পাবনায় আলোচিত সুজন মন্ডল হত্যা মামলার বাদী ও সাক্ষীদের উপর আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় ধারাল অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে হেযবুত তওহীদ। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসাবে করা এই মানববন্ধন থেকে সন্ত্রাসীদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। না হলে কঠিন থেকে কঠিনতর কর্মসূচির ঘোষণার হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।
সোমবার (২০ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ কর্মসূচি পালন করে হেযবুত তওহীদ। এসময় হাজারো নেতাকর্মীদের হাতে প্ল্যাকার্ড আর মুখের প্রতিবাদী স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে প্রোসক্লাব প্রাঙ্গন।
জানা যায়, গত রবিবার সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের চরঘোষপুর এলাকায় রাত সাড়ে আটটার দিকে ২০-২৫ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারাল অস্ত্র নিয়ে সুজন হত্যা মামলার বাদী হেযবুত তওহীদের সাবেক জেলা সভাপতি সেলিম শেখের বাড়ির পার্শ্ববর্তী নফসারের মোড় নামক স্থানে হামলা চালায়। তারা সেখানে উপস্থিত হেযবুত তওহীদের সদস্যদেরকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে কোপাতে থাকে এবং গুলি ছোঁড়ে। এ ঘটনায় হেযবুত তওহীদের অন্তত ১৩ জন সদস্য আহত হয়েছে। তাদেরকে পাবনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।
হামলাটি ২০২২ সালের আলোচিত ‘সুজন হত্যা মামলা’র এজাহারভুক্ত আসামিরা চালিয়েছে বলে হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় নারী বিভাগের সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী, তথ্য সম্পাদক এস এম সামসুল হুদা, ঢাকা মহানগর সভাপতি ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শফিকুল আলম ওখবাহ, ঢাকা মহানগর সহ-সভাপতি আল আমিন সবুজ, নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি আরিফ উদ্দিন, উত্তরা জোনের সভাপতি শহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, “একই সন্ত্রাসীরা একই স্থানে একই সংগঠনের লোকজনের উপর বারবার হামলা করছে, হত্যা করছে, কার্যালয়, বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট করছে, অগ্নিসংযোগ করছে, অথচ আইন আদালতের দ্বারস্থ হয়েও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। এভাবে আর কতদিন চলবে। সব মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করে এরা ক্ষান্ত হবে? সব মানুষগুলোকে খুন করলে প্রশাসন, সরকারের টনক নড়বে? একটি স্বাধীন দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না।”
হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় নারী বিভাগের সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী বলেন, “২০২২ সালের ২৩ আগস্ট পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের চরঘোষপুর কার্যালয়ে একই জায়গায় এই উগ্রবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল। সেদিন রাতে প্রায় ৪০-৫০ জন সন্ত্রাসী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে হেযবুত তওহীদের সদস্য সুজন মণ্ডলকে হত্যা করে। আহত করে আরো ১০ সদস্যকে। সেই মামলার আসামিরা জামিনে বের হয়ে বাদীকে মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা হামলার হুমকি দেয়। ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে কয়েকদিন আগেই থানায় জিডি করা হয়। তারপরেও হামলা ঠেকাকে ব্যর্থ হয় প্রশাসন।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা কেমন দেশে বাস করছি। এটা কেমন দেশ? যেখানে নিরীহ নিরপরাধ মানুষেরও নিরাপত্তা নাই। যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নিরীহ মানুষের উপর হামলা করা হয় সেটা কোনো স্বাধীন দেশ হতে পারে না।”
“সুজন হত্যার ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নিবেদন করেছিলাম, বিষয়টিকে যেন হালকাভাবে না দেখা হয়। যদি সিরিয়াসলি না নেওয়া হয় তাহলে আরো বড় পরিসরে নৃশংসতা চালাবে সন্ত্রাসীরা। তারা আমাদের কথায় গুরুত্ব দেননি বলেই সন্ত্রাসীরা বেপরোয় হয়ে উঠেছে, পার পেয়ে যাচ্ছে। বারবার হামলা চালানোর সাহস পাচ্ছে।” -বলেন তিনি।
“অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে একই কথা বলতে চাই, বিষয়টিকে ছোট করে দেখবেন না। বিগত সরকার যদি এর সঠিক বিচার করত তাহলে আজকের এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত না। এখনো যদি বিচার না হয় তাহলে এই সন্ত্রাসীরা আরো বড় ঘটনা ঘটাবে।
হেযবুত তওহীদের এই নেত্রী বলেন, “একটা স্বাধীন দেশে বাস করে বারবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হবো কিন্তু বিচার পাবো না। এভাবে কতদিন সহ্য করা যায়। আমরা আর সহ্য করব না। এই ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদেও আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা না হলে হেযবুত তওহীদ রাজপথ ছাড়বে না।” -বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।
তথ্য সম্পাদক এস এম সামসুল হুদা বলেন, “প্রতিটি হামলার ঘটনার আগে প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে, থানায় সাধারণ ডায়রি করা হয়েছে। কিন্তু একটি ঘটনাও প্রশাসন রুখতে পারে নি কেন? প্রশাসনের গোয়েন্দা সংস্থা কি ঘুমায়? আমরা সাধারণ মানুষ হয়ে হামলার আশঙ্কা করতে পারি তারা কেন পারে না? -প্রশ্ন রাখেন তিনি।”
তিনি আরো বলেন, “একই জায়গায় একই লোক এতবার নৃশংসতা চালালো অথচ আইনের শাসনের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। হত্যা মামলার বাদীর উপর কিভাবে তারা বারবার হামলা চালানোর সাহস পায়? দেশে কি কোনো সরকার নেই? প্রশাসন নেই? থাকলে আমাদের ক্ষেত্রে কেন এই বৈষম্য? তাহলে দেশ বৈষম্যমুক্ত হলো কিভাবে?”
হুশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, “সুজন হত্যার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। গতকালকের হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় না আনলে সারাদেশে কঠিন থেকে কঠিনতর কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে। বাংলাদেশকে অচল করে দেওয়া হবে।”
ঢাকা মহানগর সভাপতি ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ বলেন, “সুজন হত্যা মামলার আসামিরা জামিনে এসে গত দেড় বছর ধরে শহীদ সুজনের পরিবার ও মামলার বাদীকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। তারা রাজি না হলে নানা হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল সন্ত্রসীরা। এমন একটি ঘটনা ঘটাতে পারে এই আশঙ্কায় কয়েকদিন আগেই প্রশাসনকে অবগত করা হয় এবং জিডি করা হয়। কিন্তু থানা-আদালতের তোয়াক্কা না করে গত রবিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে ২০-২৫ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী সুজন হত্যা মামলায় জামিনে থাকা ওই আসামিদের নেতৃত্বে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারাল অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তারা হেযবুত তওহীদের সদস্যদের এলোপাতাড়ি কোপায় এবং গুলি করে। এ ঘটনায় হেযবুত তওহীদের অন্তত ১৩ জন সদস্য আহত হয়। তারা পাবনা সদর হাসপাতালে কাঁতড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন আইসিইউতে আছে, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ২০২২ সালে এই স্থানে হামলা করেই সুজন মন্ডলকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল এই সন্ত্রাসীরা।”
“এবারো যদি সন্ত্রাসীদের ছাড় দেওয়া হয় তাহলে আমরা ছাড়ব না। আমরা এর শেষ দেখব। এদেশে উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের উত্থান ঘটতে দেওয়া হবে না। হেযবুত তওহীদ এটা মেনে নিবে না। যারা এমন সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে তারা ইসলামের শত্রু, দেশের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
“হেযবুত তওহীদের ২৯ বছর ধরে আইন মান্য করে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। মানবজাতির সামনে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসীরা বারবার আমাদের কর্মীদের উপর হামলা করছে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। আস্কারা পেয়ে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।”
সরকারকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, “আমরা ন্যায় বিচার চাই। উগ্রবাদীদের আস্কারা দিবেন না। বিগত সরকারগুলোর মতো আচরণ করবেন না। চিহ্নিত এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বিচারের আওতায় আনুন। এর বিচার না হলে আরো বড় কর্মসূচির ঘোষণা দিবে বাধ্য হবো আমরা।”
বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, বিগত সরকারের আমলে সুজন হত্যা মামলাটি রাজনৈতিক মামলায় পরিণত করা হয়। ফলে আসামিরা সহজেই জামিনে বেড়িয়ে আসে। এরপর তারা শহীদ সুজন মন্ডলের পরিবার ও মামলার বাদীকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। তারা মামলা চালিয়ে গেলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে আসামিরা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিতে থাকে। গত বছরের ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের পর আইন শৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতির সুযোগে মামলার বাদী সেলিম শেখের বাড়িতে হামলা চালায় তারা। এসময় তারা সেলিম শেখের বাড়ি ও হেযবুত তওহীদের স্থানীয় চরঘোষপুর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাংচুর, লুটপাট করে। সেলিম শেখের বাড়িতে অগ্নিসংযোগও করা হয়।
তারা বলেন, সুজন হত্যা মামলাটি রাজনৈতিক মামলায় পরিণত করার ফলে আসামিরা কোনোভাবেই আইনের আওতায় আসেনি। এভাবে যদি একের পর এক হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর এবং হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে আর তার কোনো বিচার না হয়, তাহলে দেশটা ইরাক সিরিয়া হতে বেশি সময় লাগবে না।
একই জায়গায় একই হামলাকারী আসামিদের দ্বারা বারবার হামলার ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন হেযবুত তওহীদের নেতাকর্মীরা। তারা হামলাকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার এবং এমন ঘটনার পুনারাবৃত্তি যেন আর না ঘটে তার জন্য সরকার ও প্রশাসনের নিকট যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান।
এরআগে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ উপলক্ষে সকাল থেকেই প্রেসক্লাবের সামনে হাজারো নেতাকর্মী জড়ো হতে শুরু করেন। তাদের হাতে বিভিন্ন প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছিল। বেলা ১১টার দিকে মানববন্ধন শুরু হয়। মানবন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এসময় ‘সুজন ভাই রক্ত দিল, আবার তবে হামলা কেন?’, ‘হেযবুত তওহীদের উপর হামলা কেন? জবাব চাই জবাব চাই’, ‘রক্ত দিল আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই’, ‘সুজন ভাইয়ের হত্যাকারীর, বিচার চাই বিচার চাই’, ‘উগ্রবাদের ঠিকানা, বাংলাদেশে হবে না’, ‘এক সুজন লুকান্তরে, লক্ষ সুজন ঘরে ঘরে’, ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিবাদী স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ।
উল্লেখ্য, গত ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট রাতে একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্র দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে হেযবুত তওহীদের পাবনা স্থানীয় কার্যালয়ে হামলা চালায়। এতে হেযবুত তওহীদের ১০ সদস্য আহত হন। এরমধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় দুইজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পাঠানো হলে সেখানেই রাত আড়াইটায় সুজন শেখ নামে এক সদস্য মারা যান। এ ঘটনার পর সারাদেশে হেযবুত তওহীদের সদস্যরা রাস্তায় নেমে পড়ে। তারা সুজন হত্যার বিচারের দাবিতে মানবববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই হেযবুত তওহীদের সাবেক জেলা সভাপতি সেলিম শেখ বাদী হয়ে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে পাবনা সদর থানায় মামলা করে। পরে পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ৭ জনকে আটক করতে সক্ষম হয়। সকল আসামিরা বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছে।