যে দীনের আবির্ভাবে যুগ যুগ ধরে নির্যাতনের শিকার নারীরা মুক্তির পথ পেয়েছে, যে জীবনব্যবস্থা সকল যুগে সবার জন্য উপযোগী, আজকের তথাকথিত প্রগতিশীলরা সেই ব্যবস্থাকেই পুরাতন ও অচল বলে আখ্যায়িত করেন। এর মূল কারণ ইসলামে নারীদের কাজের পরিসীমা ও অধিকার সম্পর্কে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাদের ভুল ব্যাখ্যা। মোসলেম বীরাঙ্গনাদের ইতিহাস আজ চাপা পড়ে গেছে বিকৃত ইসলামের মাসলা মাসায়েলের, ফতোয়ার কেতাবের নিচে। -আয়েশা সিদ্দীকা
পশ্চিমা সমাজ তাদের সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য যত সংঘই করেছে কোনটাই পরিণতিতে সফল হয় নি, কারণ প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতিহীন জীবনব্যবস্থার কারণে এই সমস্যাগুলি উদ্ভূত হয়েছে, তাই এগুলির একমাত্র সমাধান-ঐ প্রাকৃতিক নিয়মেরই পূনঃপ্রতিষ্ঠা। কোন সংঘ, সভা, সমিতি, সেমিনার, সিম্ফোজিয়াম, দিবসপালন, র্যালি, মৌনমিছিল, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেই এগুলির সমাধান করা যায় নি, যাবেও না। নারীরা নিজেদের অধিকার যখন পুরুষের কাছে দাবি করে, তখন সেটাই একটি স্ববিরোধিতা। সকল অধিকারের যিনি দাতা অর্থাৎ আল্লাহ, তিনি তো প্রত্যেকের অধিকার বিধিবদ্ধ করেই রেখেছেন। তাঁকে অগ্রাহ্য করে নারীরা আজ অর্ধনগ্ন হয়ে উপরোক্ত বিবিধ কর্মসূচি পালন করছে আর ইভ-টিজিং বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। তারা নিজেদেরকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করছে আর স্বপ্ন দেখছে কেউ তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে না। আয়াতুল্লাহ খামেনী এ প্রসঙ্গে বোলেছেন, “পাশ্চাত্য নারী-স্বাধীনতার নামে যে ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে, তার উদ্দেশ্য হলো নারীকে নিতান্তই পুরুষের ইন্দ্রিয় বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা।” এই কি স্বাধীনতা, না নারীর জন্য চরমতম অবমাননাকর, নিকৃষ্টতম অবমূল্যায়ন?
পাশ্চাত্যের ইতিহাসে নারী-মর্যাদার কোন নজির না থাকায় তারা বে-নজির অশ্লীলতা ও অসভ্যতার মাধ্যমে তাদের সমাজে নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। অথচ ইসলাম নারীর যে অধিকার ও মর্যাদার স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস ধারণ করে আছে, ধর্মব্যবসায়ী আলেম সমাজ ও পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকরা তা বহু বিকৃত করে দিলেও যতটুকু জানা যায়, তা আমাদেরকে বিষ্মিত করে। যেখানে রসুলাল্লাহর যুগের মেয়েরা সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের সমকক্ষ ভূমিকা পালন করেছে, সেখানে ইসলামের দোহাই দিয়ে আমাদের আলেমরা নারীদেরকে চার দেয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ করে দিয়েছে। প্রকৃত ইসলামের যুগে নারীরা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে মাঠ কাঁপাতো, আর আজকের বিকৃত ইসলামে যে মেয়ে যত অতিকায় বোরকায় নিজেদের আচ্ছাদিত করতে পারে সেই তত বড় দীনদার, পরহেজগার রমণী। সমাজের কল্যাণসাধনে তাই নারীর অবদান সীমিত। উপরন্তু যারা এই বিকৃত ধর্মের বেড়াজাল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেন তারাও আল্লাহর প্রকৃত ইসলামকে বুঝতে না পেরে পাশ্চাত্যের নাযেল করা যৌনতা ও অশ্লীলতাকেই আধুনিকতা ও স্বাধীনতা জ্ঞান করেন। যে ইসলাম এসেছিল সমাজের অধিকারবঞ্চিত, নির্যাতিত, অসহায় নারীদের মুক্তির বারতা নিয়ে, সেই ইসলামের নামেই আজ নারীদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে শুধুমাত্র স্বামীসেবার মধ্যে, জাতি গঠনেও যে নারীর বিপুল পরিমাণ ভূমিকা রাখা সম্ভব তা যেন বর্তমানের বিকৃত ইসলামের কোন আলোচ্য বিষয়ই নয়। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, পুরুষ ও নারীকে তৈরী করা হয়েছে উভয়ের প্রয়োজনের স্বার্থে। সামাজিক বিশৃংখলার জন্যও কেবল নারীকে এককভাবে নারীকে দায়ী করা যাবে না। আদম (আ:) ও মা হাওয়ার শয়তানের প্ররোচনায় প্ররোচিত হওয়াটাকে ইহুদী ও খ্রীস্টধর্মে এককভাবে মা হাওয়াকে দায়ী করা হলেও ইসলামে তাঁদের দু’জনকেই সমান অপরাধী বলা হয়েছে, “শয়তান তাদের দু’জনকেই সেই বৃক্ষের ব্যাপারে পদস্খলন ঘটালো এবং তারা যে স্থানে ছিল সে স্থান থেকে বহিষ্কার করাল” (সূরা বাকারা ৩৬)। তাই মোসলেমরা হাওয়ার নাম নেওয়ার সময় ‘মা হাওয়া’ বলে সম্বোধন করেন, তারা খ্রিস্টানদের মত কেবল ‘ইভ’ বলেন না। আবার কোর’আনের কোন কোন জায়গায় এই অপরাধের জন্য আল্লাহ এককভাবে আদমকেই (আ:) দায়ী করেছেন, যেমন- “আদম স্বীয় প্রভুর নাফরমানী করলো। ফলে সে বিপদগামী হলো (সূরা-তোয়াহা)”। এছাড়াও ইসলাম আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন সমাজের জীবন্ত কন্যা সন্তানকে পুতে ফেলার প্রথাকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এর বিরুদ্ধে চরম ধিক্কার ও নিন্দাবাদ উচ্চারণ করেছে। আল্লাহ বলেছেন, “আর স্মরণ কর সেই সময়টিকে যখন মাটিতে প্রোথিত মেয়েশিশুকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, কি কারণে তাকে হত্যা করা হলো?” (সূরা-আত্ তাকভীর: ৯)। ইসলাম নারীকে সম্মান করতে ও মর্যাদা দিতে নির্দেশ দিয়েছে মেয়ে হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে এবং মা হিসাবে। কন্যা সন্তান জন্মালে তাকে মর্যাদা দেয়ার ব্যাপারে এক হাদীসে রসুলাল্লাহ বোলেছেন, “যে ব্যক্তির কোন কন্যা সন্তান থাকে এবং তাকে সে উত্তম বিদ্যা ও উত্তম আচরণ শেখায়, তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়।” স্ত্রী হিসেবে নারীকে মর্যাদা দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যেন তাদের কাছে তোমরা শান্তি পাও, এবং তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়ার সৃষ্টি করেছেন (সূরা-আর রুম:২১)।” এবং রসুলাল্লাহ বলেছেন,
“পৃথিবীতে যত সম্পদ আছে, তার মধ্যে উৎকৃষ্টতম নেয়ামত হলো মুত্তাকী স্ত্রী। তার দিকে তাকালে স্বামী আনন্দিত হয় এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে স্বামীর মর্যাদা ও সুনাম সংরক্ষণ করে।”
নারীকে মা হিসেবে মর্যাদা দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, “আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের সাথে গর্ভে ধারণ করেছে এবং প্রসব করেছে (সূরা-আরাফ ১৫)।” পাশ্চাত্যের সমাজে যেমন প্রতিটি বিষয়ে নারীকে অবহেলা করা হয়েছে, ঠিক তেমনি ইসলামের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীকে করা হয়েছে সম্মানিত। বিয়ের ক্ষেত্রে কিছু কিছু সমাজে মেয়ে বিয়ে দিতে ছেলেকে মোটা অংকের যৌতুক দিতে হয়। কিন্তু ইসলাম মেয়েদেরকে এতটাই সম্মানিত করেছে যে ছেলে মেয়েকে ন্যায্য দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করতে হয়। যেখানে পাশ্চাত্য সমাজে বিয়ে করার জন্য মেয়েরা ছেলেদের রাজি করাতে হয় সেখানে ইসলামে ছেলে মেয়ের উভয়ের পছন্দের মাধ্যমে বিয়ে হয়। ইসলাম মেয়েদেরকে শুধু জাতির নেতা অর্থাৎ এমামের দায়িত্ব ব্যতিত আর সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার অনুমতি দিয়েছেন।
অথচ এই পশ্চিমা বিশ্ব যাদের ইতিহাসে তো নয়ই, বর্তমানেও যেখানে নারী কেবল ইন্দ্রিয়ভোগের উপাচার, তারা কিনা বলে ইসলাম নারীদের উপর অন্যায় করেছে, তাদের বঞ্চিত করেছে। অথচ ইসলামই উত্তরাধিকার দিয়ে নারীর মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করেছে। জাহেলি আরবে মেয়েদের কোন উত্তরাধিকারত্ব স্বীকারই করতো না, এখনো কিছু কিছু সমাজে নারীর উত্তরাধিকারত্ব স্বীকার করে না।
ইসলাম কিছু ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রেখেছে। যেমন- নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সাক্ষ্যদানের ক্ষেত্রে দু’জন নারীকে একজন পুরুষ সাক্ষীর সমকক্ষ বলা হয়েছে। এই নির্দেশ নারীর মর্যাদার সাথে সম্পর্কযুক্ত না। বরং এ নির্দেশটি দেয়া হয়েছে নারীর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে। যেহেতু সৃষ্টিগতভাবেই নারীর স্মরণশক্তি কম ও তারা চপলমতি তাই সাক্ষীর ক্ষেত্রে দু’জন নারীকে সাক্ষী রাখার কথা বলা হয়েছে যেন একজন ভুলে গেলে আরেকজন মনে করিয়ে দিতে পারে।
যে দীনের আবির্ভাবে যুগ যুগ ধরে নির্যাতনের শিকার নারীরা মুক্তির পথ পেয়েছে, যে জীবনব্যবস্থা সকল যুগে সবার জন্য উপযোগী, আজকের তথাকথিত প্রগতিশীলরা সেই ব্যবস্থাকেই পুরাতন ও অচল বলে আখ্যায়িত করেন। এর মূল কারণ ইসলামে নারীদের কাজের পরিসীমা ও অধিকার সম্পর্কে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাদের ভুল ব্যাখ্যা। মোসলেম বীরাঙ্গনাদের ইতিহাস আজ চাপা পড়ে গেছে বিকৃত ইসলামের মাসলা মাসায়েলের, ফতোয়ার কেতাবের নিচে। প্রচলিত ইসলামের নারী সংক্রান্ত বিধি বিধান দেখে ইসলামে নারীদের অবস্থান মূল্যায়ন করা কিছুতেই সম্ভব না, কারণ আজ পৃথিবীময় যে ইসলামটি চলছে তা আল্লাহর রসুলের আনীত ইসলামের খোলসমাত্র, ভেতরে আত্মায় এটি কেবল বিকৃতই নয় বরং সম্পূর্ণ বিপরিতমুখী। আজকের নারীদের অবস্থা দেখলে কেউ চিন্তাও কোরতে পারবে না যে, এই নারীরাই এক সময় রসুলাল্লাহ (দ:) ও তাঁর আসহাবদের প্রেরণা, উৎসাহ, উদ্দীপনা দিয়ে, নিজ হাতে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত কোরে আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্য রণাঙ্গনে পাঠিয়েছেন। তারা তাদের স্বামী, ভাই, পিতা, সন্তান যেন শহীদ হোতে পারেন সেজন্য আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া কোরেছেন। এবং দোয়া কোরেই থেমে থাকেন নি, যুদ্ধের ময়দান থেকে আহত মোজাহেদদের সরিয়ে এনে সেবা সুশ্র“ষা কোরেছেন, সৈন্যদের অস্ত্র ও পানি সরবরাহ কোরেছেন এমনকি যুদ্ধের প্রয়োজনে নিজেরাই অস্ত্রহাতে আল্লাহর শত্র“র বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কাজেই আজকের ‘পরহেজগার নারী’ আর প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর নারীতে আসমান জমিনের ফারাক।
মহান আল্লাহ অসীম করুণা করে এ যামানার এমাম, এমামুযযামান, The Leader of the time, জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে সেই প্রকৃত ইসলামের আকীদা দান করেছেন, যে ইসলাম তিনি আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:) এর উপর নাযেল করেছিলেন। হাজারো ফেকাহ, মাসলা-মাসায়েল আর তফসীরের নিচে চাপা পড়ে থাকা সেই প্রকৃত ইসলামকে আবার তার অনাবিল রূপে মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন এ যামানার এমাম। আল্লাহর প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে ১৪০০ বছর আগে অর্ধ পৃথিবীতে নারীর যে নিরাপত্তা, মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এনশা’আল্লাহ অচীরেই তা আবার পূনরাবর্তিত হবে। আল্লাহর সত্যদীন এনশা’আল্লাহ হেযবুত তওহীদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এ গ্রহটিকে জান্নাতের একটি ক্ষুদ্রতর সংস্করণে পরিণত করে দেবে।
লেখিকা: শিক্ষার্থী, বিবিএ (২য় বর্ষ)
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এন্ড টেকনোলজি