আজ পৃথিবীতে মুসলিম বলে পরিচিত যে বিশাল জনসংখ্যাটি আছে সেটার করুণ অবস্থা কারও অজানা নেই। জাতিতে জাতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই জনসংখ্যাটি পৃথিবীর সর্বত্র পরাজিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, নিগৃহীত, শোষিত। এটি অন্য জাতিগুলোর অবজ্ঞার পাত্র, সর্বত্র ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত। অথচ যে তেল না হলে বর্তমান সভ্যতা অচল তার শতকরা ৬০ ভাগ, যে গ্যাস না হলে পৃথিবী চলবে না তার শতকরা ৪০ ভাগই এই জাতির হাতে। এ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য খনিজ সম্পদেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মালিক এরা। সংখ্যায় দেড়শ’ কোটির বেশি হয়েও পৃথিবীর এত প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হয়েও এটির এই করুণ অবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এই অবস্থা হওয়া সত্ত্বেও এই জনসংখ্যাটির প্রায় সবটাই নিজেদের এই অযৌক্তিক করুণ অবস্থা সম্বন্ধে বে-খেয়াল, অচেতন। এই জনসংখ্যাটির লোকজন স্বাভাবিকভাবেই খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, রুজি-রোজগার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী করছে, আমোদ-প্রমোদ করছে, যেন সবই ঠিক আছে, সবই স্বাভাবিক। তাদের প্রতি অন্যান্য জাতির এই তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, যেন তাদের প্রাপ্য। কোনো অপমানবোধ তাদের নেই। পরাজয়ের কোনো গ্লানি তাদের নেই। তাদের প্রতি অন্যান্য জাতির অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ নেই। অথচ এই জাতিটিকেই সম্বোধন করে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি করে সৃষ্টি করেছি। যে জাতিকে আল্লাহ স্বয়ং এই কথা বলেছেন সেটা আজ পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট জাতি। শুধু তাই নয়, হীনমন্যতায় আপ্লুত হয়ে নিজেদের জীবন-আদর্শ ত্যাগ করে অন্যের জীবন-আদর্শ অনুকরণ করে নিজেরা বহু ভৌগোলিক রাষ্ট্রে (Nation State) বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হয়ে রক্তারক্তিতে ব্যস্ত হয়ে আছে।
এই জাতিটির একটি ক্ষুদ্র অংশ তাদের এই নিদারুণ অবস্থার কারণ সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করছে। এই ক্ষুদ্র অংশের বিভিন্ন চিন্তাবিদরা বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন। কারো মতে শিক্ষার দৈন্যই হচ্ছে এর কারণ। কারো মতে জাতির অনৈক্য এর মূল কারণ, কারো মতে মূল কারণ দারিদ্র্য ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে ঐগুলি কোনোটাই আসল কারণ নয়, ঐগুলি আসল কারণের ফল, পরিণতি মাত্র। এই পরিণামের আসল কারণগুলো আমি বলছি। কিন্তু তার আগে একটি কথা বলে নেয়া দরকার সেটা না বলে নিলে প্রকৃত কারণগুলো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সেটি হলো নিজেদের অতীত সম্বন্ধে অজ্ঞতা বা স্মৃতি লোপ। আল্লাহর প্রতিশ্র“তি মোতাবেক শাস্তি হিসেবে এই জনসংখ্যাটি যখন ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টানদের দাসত্বের শিকল পরলো তখন প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের অতীতের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস বাদ দিয়ে দেওয়া হলো বা সামান্য যেটুকু রাখা হলো তা বিকৃত। কয়েক শতাব্দী এই শিক্ষার ফলে এই জনসংখ্যাটি আজ তার অতীত ইতিহাস বলতে গেলে কিছুই জানে না। বা সামান্য যেটুকু জানে তাও বিকৃত। এই জনসংখ্যাটি তাদের বর্তমান তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, অপমান, লাঞ্ছনার সম্বন্ধে যে নির্লিপ্ত তার কারণ তারা জানে না যে অতীতে তারা কেমন ছিল। তারা তাদের বর্তমান অবস্থা অতীতের সাথে তুলনা করতে পারে না। এই জনসংখ্যাটিকে একজন মানুষ হিসেবে নিয়ে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। মনে করুন বিশাল একটি রাজ্যে একজন পূর্ণ বয়ষ্ক রাজার কোনো কারণে হঠাৎ স্মৃতিলোপ পেল অর্থাৎ তিনি তার অতীত ভুলে গেলেন। তিনি কে, তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন সব ভুলে গেলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে এই রোগকে বলে অ্যামনেশিয়া (Amnesia)। শত্র“রা তাকে ধরে নিয়ে তাদের দাস বানিয়ে রাখল। ফলে রাজা পরিণত হলেন দাসে। তাকে তারা যা শিখালো দাস রাজা তাই শিখলেন। তারা তার ত্র“টি-বিচ্যুতিতে মারধর করতে লাগল, লাথি মারতে লাগল। যেহেতু রাজা তার অতীত ভুলে গেছেন, তিনি যে রাজা তাও তিনি জানেন না। শুধু তার বর্তমান অবস্থা দেখে এবং তাকে যা শেখানো হয়েছে তা থেকে তিনি তার এই অবস্থাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছেন। এই রাজাকে যদি কেউ বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, আপনার অবস্থা এমন কেন? আপনি তো দাস নন, আপনি তো মহারাজাধিরাজ, আপনার তো সবই আছে, বিপুল ধন-রতœ, অগণিত প্রজা, বিরাট সব বাহিনী, হাজার হাজার হাতী ঘোড়া সবই আছে, তবুও আপনি কেন অপমানিত দাসত্বের জীবন যাপন করছেন। যেহেতু রাজার স্মৃতি লোপ পেয়েছে, ওসব কিছু তার মনে নেই তাই এই কথাগুলো শুনে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না। তিনি তার দাসত্বের কাজ-কর্মই চালিয়ে যাবেন। এমনিভাবেই বর্তমানে মুসলিম নামে পরিচিত এই জনসংখ্যাটিকে যখন বলা হয় তোমার বর্তমানে এই অবস্থা কেন? তোমার অতীত তো ছিল গৌরবময়, তখন সেটি ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে থাকে প্রশ্নকারীর দিকে। কাজেই এই জনসংখ্যাটিকে এর বর্তমান করুণ অবস্থার কারণ বোঝাতে গেলে ঐ রাজার মনভাবের অবস্থাই হয়। এর কারণ নিজেদের ইতিহাস সম্বন্ধে অজ্ঞতা। তাদের বর্তমান অবস্থার কারণ বুঝাতে গেলে বাধার সৃষ্টি করে। কাজেই আসল কারণগুলো লেখার আগে এই জনসংখ্যার ইতিহাসটি অতি সংক্ষেপে বলে রাখছি।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আরবের হেরা গুহায় যেদিন মক্কার মোহাম্মদ (সা.) বিন আব্দুল্লাহকে মহান আল্লাহ রেসালাত এবং নবুওয়াত দান করলেন তখন একটি উম্মাহ অর্থাৎ জাতি জন্মগ্রহণ করল তারপর থেকে দীনুল হকের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এটি বড় হতে লাগল। ১৩ বছর পর এই উম্মার নেতার সঙ্গে এই শিশু উম্মাহটি ইয়াসরিব অর্থাৎ মদিনাতুন নবীতে হেযরত করল। সেখানে রসুলের অধীনে থেকে দীনুল হক প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, জেহাদে লিপ্ত রইল। রসুলাল্লাহ তাদেরকে হাতে কলমে শিক্ষা দিলেন যে এই জাতিটির জন্মের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর দেওয়া সত্য জীবনব্যবস্থার অধীনে পুরো মানবজাতিকে নিয়ে আসা যেন মানবজাতি শান্তিতে থাকে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যে পদ্ধতি আল্লাহ দিয়েছেন তা হলো সামরিক। অর্থাৎ যারা আপসে আল্লাহর দীন তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করবে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়ে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে। আল্লাহর রসুলের ঐ জাতিটি মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধেক দুনিয়ায় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন। ফলে ঐ অর্ধেক দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো চূড়ান্ত শান্তি। সামরিক শক্তিতে তারা হলো অপরাজেয়। হাজার বছরের পুরাতন পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীও এই জাতির সামনে ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল। পাশাপাশি উম্মতে মোহাম্মদী জাতি হিসাবে দিন দিন সমৃদ্ধ হতে থাকল। তারা এক পর্যায়ে সর্ববিষয়ে পৃথিবীর সকল জাতির শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি অঙ্গনে তারা নতুন দিগন্তের সূচনা করল। অর্থ-বিত্ত বৈভবে তারা হয়ে দাঁড়ালো সকল জাতির ঈর্ষার পাত্র। এই বিপুল সম্পদ ও পরাক্রম তাদের ভিতরে আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের মনোভাব সৃষ্টি করে দিল। ফলে তারা ভুলে গেল কেন তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তারা জেহাদ ত্যাগ করে অন্যান্য রাজা বাদশাহদের মতোই আমোদ ফুর্তিতে, জীবন উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এর স্বাভাবিক পরিণতিই হলো পতন। একটি বিরাট মহীরুহ একদিনে ঝড়ে উপড়ে যায় না। ভিতরে ভিতরে উঁইপোকা যদি তাকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলে তবুও সে ঐভাবে কয়েক শ’ বছর টিকে থাকে। তারপরে একদিন বড় একটি ঝড় এসে তাকে উপড়ে ফেলে দেয়। তখন মানুষ অবাক হয়ে দেখে যে কী আশ্চর্য! এত বিরাট বটবৃক্ষ ঝড়ে পড়ে গেল! আসলে সেটা মরে গেছে বহু বছর আগেই। তেমনি উম্মতে মোহাম্মদীও প্রকৃত অর্থে মৃত্যুবরণ করেছে যেদিন তারা জেহাদ ছেড়ে দিল সেই দিন। এরপরে কেবল পচন ও পতনের জন্য একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। আল্লাহ এই জাতিকে অন্য জাতির দাসত্ব করার জন্য সৃষ্টি করেন নি। সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে দুনিয়াতে সত্যদীনের মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখার জন্য। তারাই এখন পরিণামদোষে বিজাতির দাসে পরিণত হয়েছে। বুদ্ধিমান শত্র“ শুরুতেই এ জাতিকে তাদের অতীত ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বপ্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করল। ঐতিহ্যগত ভাষা আরবী ও ফারসির সঙ্গে তাদের যোগসূত্র কেটে দিল। কয়েক যুগ ধরে তাদেরকে সর্বপ্রকার শিক্ষাবঞ্চিত করে রাখার পর তারা যখন একটি মূর্খ জাতিতে পরিণত হলো, তখন দু’টি ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থা তাদের উপরে চাপিয়ে দিল। একটি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে তারা নিজেদের তৈরি করা একটি বিকৃত ইসলাম শেখালো। আরেকটি হলো আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সেখানে তাদেরকে শেখানো হলো ইংরেজদের তৈরি করা বিকৃত ইতিহাস যা পড়ে এ জাতি নিজেদের অস্তিত্ব ও অতীত সম্পর্কে নিদারুণ হীনমন্যতায় আপ্লুত হয়ে গেল। এটাই হচ্ছে সেই অ্যামনেশিয়া রোগীর অবস্থা যা শুরুতে বলে এসেছি। এই রোগীকে এখন তার অতীত জানতে হবে, নয়তো এই দাসত্বের জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।