো উপায় নেই। অধিকাংশ মহৎ কাজের স্বীকৃতি ও পুরস্কার পুরুষ সগৌরবে গ্রহণ করলেও তার সাফল্যের জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে নীরবে কাজ করে গেছে কোনো না কোনো নারী, অন্ধ সমাজের দৃষ্টি খুব কমই সেই নারীর দিকে আকৃষ্ট হয়। নজরুল লিখেছেন:
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।
কোনো স্বীকৃতি তো নেইই- উল্টো আজকের এই সভ্যতার মুখোস পরা সমাজে নারীরা পদে পদে হচ্ছেন নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। আজকের সমাজ যেন ১৪০০ বছর আগের আরবের সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। সে সময় অনেকে সদ্যজাত কন্যা শিশুকে মাটিচাপা দিয়ে দিত। পিতা-মাতার সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার স্বীকৃত ছিল না। নারীর চরম অবমাননার এই যুগে ইসলাম এসেছিল নারীর মুক্তির বার্তা নিয়ে। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রের সর্বত্র নারীর অবাধ বিচরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম যা আজ থেকে এক শতাব্দী আগে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও ছিল অচিন্ত্যনীয়। আল্লাহ তাঁর কাছে যে জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছিলেন সেটা বাস্তবায়নের ফলেই অর্ধ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চূড়ান্ত ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা ও অনাবিল শান্তি। তবে সেই ইসলাম আর আজকের ইসলাম এক নয়। এ কারণে তার ফলও সম্পূর্ণ বিপরীত, চরম অশান্তি।
নারী সৃষ্টিগতভাবে শান্তির আধার:
নারী ও পুরুষ উভয়কেই আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে সৃষ্টি করলেও তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পৃথক। আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পর জান্নাতের অঢেল সুখ ও শান্তিময় পরিবেশে বসবাস করতে দিলেন। সেখানে তাঁর ছিল যেখানে খুশি যাওয়ার, যা খুশি খাওয়ার, যা খুশি করার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কিন্তু জান্নাতের এত সুখ-সম্ভোগ ও রঙ-রূপ-রসও তাঁকে আনন্দ দিতে পারছিল না, সব কিছু অর্থহীন, বিবর্ণ, নিরস মনে হচ্ছিল। তখন আল্লাহ তাঁরই পাঁজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন তাঁর সঙ্গিনী এবং সাহায্যকারী হাওয়াকে (বাইবেল- জেনেসিস ২:২২)। মা হাওয়াকে পেয়ে শান্তির সুধারসে আদমের হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেল। এরপর আল্লাহর একটি হুকুম অমান্য করায় আল্লাহ তাঁদের উভয়কে শাস্তি-স্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। শাস্তি হলো, পুরুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে পরিবারের ভরণপোষণ করবে আর নারী গর্ভযাতনা সহ্য করবে, সন্তান লালন পালন করবে (বাইবেল- জেনেসিস ৩:১৬-১৭)। আর আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সঙ্গী হিসাবে তার পাশে থাকবে। অর্থাৎ আল্লাহ নারীকে সৃষ্টিই করেছেন রহমত, বরকত ও নেয়ামত হিসাবে। তিনি বলেছেন, “আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ কর এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া।” (আর-রূম ৩০:২১) আর আল্লাহর রসুল বলেছেন, সমগ্র পৃথিবী আল্লাহর নেয়ামত আর সম্পদরাশিতে পূর্ণ এবং সেই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে মঙ্গলময় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ও নেয়ামত হচ্ছে সেই স্ত্রী যে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সদা সতর্ক (সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড ৩৪৫৬)। সুতরাং যে কর্মকাণ্ডে নারী নেই সেটা প্রাণহীন। তাদের আগমনেই মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন শান্তিময় হয়ে উঠবে।
আদমের (আ.) পর থেকে পৃথিবীতে যখন মানুষের বিস্তার হলো আল্লাহ তাদের শান্তিতে জীবনযাপনের জন্য নবী রসুলদের মাধ্যমে তাঁর বিধান পাঠাতে থাকলেন। সেই বিধানগুলি মানুষ যখন মেনে চোলত তাদের সমাজে অনাবিল শান্তি বিরাজ করত। কিন্তু নবীদের প্রস্থানের পর একটি শ্রেণির জন্ম হয়েছে প্রতিটি জাতির মধ্যে যারা ঐ বিধানের অর্থাৎ ধর্মের ধারক বাহক সেজে বসেছে। তারা নিজেদের পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর বিধানকে বিকৃত করে ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। ফলে ধর্মই হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কল। সেই বিকৃত বিধানের ফলে সমাজের শান্তিময় পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। কোমলমতি নারীরা স্বভাবতই সামাজিক নিষ্ঠুরতার প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছে।
দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’র বস্তুবাদী জীবনের আকর্ষণ, সম-অধিকার, স্বাধীনতা জাতীয় প্রহেলিকামূলক মতবাদ, আর্থিক উৎকর্ষের পেছনে ছুটে ছুটে আমাদের নারী সমাজের বড় একটি অংশও তাদের সৃষ্টিগত আত্মিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছেন, তাদের সৌন্দর্য, করুণা, দয়া-মায়া, শিষ্টাচার, নম্রতা, লাজ-লজ্জা সবই প্রায় খুইয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ øেহবঞ্চিত নিরাশ্রয় নারীকে রুজি রোজগারের জন্য কঠোর পরিশ্রমের কাজের দিকে, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার দিকে ঠেলে দেয়। আমাদের গ্রাম বাংলার অনেক নারী কৃষিক্ষেত্রে দিনমজুরী করছেন। একজন পুরুষ দিনমজুর সারাদিন রৌদ্রে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যে পরিশ্রমের কাজগুলি করেন একজন নারী দিনমজুরও সমান পরিশ্রমের কাজ করেন। তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নারী হিসাবে তাদের যে জীবন প্রাপ্য ছিল তা থেকেও বঞ্চিত। পাশাপাশি পুরুষালি কাজগুলি করে তারা তাদের নারীসুলভ চারিত্রিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যও হারাচ্ছেন।