বকধার্মিকতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে ধর্মের প্রকৃত রূপ, ধর্মের আসল সৌন্দর্য। ধর্মেরই লেবাসে সমাজে ক্রমেই বেড়ে চলেছে অধর্মের চাষবাস। চলুন, তার কিছু নমুনা দেখে আসি।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন, প্রতিটি নির্বাচনের আগে কিছু ধার্মিক লোকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জীবনে খুব বেশি ধর্মকর্ম তারা করেন না, কিন্তু নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই ধার্মিক হয়ে যান। নিয়মিত মসজিদে আসা-যাওয়া শুরু করেন, এতিমখানায় খাবার বিতরণ করেন, মোল্লা-মৌলভীদেরকে বাড়িতে ডেকে আপ্যায়ন করেন। সারা জীবন পরের হক নষ্ট করে আসা লোকটিও নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে দানশীল হয়ে ওঠেন। গরীব-দুঃখী মানুষের প্রতি দরদে তার হৃদয় উতলে ওঠে। রমজান, ঈদ, শীত, বন্যায় ছুটে যান মানুষের পাশে, বিতরণ করেন খাবার, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, কম্বল ইত্যাদি। আর এসব ‘ভালো কাজ’ তারা করেন বেশ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি আপলোড করেন, কেউ কেউ টাকা খরচ করে সাংবাদিক ডেকে এনে মিডিয়াতে প্রচারও করেন।
এতক্ষণ যাদের কথা বললাম তারা হচ্ছে ‘উঠতি ধার্মিক’। রাজনীতি পাড়ায় কিছু ‘পুরানো ধার্মিক’ও আছে যারা নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দেন। দাড়ি লম্বা করে মেহেদী লাগিয়ে রীতিমতো আল্লাহ-ওয়ালা বনে যান। অথচ গরীবের হক নষ্ট করা, সরকারের বিভিন্ন খাতের টাকা আত্মসাৎ করা, রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্টের টাকা লুটপাট করা, অর্থের বিনিময়ে বিচার-সালিশ করা, চাকরি পাইয়ে দেয়ার কথা বলে মধ্যবিত্তের টাকা মেরে দেয়া সহ এহেন অন্যায় পন্থা নাই যা তারা অবলম্বন করেন না। ধার্মিকের ছদ্দবেশে এই মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে সমাজের একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে বসে ‘অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে’ এই অধর্মগুলো করে যান। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ বা লোকচক্ষুর আড়ালে।
রাজনীতি পাড়ার এই বকধার্মিকদের মতো আরো একটি শ্রেণির দেখা মেলে সরকারি অফিস, থানা-পুলিশ ও ব্যাংক পাড়ায়। তারাও নিয়মিত নামাজ পরেন, গায়ে আরবীয় খুশবু মাখেন। বিশেষ করে রমজান মাস এলে তারা রীতিমতো পীর দরবেশ হয়ে ওঠেন। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেন না, একটা রোজা ভাঙেন না। আরবীয় খেজুর ছাড়া ইফতার করেন না, পাঞ্জাবি না পরে অফিস করেন না। অথচ ষুষ না পেলে একটা ফাইলও এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে সরান না। রমজান মাসেও তাদের এই খাই-খাই প্রবণতা এতটুকু কমে না, বরং আরো বাড়ে। বাড়তি উৎকোচের কারণ- আমাদেরও তো বউ-বাচ্চা আছে, আমাদেরকেও তো ঈদ করতে হবে, আমাদেরও তো রমজান মাসে একটা বাড়তি খরচ আছে! পাক্কা ঈমানদার এই মানুষগুলো রোজা না রাখলে গুনাহগার হোন, কিন্তু মানুষকে হয়রানি করে সুবিধা আদায় করলে কোনো গুনাহ নাই। বরং এটাকে তারা নিজেদের ‘হক’ মনে করেন।
এমন ভণ্ডামি শুধু সরকারি অফিস পাড়াতে ঘুরলেই দেখা যায় তা নয়, বরং কমবেশি সব জায়গাতেই এর দেখা মেলে। মানুষের ¶তি হবে জেনেও খাবারে ভেজাল মেশান যে দোকানি, কিংবা আড়ৎদার, তিনিও ঘটা করে নামাজ পড়েন এই রমজানে। যে ব্যবসায়ী লোকটি সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন, তিনিও পাক্কা মুসল্লি হয়ে ওঠেন এই রমজানে। সরকারের যে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ব্যর্থতায় এই রমজানে মানুষের নাভিশ্বাস, ঘরে ঘরে হাহাকার, তাদেরকেও দেখা যায়, মক্কা শরীফে ইমাম সাহেবের ঠিক পাশে ইতেকাফে বসতে!
আরেক ধরনের প্রকাশ্য বকধার্মিকতা দেখা যায় মসজিদ ও ঈদগাহ মাঠে। সমাজে যারা সবচেয়ে বেশি অর্থবিত্তের মালিক, তারা শুক্রবারে বা ঈদের জামাতে সবার আগে নামাজে আসেন, একেবারে প্রথম কাতারে বসেন। মসজিদের ইমাম, সভাপতি, সেক্রেটারি সহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তাদেরকে খুব সম্মান ও সমাদর করেন। নামাজের ফাঁকে ‘দান বাক্স’ যখন কাতারে কাতারে ঘুরে বেড়ায় কিংবা মাইকে ঘোষণা দিয়ে যখন ‘কালেকশন’ করা হয়, তখন এই হোমড়া-চোমড়া শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি দান-খয়রাত করেন। তাদের মোটা অংকের দানের ঘোষণার সাথে সাথে ‘মারহাবা!’ ‘মাশাল্লাহ’ ধ্বনিতে মসজিদ গমগম করে ওঠে। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এদের অধিকাংশই অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে এমন পন্থায়, যা ধর্মস্বীকৃত নয়, ধর্মের চোখে বৈধ পন্থা নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে না। বরং আয়ের উৎস যাই হোক না কেন, যে যত বেশি দান করেন, তার জন্য তার পরিবারের জন্য, এমনকি তার পরলোকগত পূর্বপুরুষের জন্য তত লম্বা করে দোয়া করা হয়। এভাবে কালো টাকা সাদা করে সমাজে সম্মানিত হওয়ার একেকটি মেশিন বসিয়ে রাখা হয় মসজিদগুলোতে।
এভাবে উদাহরণ দিতে গেলে দেখা যাবে, কোথাও বাদ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা এই বকধার্মিকতা, এই ভণ্ডামির শেষ কোথায়?
ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণে। সমাজে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে মহামানবেরা এসেছেন স্রষ্টার বিধান নিয়ে। সেই বিধানের সমষ্টিই হচ্ছে ধর্ম। যেমন ইসলাম ধর্মের কথা যদি বলা হয়, তাহলে এর মূলগ্রন্থ পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে মানুষ কিভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করবে। জীবনের প্রতিটি অঙ্গনের মূলনীতি সেখানে দেয়া হয়েছে। হুকুম দেয়া হয়েছে- সত্য বলো, ন্যায়ের পথে চলো, গরীবের হক আদায় করো, সুদ খেও না, ঘুষ নিও না, এতিমের অধিকার নষ্ট করো না, প্রতিবেশীকে না খাইয়ে রেখে নিজে পেট পুরে খেও না, পণ্যে ভেজাল মিশিও না, অন্যায়ভাবে পরের সম্পদ ভক্ষণ করিও না ইত্যাদি। মুসলিম সমাজে যখন স্রষ্টার দেয়া এই হুকুম-বিধানগুলো মানা হয়, তখন সেই সমাজে অবধারিত ফল হিসেবে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ জন্য এই ধর্মের নাম দেয়া হয়েছে ‘ইসলাম’, আ¶রিক অর্থেই যার মানে হলো ‘শান্তি’। সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে, প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মানুষও যদি রমজানে টানা ৩০ দিন রোজা রাখে, প্রত্যেকে মাথায় টুপি দিয়ে লম্বা দাড়ি রেখে পাক্কা মুসল্লির বেশ ধরে, অথচ স্রষ্টার দেয়া উপরোক্ত হুকুমগুলো না মানে, তাহলে কস্মিনকালেও সমাজে শান্তি তথা ‘ইসলাম’ আসবে না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমরা দেখি, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার সাথে সরাসরি যোগসূত্র যে হুকুমগুলোর, যে বিধানগুলোর, সেগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অগণিত মানুষ ধার্মিক সেজে বসে আছে!
সমাজের এই বকধার্মিকতার বিস্তারে আমাদের ‘অতিধার্মিক’ পুরোহিত মোল্লা সাহেবরা দায় নিবেন কি না আমি জানি না। তবে বাস্তবতা এই যে, তারা যখন মোটা হাদিয়ার বিনিময়ে একজন পাপাচারীর জন্য লম্বা করে দোয়া করেন, মসজিদ-মাদ্রাসায় বড় অংকের দান খয়রাতের বিনিময়ে আল্লাহর দরবারে খাস দিলে ফরিয়াদ করেন, তখন সবচেয়ে পাপাচারী মানুষটিও নিজেকে পরিশুদ্ধ ভাবতে শুরু করে। নিজের সারা জীবনের পাপ ঢাকা পরে যায় ওই একদিনের দান-খয়রাতের নিচে। এভাবে অতিধার্মিকরা বকধার্মিকদেরকে ‘ধার্মিক’ সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন, টাকার বিনিময়ে। এই দুটি শ্রেণিকে মানুষ যতদিন না বয়কট করবে, ততদিন তারা ধর্মের আসল চেহারা দেখতে পাবে না। ততদিন ধর্মের সহজ-সরল, অনাবিল, শ্বাশত, সুন্দর রূপটি তাদের কাছে অধরা থেকে যাবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করার তওফিক দান করুন। আমিন।