হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মোরাল পুলিশিং এর নামে জবরদস্তি ইসলামসম্মত নয়

ওবায়দুল হক বাদল:
মোরাল পুলিশিং শব্দটি বর্তমান সময়ের বেশ পরিচিত একটি শব্দ। ‘মব’ এর ন্যায় এটিও আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করেছে সমাজে। সরকার পতনের পর একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সামাজিক মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ করেছি আমরা। ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা হ্রাস পাচ্ছে এবং সেখানে মব ও মোরাল পুলিশিং বেড়েছে।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘবদ্ধ কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দ্বারা মোরাল পুলিশিং এর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। বিশেষ করে রমযান মাসকে কেন্দ্র করে এর মাত্রা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে কিছুটা নিবৃত হতে দেখা যায় ঐ গোষ্ঠীটিকে।

মোরাল পুলিশিং কি?  
গড়ৎধষ চড়ষরংযরহম ইংলিশ শব্দ। গড়ৎধষ  মানে হলো নীতি। মোরাল পুলিশিং (গড়ৎধষ চড়ষরংযরহম) শব্দটি দ্বারা বোঝায় নিজস্ব নীতি-নৈতিকতার ধারণা, অন্য কোন ব্যক্তির ওপর জবরদস্তিমূলক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে। যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা, নিজ ধর্মের নিয়ম-নীতি, মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা বা মানতে বাধ্য করতে বিভিন্নভাবে প্রেসার ক্রিয়েট করেন, জবরদস্তিমূলক আচরণ করেন তখনই তাকে মোরাল পুলিশিং বলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি ধর্মীয় নীতিবোধ থেকে করা হয়। যদিও ইসলাম ধর্মে জোর জবরদস্তিকে হারাম করা হয়েছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে ধর্ম নিয়ে জবরদস্তিই মোরাল পুলিশিং।

মোরাল পুলিশিং এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট 
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মোরাল পুলিশিং এর কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে সমাজের মানুষ ছিল সচেতন। সমাজে অন্যায় ছিলনা বলেই চলে। যদি কেউ কোনো অপরাধ করেও ফেলত তাহলে সে নিজেই অনুতপ্ত হয়ে আদালতে হাজির হয়ে শাস্তি দাবি করত। আর কোনো দুষ্ট লোক কোনো অপরাধ করলে সাধারণ মানুষ তাকে আদালতে সোপর্দ করত। বিচারহীন কোনো মব কিংবা মোরাল পুলিশিং এর কোনো নজির ইসলামের প্রাথমিক যুগে পাওয়া যায় না। গত শতাব্দিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে এর চর্চা শুরু হয়। ইরান, আফগানিস্তান, সৌদি আরবের হাত ধরে বিভিন্ন দেশে এর চর্চা বাড়তে থাকে।

তবে ইসলামী ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব দেশভেদে ভিন্ন। মদ্যপান রোধ, পুরুষ ও মহিলাদের অসামাজিক মেলামেশা, সঙ্গীত বাজানো এবং জনসমক্ষে অশ্লীলতা, ভালোবাসা দিবসের মতো পশ্চিমা রীতিনীতি পালন ও পহেলা বৈশাখের মতো দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা, মুসলিম নারীদের নির্দিষ্ট পোশাকবিধি মেনে চলা এবং মুসলিমদের দৈনিক নামাজে উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি নিশ্চিত করতে কাজ করে এই বাহিনী।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মোরাল পুলিশিং কিভাবে সৃষ্টি হল?
সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করার কুরআনের নির্দেশের ভিত্তিতে নৈতিক সততা প্রচার ও অন্যায় রোধে ১৯৭৬ সালে ইসলামী ধর্মীয় পুলিশ ব্যবস্থা চালু করে সৌদি আরব। যা সরাসরি রাজকীয় আদেশের অধীনে কাজ করত।

১৯৯২ সালের রাব্বানি শাসনামলে আফগানিস্তানে ‘পুণ্য প্রচার’ ও ‘পাপ প্রতিরোধ’ কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর তালেবানরা তা গ্রহণ করে। তারা সৌদি আরবের অনুরূপ একটি সংস্থার আদলে একে সাজায়। তালেবানদের উৎখাতের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০০৩ সালে আফগানিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এটি পুনর্বহাল করেন।

১৯৮৩ সালে ইরানে প্রণীত একটি নতুন আইনে হিজাব না পরার শাস্তি হিসেবে ৭৪ বেত্রাঘাতের নীতি ধার্য করা হয়। যদিও সংস্কারপন্থী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ খাতামির অধীনে জনসমক্ষে পোশাক এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার রাষ্ট্রীয় কঠোরতা হ্রাস পায়। ২০০৫ সালে তার মেয়াদ শেষে দেশটির সুপ্রিম কাউন্সিল ‘সতীত্বের সংস্কৃতি বিকাশের কৌশল’ নামে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করে। আধুনিক মোরাল পুলিশের যাত্রা শুরু মূলত এখান থেকেই।

খাতামির উত্তরসূরি, অতি-রক্ষণশীল মাহমুদ আহমাদিনেজাদের অধীনে নৈতিকতা রক্ষাকারী পুলিশ বা গাশত-ই-এরশাদ গঠিত হয়। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোরাল পুলিশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক হয়। সেসময় সংস্কারপন্থী প্রার্থীরা এই বাহিনী ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার তাদের কঠোর আচরণের ভিডিও বা প্রমাণ সামনে আসলেও মোরাল পুলিশ সরানোর বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এদিকে ২০২৪ সালে নীতি এবং আদর্শ বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় তৈরি করেছে তালেবান। নীতি পুলিশ তারই অংশ। তারা মেয়েদের কাজের পরিসর বন্ধ করেছে। মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে। এখন মেয়েদের চুল কাটা, গান শোনাতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করছে তারা। এই পুলিশিং সিস্টেম সরকার কর্তৃক পরিচালিত। তবে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এমন কোনো সিস্টেম চালু নেই। তবুও একশ্রেণির অতিউৎসাহী মানুষ স্বউদ্যোগে এই কাজ করছেন। যা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে এটি সরকারিভাবে পরিচালিত হলেও অন্যান্য মুসলিম দেশে এমন কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা দেখা যায় না। তথাপিও কিছু গোষ্ঠীকে সংগঠিত হয়ে মোরাল পুলিশিং করতে দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মের নামেই এটি বেশি চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়।

ইরানে মোরাল পুলিশিং প্র্যাকটিস
২০২২ সালে ইরানের নৈতিকতা রক্ষাকারী পুলিশ বা মোরাল পুলিশের হেফাজতে ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যু বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদের সূচনা করে গোটা ইরান জুড়ে। ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানে মোরাল পুলিশ যখন মাহসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করে তখন তার সামনের দিকে চুল হিজাবের বাইরে দৃশ্যমান ছিল বলে অভিযোগ করা হয়। তাকে আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তিনি কোমায় চলে যান এবং তিনি দিন পরে হাসপাতালে মারা যান। তবে পুলিশ তার মৃত্যুর দায় অস্বীকার করে। তবে মাহসা আমিনিই মোরাল পুলিশের বর্বরতার প্রথম শিকার নন। এর প্রথম প্রকাশ্য শিকার জাহরা বানি ইয়াগুব। ২০০৭ সালে ২৭ বছর বয়সী তেহরানের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক জাহরা বানি-ইয়াগুবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিজের বাগদত্তার সাথে একটি পার্কে বসে ছিলেন তিনি। আটকের দুই দিন পর আটক কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান যে, তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মাহসার পরিবারের মতোই জাহরার পরিবার তাদের মেয়ের মৃত্যুর জন্য পুলিশকে দায়ী করে।

মোরাল পুলিশের শিকার হওয়া অসংখ্য নারীদের মধ্যে আরেকজন ছিলেন তেহরান আজাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে পুলিশের একটি পেট্রোল ভ্যান সেই নারীকে রাস্তায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ছাত্রী একটি চলন্ত টহল ভ্যানের সামনে ঝুলে আছেন। কিছু সময় পর ভ্যানটি থেমে গেলেও ওই ছাত্রীর কী হয়েছিল তা এখনো জানা যায়নি।

আফগানিস্তানের মোরাল পুলিশিং প্র্যাকটিস  
আফগানিস্তানে বোরকা ছাড়া রাস্তায় নামলে নারীদের বেত দিয়ে পেটানোর দৃশ্য আমরা ইতোপূর্বে অনেক দেখেছি। সম্প্রতি জাতিসংঘ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে ‘তালেবান নীতি পুলিশ’ নারীদের উপর চরম অত্যাচার চালাচ্ছে। নারীদের উপর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ক্রমশ বাড়ছে।

মেয়েরা কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাড়ির বাইরে বার হতে পারছেন না। বাড়ির বাইরে বার হলেই তাদের নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হচ্ছে। সেই পোশাক পরেও তারা কোনো পার্কে গিয়ে সময় কাটাতে পারছেন না। কারণ, নীতি পুলিশ মনে করে, একাজ ইসলাম-বিরোধী।

নাপিতদের চুল কাটার নির্দিষ্ট নিয়ম বলে দেওয়া হয়েছে। শুধু নারী নয়, পুরুষেরাও যাতে পশ্চিমা কায়দায় চুল না কাটে, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে। পশ্চিমা কায়দায় চুল কাটলে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে।

ভারতে মোরাল পুলিশিং এর প্র্যাকটিস 
ইসলামী দেশগুলোর মতো ভারতেও অল্প-বিস্তর এর প্র্যাকটিস রয়েছে। ২০২২ সালে ভ্যালেন্টাইন দিবসে মুম্বাইয়ের জুহু সৈকতে বসে থাকা মানুষদের বিরক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একদল স্বঘোষিত নৈতিকতা রক্ষক। যেকোনো নারীর সঙ্গে পুরুষকে বসে থাকতে দেখলেই তাদের মাথা চড়ে যাচ্ছিল। এক যুগলকে তারা তাড়া দেয় তখনই বিয়ে করার জন্য। বিবাহিত সেই যুগলকে আবার কেন তাদের সামনে বিয়ে করতে হবে, সেটা নিয়ে গোল বাঁধে। নৈতিকতা রক্ষকদের সঙ্গে ভাড়া করা পুরোহিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের আবার বিয়ে করতে হয়নি কিন্তু হেনস্তার চূড়ান্ত অবস্থায় পড়তে হয়েছিল সেই যুগলকে।

বাংলাদেশে মোরাল পুলিশিং এর প্র্যাকটিস 
বাংলাদেশে এবছর রমজানে দিনের বেলায় খাবারের দোকান খোলা রেখে এবং খাবার খেতে গিয়ে অনেকেই হামলা ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে।

সবশেষ গত বুধবার লক্ষ্মীপুরের একটি ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে দিনের বেলায় রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ায় বৃদ্ধসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করাতে দেখা গেছে। পরবর্তীতে বৃদ্ধের পরিবার সূত্রে জানা যায় তিনি অসুস্থ ছিলেন। ডাক্তারের পক্ষ থেকে তাকে রোজা না রাখার নির্দেশ ছিল। এর আগে, নোয়াখালীর হাতিয়াতেও একদল ব্যক্তিকে পুলিশের মতো বাঁশি বাজাতে বাজাতে গিয়ে খাবারের দোকান বন্ধ করতে এবং হুমকি-ধামকি দিতে দেখা যায়।

বিভিন্ন সময়ে আমরা ভিন্ন মতের ভিন্ন আদর্শের মানুষের আদর্শ প্রচার কাজে বাধা দিতেও দেখি। মোরাল পুলিশিং দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মব কালচার চর্চা শুরু হয়েছে। মাজার, খানকাহ এবং ভিন্ন মতাদর্শীদের বাড়িঘরে হামলা এরই প্রভাব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এছাড়াও সৌদি আরব, পাকিস্তান, কুর্দিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মোরাল পুলিশিং এর প্র্যাকটিস দেখা যায়।
বাংলাদেশে মোরাল পুলিশিং এর পেছনে কারা কাজ করছেন?

প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে যারা মোরাল পুলিশিং করছেন তারা কারা? তারা কি প্রশাসনের লোক যে, এভাবে গিয়ে দোকানপাট বন্ধ করছে, মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে? বেআইনিভাবে এরকম মোরাল পুলিশিং পরিচালনা করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?

এ ধরনের বেশকিছু ঘটনার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যদিও দলগুলো এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

২৮শে ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির শফিকুর রহমান রোজার মাসে দিনের বেলা হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ করাসহ সব ধরনের ‘অশ্লীলতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ নেওয়ার আহ্বান জানান।

এরপর পরই দেশের বিভিন্ন জায়গায় রেস্টুরেন্টে মোরাল পুলিশিং দেখা যায়। সম্প্রতি নোয়াখালীর হাতিয়াতে দল বেঁধে গিয়ে খাবারের দোকান বন্ধ করার যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের গায়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নামে ভেস্ট দেখা গেছে। এছাড়া ভেস্টের পেছনের অংশে দলটির নির্বাচনী প্রতীক ‘হাতপাখা’র ছবিও ছিল।

যদিও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ মোরাল পুুলিশিং এর সাথে তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মোরাল পুলিশের ভিত্তি কতখানি? 
আল্লাহ বলেন, “লা ইকরাহা ফিদ্দীন” অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। ধর্ম পালন জোর-জবরদস্তির বিষয় নয়। জোর-জবরদস্তি করে ইসলামের কাজ হয় না। মানুষ ঈমানি চেতনায় ইসলামের কাজ করে, ধর্ম পালন করে। ঈমানি চেতনা থেকেই মানুষ মানুষকে সৎকাজের আদেশ দিবে অসৎ কজে নিষেধ করবে। তবে কেউ অপরাধ করলে তার জন্য রাষ্ট্রের আইন রয়েছে। অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার অধিকার ইসলা কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো গোষ্ঠীকে দেয় না। আইন হাতে নেয়ার অধিকার ইসলাম কাউকেই দেয় না।

আর ব্যক্তিগত ইবাদত বা ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের ক্ষেত্রে কাউকে জবরদস্তি করার অধিকার আল্লাহ স্বয়ং রসুলকেও (সা.) দেন নি। তিনি নিজেও এমন করেন নি। আসহাবদেরকেও এমনটি করার নির্দেশ দেননি। রসুল (সা.) এর আমলে এবং তার ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলেও এমন কোনো ঘটনা আমরা দেখি না।

আল্লাহ বলেন, “হে মুহাম্মদ, আমি তোমাকে মানুষের নিয়ন্ত্রণকর্তা করে পাঠাইনি। আপনার একমাত্র কাজ আল্লাহর বাণী সরবরাহ করা ।” [সুরা শুরায় আয়াত ৪৮]

এই কারণেই ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আল্লাহর রসুলের (সা.) সময়ে একটা মোরাল পুলিশিং এর ঘটনা আমরা দেখতে পাই না। তবে কেউ কোনো অপরাধ করলে সচেতন জনগণ তাকে আদালতে সোপর্দ করত।

একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, এক লোক প্রচুর মদ খেত এবং মাতলামি করত। তাকে বারবার নিষেধ করার পরও সে মদ খাওয়া ছাড়েনি। পরে লোকজন তাকে ধরে এনে আদালতে সোপর্দ করতে যাচ্ছিল তখন সে দৌড়ে ইবনে উমরের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আল্লাহ রসুল (সা.) এ ঘটনা শোনার পরে তিনি শুধু হেসেছিলেন।

আমরা দেখলাম, সাহাবিরা ঐ লোকের চুল কেটে অপদস্থ করেন নি, কান ধরে উঠবস করান নি। বরং আদালতে সোপর্দ করতে নিয়ে আসছিলেন। তখন যেহেতু পুলিশ বাহিনী ছিল না তাই দায়িত্বটি তারা পালন করেছিল।

আরেকটি আয়াতে আল্লাহ বলেন “(হে মুহাম্মদ), তোমার কাজ শুধু আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া, আর বাকি হিসাব-নিকাশ তো আমার কাজ।” [সুরা রা’দ: আয়াত ৪০]

