ধর্মের অপব্যাখ্যা নারী প্রগতির অন্তরায়:
আল্লাহ তাঁর নাজিলকৃত জীবনব্যবস্থা ইসলামে নারী ও পুরুষকে একে অপরের সহযোগী ও বন্ধুরূপে সৃষ্টি করেছেন। তাদের উভয়কেই তাঁর প্রতিনিধিত্ব তথা খেলাফতের কাজ দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। এর বাস্তবিক রূপ আমরা দেখতে পাই, রসুলাল্লাহ (সা.) এর সমগ্র জীবনীতে। প্রকৃত ইসলামের যুগে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামষ্টিক, জাতীয় সকল কাজে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতেন। মসজিদে, আলোচনা সভায়, জুমাতে, ঈদে, উৎসবে, চিকিৎসায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও রসুলাল্লাহ (সা.) নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন।
কিন্তু আজকে আমাদের সমাজে আমরা দেখি তার বিপরীত চিত্র। একটি স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী ইসলামের বিধানের নাম করেই জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে পিছিয়ে রেখেছে, ফতোয়ার জালে বন্দী করেছে। তারা নারীর বুদ্ধি ও যোগ্যতা বিকাশের পথকে অবরুদ্ধ করে তাদেরকে অযোগ্য, হীনবল, হীনম্মন্য, গতিহীন, পুরুষের আজ্ঞাবাহী জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। আর তারপর তাদের মেধা, জ্ঞান, যোগ্যতাকে অস্বীকার করেছে, তাদেরকে বানিয়ে ফেলেছে একান্ত ঘরকেন্দ্রিক।
নারীকে এভাবে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য তারা ওয়াজ মাহফিলে, খোতবায়, পত্র-পত্রিকায়, টিভি রেডিওর অনুষ্ঠানে এক কথায় সর্বত্র নারীবিদ্বেষী ও অবমাননাকর বয়ান করে থাকেন। নারীকে আল্লাহই যোগ্যতা কম দিয়েছেন, ধর্মই নারীকে ঘরে থাকতে বলে, নারী সকল পাপের উৎস, সকল ফেতনার সূতিকাগার, তাদেরকে দেখলেই যুব-সমাজ রসাতলে চলে যাবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে যাবে, নারীর একটি চুল দেখা গেলে সেটাও সাপ হয়ে দংশন করবে, তাই নারী ঘরে থাকবে এটাই হচ্ছে ওলামা শ্রেণির সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত মুসলিম সমাজের নারী ও পুরুষ উভয়ের মন-মগজকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। অথচ এই ধারণাগুলো ইসলামের আল্লাহ প্রদত্ত মূলনীতি ও তাঁর রসুলের সমগ্র জীবনের কর্মপদ্ধতি বা সুন্নাতের সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যে, ইসলাম নারীদের মেধা, জ্ঞান ও যোগ্যতাকে খাটো করে দেখায় না। কর্মক্ষেত্রে শালীনতা রক্ষার দায় কেবল নারীর একার উপর ইসলাম আরোপ করেনি, এটা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই আবশ্যক। শালীনতা ও পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে নারী ও পুরুষ একত্রে যেকোনো কাজে অংশ নিতে পারে। নারী তার যোগ্যতাবলে সমাজের যে কোনো অঙ্গনে পুরুষের চেয়ে বেশি ভূমিকাও রাখতে পারে, যদি তাদেরকে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়।
কিন্তু বিকৃত ইসলামের নারী সংক্রান্ত ধ্যানধারণা নারীকে এই সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করে রেখেছে। তারা সকল কাজে নারীর অংশগ্রহণের পথে অকারণ প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে দিয়েছে, যা প্রকারান্তরে মানবজাতির অগ্রগতিকেই ব্যহত করছে।
ইসলামে নারীর অধিকার:
ইসলাম নারীকে পরিবারের গণ্ডির বাইরে গিয়ে সামাজিক ও জাতীয় জীবনের সকল অঙ্গনে কাজ করার অধিকার ও স্বাধীনতা দেয় এবং একে উৎসাহিত করে। ইসলামের এই নীতির বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই বিশ্বনবীর সমগ্র জীবনে। উম্মতে মোহাম্মদীর নারীরা যেমন পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন, সন্তানদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করেছেন, মেহমানদারি করেছেন তেমনি তারা প্রয়োজনে উপার্জন করেছেন, ইসলাম প্রচার করেছেন, যুদ্ধাহত সৈন্যদের সেবা করেছেন, জাতীয় অঙ্গনে বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে দুঃসাহসী ভূমিকাও রেখেছেন। সবচেয়ে বড় যে কাজটি তারা করেছেন তা হল জাতিকে তার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা দান করা। এজন্য অনেক নারী সারাটা জীবন পরিজনের সাথে জেহাদের ময়দানে কাটিয়েছেন।
মক্কার কাফেরদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে জর্জরিত নবীকে পরম মমতা ও সান্ত্বনায় আশ্বস্ত করেছেন উম্মুল মুমেনিন খাদিজাতুল কোবরা (রা.)। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ব্যয় বহন করতে গিয়ে আরবের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এই নারী রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন।
অথচ শত শত বছর থেকে নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে, তাদের বাড়ির বাইরে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের বিরুদ্ধে পর্দাপ্রথার দোহাই দিয়ে ইসলামের বিশেষজ্ঞরা ফতোয়া দিয়ে আসছেন। যার ফলে মুসলিম নারীরা যোগ্যতা ও মেধা হারিয়ে পরিণত হয়েছেন পরনির্ভরশীল জড়বস্তুতে।
রসুলাল্লাহর যুগে মসজিদ ছিল সকল জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদের দুয়ার ছিল নারী, পুরুষ সকলের জন্য অবারিত। রসুলাল্লাহর সঙ্গে নারীরা একই জামাতে সালাত আদায় করতেন, তাঁর কাছ থেকে দীনের শিক্ষা লাভ করতেন। নারীদের জন্য পৃথক কক্ষ বা কোনো কালো পর্দার আড়াল তৈরি করা হতো না। অথচ বর্তমানে মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকারই নেই।
এভাবে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে ছিল নারীদের দৃপ্ত পদচারণা। মদিনার বাজার ব্যবস্থাপক ছিলেন একজন নারী- উম্মে শেফা (রা.)। যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য মসজিদে নববীর প্রাঙ্গনে স্থাপিত হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন একজন নারী- রুফায়দাহ আসলামিয়া (রা.)। ওহুদের যুদ্ধসহ প্রতিটি যুদ্ধে নারীরা সৈন্যদের রসদ সরবরাহ, আহতদের রণাঙ্গন থেকে তাঁবুতে বহন করে আনা, সেবা-শুশ্রুষা করা, তৃষ্ণার্তদের পানি খাওয়ানো, শহীদদেরকে দাফন করা ইত্যাদি সকল কাজের যোগান দিতেন। বিশেষ সংকট সৃষ্টি হলে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে তলোয়ার হাতেও তাদেরকে দুঃসাহসী ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। কিছুদিন আগেও যারা ছিল পুরুষের দাসী ও ভোগ্যবস্তু, তারাই ইসলাম নামক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় পরিণত হল জাতির অপরিহার্য জনশক্তিতে। কোনো অজুহাতে নারীদেরকে পশ্চাৎপদ করে রাখার একটি উদাহরণও রসুলাল্লাহর সমগ্র জীবনে আমরা দেখতে পাই না।
ইসলামে কি নারীদের মসজিদে যাওয়া নিষিদ্ধ?
ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদের মসজিদে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আল্লাহ কোর’আনে নারী-পুরুষ উভয়কেই মসজিদে জমায়েত হতে, সালাহ কায়েম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “হে বনী আদম! যখন তোমরা নামাজের জন্য মসজিদে যাও, তখন ভালো পোশাক পরিধান কর” (সূরা আরাফ ৩১)। বনী আদম বলতে নারী ও পুরুষ উভয়কেই বোঝায়। রসুলাল্লাহর যুগের মো’মেন নারীরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মসজিদে পুরুষদের সঙ্গে একই জামাতে কায়েম করতেন। মক্কার মসজিদুল হারামে আজও নারী-পুরুষ একত্রেই সালাহ করছেন, হজ্ব করছেন। ইতিহাস হচ্ছে, পুরুষরা রসুলের ঠিক পেছনে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতেন। আর নারীরা দাঁড়াতেন পেছনের কাতারে। নারী-পুরুষের মাঝখানে কোনো দেয়াল বা কাপড় টানানো ছিল না। তারা একত্রে বসেই রসুলাল্লাহর আলোচনা শ্রবণ করতেন। খোলাফায়ে রাশেদুনের যুগেও একই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
বহু পরে ফিতনা সৃষ্টি হবে এই অজুহাতে ইসলামের অনেক পণ্ডিত নারীদের মসজিদে যেতে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, যেন কেউ নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা না দেয়। তাই অনেক মসজিদে নারীদের জন্য নামমাত্র পৃথক ও স্বল্পপরিসর একটি জায়গা রাখা হয়। বহু মসজিদে তাদের প্রবেশাধিকারই দেওয়া হয় না। একেবারে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া থাকে, যে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এভাবে শত শত বছর থেকে নিছক মনগড়া ফতোয়ার বলে নারীদেরকে আল্লাহর ঘর মসজিদে গমনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।
আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ মোমেনদেরকে ফেতনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত দীন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। সেই ফেতনা বা অশান্তি নির্মূলের লড়াই করার পরিবর্তে মুসলিম সমাজের ওলামাগণ নারীদেরকে গৃহবন্দী হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত জারি করে দিয়েছেন।
হেযবুত তওহীদে নারীদের কার্যক্রম
আন্দোলন পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর রসুলের (সা.) পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা হেযবুত তওহীদের অন্যতম মূলনীতি। তাই নারীদের ক্ষেত্রেও হেযবুত তওহীদ আল্লাহর রসুলের অনুসৃত নীতিরই অনুসরণ করে থাকে। সে মোতাবেক হেযবুত তওহীদের নারীরা আন্দোলনের সকল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে। আন্দোলনের প্রতিটি উদ্যোগ বা কার্যক্রমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা তাদের মেধা, জ্ঞান, যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে আন্দোলনের আস্থা অর্জন করেছেন। তারা বই, পত্র-পত্রিকা প্রচারের মাধ্যমে, আলোচনা সভায় বক্তব্য দিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়াতে কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যমে হেযবুত তওহীদের আদর্শ প্রচার করছেন। আন্দোলনের সকল কাজে নারী-পুরুষ উভয়ই সমানভাবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
ধর্মব্যবসায়ী ফতোয়াবাজ গোষ্ঠী পর্দার বিধান নিয়ে বাড়াবাড়ি করে নারীদের চিন্তা ও কর্মের উপর অবরোধ আরোপ করে যাচ্ছে শত শত বছর থেকে। কিন্তু হেযবুত তওহীদের নারীরা নিজেরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণ করার মাধ্যমে এই ফতোয়াবাজি ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আল্লাহর রসুল (সা.) আইয়ামে জাহিলিয়াতের অজ্ঞতা, বর্বরতার অতল গহ্বর থেকে আরবের নারীদের বের করে এনে তাদের জাতীয়, সামাজিক, সামষ্টিক, সামরিক সকল কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিলেন।
তেমনি হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এজন্য হেযবুত তওহীদকে গোড়াপন্থী মোল্লা ও ধর্মান্ধ শ্রেণির হুমকি, গালিগালাজ ও অপপ্রচারের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার চর্চা করার দরুন এই আন্দোলনে বিগত ২৯ বছরে নারী সংক্রান্ত একটিও অন্যায়-অপরাধ সংঘটনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় নি; ধর্ষণ দূরে থাক, একটি ইভ-টিজিং এর ঘটনাও ঘটেনি। হেযবুত তওহীদ প্রমাণ দিয়েছে যে, নারী ফেতনার কারণ নয়। বরং মো’মেন নারী পুরুষ একে অপরের সহযোগী ও বন্ধু। তাদের সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমেই ইসলামের প্রকৃত আদর্শকে বাস্তব রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে হেযবুত তওহীদ এগিয়ে যেতে পারছে। কোরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী বিকৃত পর্দাপ্রথা ও নারী বিদ্বেষী ফতোয়ার বিরুদ্ধে এটাই হেযবুত তওহীদের জবাব।
[লেখক: সম্পাদক, দৈনিক দেশেরপত্র]