অপরাধের শাস্তিস্বরূপ আদালত কর্তৃক এক মহিলাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার পানিশমেন্ট দেওয়া হয়েছিল। তার উপর পাথর বর্ষণের এক পর্যায়ে মহিলাটি দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। পরে কিছু লোক তাকে ধরে এনে পাথর মেরে হত্যা করল। আল্লাহর রসুল (সা.) ঘটনা শুনে বললেন, তাকে যেতে দিলে না কেন? সে সহ্য করতে না পেরে পালাচ্ছিল। চিন্তা করুন, একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বেলায়ও কি বললেন আল্লাহর রসুল (সা.)। কতটুকু মানবিক হলে বলা যায় যে, ‘তাকে যেতে দিলে না কেন!’ নিশ্চয়ই তিনি এমনটি বলেছিলেন, ঐ মহিলার অনুশোচনার কথা চিন্তা করে।

বর্তমান সময়ে অতি মুসলিম গোছের কিছু মানুষ কোরআন-হাদিসের ভুল ব্যাখা দাঁড় করিয়ে এই মোরাল পুলিশিং করছে। কিন্তু ইসলাম এসব কাজকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। দীনের কাজে, ইসলামের কাজে মানুষকে উৎসাহিত করা এবং অনুপ্রাণিত করাকে ইসলাম সাপোর্ট করে। কিন্তু প্রেসার ক্রিয়েটকে কখনো সাপোর্ট করে না। এটা বেআইনি।

আল্লাহর দেওয়া দীন, জীবনব্যবস্থা সভ্য জাতি, শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা, আইনের শাসন বলবৎ থাকলে মোরাল পুলিশিং এর নামে মানুষকে হেনস্তা করার সুযোগ থাকবে না। সাধারণত ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে মানুষ মোরাল পুলিশিং করে। কে রোজাদার আর কে রোজা রাখেনি তাকে পেটানো, কে বোরখা পরেনি, তাকে পেটানো, কে প্রকাশ্যে সিগারেট খেয়েছে তাকে হেনস্থা করা এগুলোকে ধর্মান্ধ উগ্রবাদী একটি গোষ্ঠী সমর্থন দিয়ে আসছে।

ইসলামে গণপিটুনি হারাম ও সবচেয়ে বড় গোনাহের কাজ। ইসলাম কোনোভাবেই গণপিটুনিকে সমর্থন করে না।

আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘যারা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে। আর আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হবেন, তাকে লানত (অভিশাপ) করবেন। আর তার জন্য কঠিন আজাব প্রস্তুত করে রাখবেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৯৩)

‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিরাপরাধ মানুষকে হত্যার অপরাধে আল্লাহ তাআলা সব অপরাধীকে এক সঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’

আল্লাহ মোমেনদেরকে কি কি নির্দেশ দিয়েছেন?
আল্লাহ বলেন, হে মোমেনগণ তোমরা সালাহ কায়েম করো। মোমেনগণ তোমাদের জন্য সওম ফরজ করা হলো যেমন করা হয়েছিল পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের উপর। যাকাত ও হজ্জও মোমেনদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। এছাড়াও আল্লাহ মোমেনদের দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ ও কেতালের নির্দেশ দিয়েছেন। দীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে সকল অন্যায়-অত্যাচার নির্মূল করে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই কাজগুলো কি মোমেনরা ব্যক্তিগতভাবে করবে? মোমেন একজন ব্যক্তি, আর মোমেনদের মিলে একটি জাতি বা উম্মাহ। সম্মিলিত জাতির একটি অথরিটি থাকে, সংবিধান থাকে, শাষণব্যবস্থা থাকে, বিচারব্যবস্থা থাকে।

আল্লাহর রসুল (সা.) যখন মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করলেন তখন। তিনি হলেন রাষ্ট্রনায়ক। আল্লাহর দেওয়া বিধান দিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তিনি শাষণব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন। বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছেন। কেউ অপরাধ করলে আল্লাহর আইনে তার বিচার হতো। মোরাল পুলিশিং এর কোনো সুযোগ তখন ছিল না। মানুষ যেমন ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে অপরাধ কম করত। আর অপরাধ করলে তার বিচার নিশ্চিত করা হতো। গণপিটুনি কিংবা ক্রসফায়ারের মতো ঘটনার কোনো নজির পাওয়া যায় না।

গণপিটুনি একটি বিধ্বংসী সংস্কৃতি 
মোরাল পুলিশিংকে আধুনিক ভাষায় গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতিতে গণপিটুনিরও বিস্তার ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানো এবং কাউকে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরে ফেলা এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য মোতাবেক অন্তর্বর্তী সরকারের এই সাত মাসে দেশে অন্তত ১১৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গণপিটুনির পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেমন আছে, নিষ্ঠুর মনস্তত্ব আছে, আছে নানান স্বার্থও। গণপিটুনিতে যতটুকু শাস্তি পাওয়ার কথা তার থেকে বেশি শাস্তি পেয়ে যায় অধিকাংশ সময়। সন্দেহজনকভাবে নির্দোষ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। মানুষ বিচারিক প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হয়।

ইতোপূর্বে পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটাতে আমরা দেখেছি। নোয়াখালীতে মসজিদকে গীর্জা আখ্যা দিয়ে তওহিদী জনতার পরিচয়ে হামলা করে হেযবুত তওহীদের দুই সদস্যকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে, এমন গুজবে দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। সেসময় ছেলেধরা সন্দেহে অন্তত ৭ জনকে পিটিয়ে মারা হয়। রাজধানীতে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম নামে নারীর মৃত্যু আলোড়ন তুলেছিল সারাদেশে। নোয়াখালীতে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে এক তরুণকে পিটিয়ে মারার ঘটনাও কাঁদিয়েছিল সবাইকে। রাজধানীর আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে মারার ঘটনায়ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বিচারহীনতা যেমন গণপিটুনির শিকড়, তেমনি গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনারও কোনো বিচার হয় না।

বিভিন্ন দেশে বিচারিক কার্যক্রমে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার মূল কারণ এটিই। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর দেখা গেল মামলাটা ফলস ছিল, মিথ্যা মামলা ছিল। যার নামে মামলাটা ছিল সে এই অপরাধ করেনি। এই কারণেই অস্ট্রেলিয়ায় মৃত্যুদণ্ড রোহিত করা হয়। একটা অপরাধ প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে দেরি করা হবে। ব্যাপক, অনুসন্ধান ও গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে সত্য ঘটনা উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়। কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন বিনা অপরাধে শাস্তি না পায়।

মোরাল পুলিশিং এর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত কি?
আমার চোখে কোনো একটি বিষয় অপরাধ মনে হলেও আপনার কাছে সেটি অপরাধ নাও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে আপনার আমার চোখে অপরাধ কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে সেটা অপরাধ নয়। সেক্ষেত্রে আপনার আমার সেই অপরাধের বিচার করার অধিকার নেই। যদি সেটা রাষ্ট্রীয় আইনেও অপরাধ হয়ে থাকে তথাপিও। কারণ এর জন্য রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে, বিচারব্যবস্থা রয়েছে।

সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে মানুষকে উপদেশ দেওয়া যেতে পারে। আপনার চোখে একটি কাজকে অনৈতিক মনে হলে আপনি অনুৎসাহিত করতে পারেন। আর যদি কেউ অপরাধ করে থাকে তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহনীকে খবর দিতে পারেন। প্রয়োজনে অপরাধীকে ধরে আইনের কাছে সোপর্দ করতে পারেন। বিক্ষুব্ধ কেউ আইন হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করলে তাকেও নিবৃত করা একজন সচেতন নাগরিকের কাজ। কিন্তু ‘সচেতন নাগরিক’, ‘তওহিদী জনতা’ ইত্যাদির ব্যানারে লোকজন নিয়ে কাউকে হামলা করা, ভার্বাল এবিউস, আইন হাতে তুলে নেওয়া রাষ্ট্রের আইন যেমন সমর্থন করে না তেমনি কোনো ধর্মও সমর্থন করে না। [লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...