ঔপনিবেশিক শাসকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, সামরিক শক্তি ও কূট-কৌশলের মাধ্যমে অধিকৃত প্রতিটি ভূ-খণ্ড থেকে অর্থ-সম্পদ লুট করে নিজ দেশে পুঞ্জীভূত করা। আমাদের এই উপমহাদেশও তাদের এই নীতির বাইরে ছিল না। মূলত এ অঞ্চলে ইউরোপিয়ানদের আগমনই ছিল বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ইংরেজদের যে শাসন শুরু হয়েছিল তার শেষ দিন পর্যন্ত তাদের এ উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত ছিল। তাদের স্বৈরাচারী নীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে উপমহাদেশের মানুষের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভোগ। পলাশীর যুদ্ধের মাত্র এক যুগ পর ১৭৭০ সালে (১১৭৬ বঙ্গাব্দে) সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে (যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত) বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা) এক কোটি মানুষ মারা যায় এবং যা ছিল এখানকার তৎকালীন জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। পরবর্তীতে ইংরেজদের শাসন যতই পাকাপোক্ত ও বিস্তৃত হয়েছে, এ উপমহাদেশের মানুষের দুর্ভোগও তত বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে উপমহাদেশ যখন বাহ্যত স্বাধীন হলো তখন এ অঞ্চলের সব মানুষের মতো পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষেরাও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু তাদের এই স্বপ্নভঙ্গ হতে খুব বেশি দেরি হয় নি। দুই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যখন চরম আকার ধারণ করে তখন এদেশের মানুষ সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পথে হেঁটেছে। এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যারা খুব অল্পও পড়েছেন তাদেরকেও বলে দিতে হবে না, পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের ক্ষোভে ফুঁসে উঠার অন্যতম কারণ ছিল প্রকট অর্থনৈতিক বৈষম্য। দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন মানুষ আরেকবার অর্থনৈতিক সুবিচারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
কয়েক বছর বাদেই স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দ পূর্ণ করতে চলেছি আমরা। এ সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি কতটা সমৃদ্ধ, সেই সমৃদ্ধির কতটা সুফল বৃহত্তর সাধারণ জনগোষ্ঠী পাচ্ছে, মানুষে মানুষে সম্পদের বৈষম্য কতটা লাঘব হয়েছে তা চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনীতিতে দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল পায় নি বা পাচ্ছে না, এমনটা দাবি করার কোনো কারণ নেই। সুফল আমরা অবশ্যই পাচ্ছি, কিন্তু সেই প্রাপ্তি প্রত্যাশার তুলনায় কতটুকু এটাই বড় প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত কোনো স্থিতিশীল কাঠামোর উপর দাঁড়াতে পারে নি। বরং দুর্নীতি, জালিয়াতি, অর্থ পাচার, সরকারি সম্পদ ও অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি, হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি, অপরাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি সব মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতি একটি ভঙ্গুর কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। বড় কোনো আঘাত আসলে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে থাকার সামর্থ্য আমাদের আমাদের নেই।
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে! পাচার হওয়া এই অর্থের অঙ্কটা আমার মতো সাধারণ মানুষের আক্কেল গুড়ুম হওয়ার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু এটা সত্য। এখানে দুর্নীতির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আমাদের ব্যবসায়ীরা দেশে পণ্য আনার কথা বলে ভুয়া এলসি করে বিদেশে টাকা পাচার করেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্জিত কোটি কোটি টাকা দিয়ে বিদেশে সেকেন্ড হোম তৈরি করেন। আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে নীতি-দুর্নীতি বলে কিছু নেই। বিপুল টাকা পয়সা খরচ করে সরকারি চাকরি পাওয়ার পর তার বহুগুণ অর্থ কামিয়ে নেওয়াকে তারা নিজেদের নৈতিক অধিকার হিসেবেই মনে করে। আর দেশে অসুবিধা হতে পারে এই চিন্তা করে অবৈধ পথে উপার্জিত সব টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ব্যবসায়ী, আমলা আর রাজনীতিবিদরা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করছে, ঔপনিবেশিক আমলের ব্রিটিশ বেনিয়া আর শাসকদের সাথে এদের পার্থক্য কোথায়? বরং সঠিকভাবে বিবেচনা করতে গেলে এরা ব্রিটিশদের চেয়েও জঘন্য। ব্রিটিশরা আর যাই হোক, লুটপাটের মধ্য দিয়ে সঞ্চিত অর্থ দ্বারা নিজের জাতিকে সমৃদ্ধ করেছে। আর আমাদের দেশীয় লুটেরা যারা আছে তারা নিজ জাতির রক্ত চুষে নিয়ে বিদেশে জমা করছে।
এ তো গেল অর্থপাচারের বিষয়। কিন্তু শুধু যে পাচারের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে তা নয়। নানা নিয়ম-অনিয়মের মধ্য দিয়ে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেমন প্রতি বছর বড় সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তারা-কর্মচারী প্রশিক্ষণের নাম করে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। আর এদিকে সংবাদপত্রের নিয়মিত শিরোনাম, ‘প্রকল্পের টাকায় বিদেশ সফর’, ‘সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত বিদেশ সফর’, ‘শিক্ষা সফরের নামে প্রমোদ ভ্রমণ’ ইত্যাদি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই টাকা আসে কোথা থেকে? জাতির টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করে আসছেন, তো জাতিকে কি দিচ্ছেন?
প্রতি বছর চিকিৎসা বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের একটি হিসাব অনুযায়ী বছরের প্রায় আড়াই লাখ রোগী চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যান। এভাবে প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হাতছাড়া হচ্ছে। শুধুমাত্র বিত্তশালী পরিবারের লোকেরাই যে চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান তা নয়, বরং মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেকেই দেশের বাইরে থেকে চিকিৎসা নিয়ে আসেন। পার্শ্ববর্তী দেশের মাদ্রাজে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা করাতে যান যাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ। অন্যদিকে ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে ৬০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের চিকিৎসা বা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে কেন? আমাদের এখানে হাসপাতাল কিংবা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো কমতি তো দেখি না। তারপরও যারা দেশের বাইরে যাচ্ছেন তাদের আপত্তি ‘মান’ নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিকিৎসা আর শিক্ষার নামে ব্যবসা তো আর কেউ কম করছে না, তাহলে মান খারাপ হবে কেন?
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে বছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ঘাটতির একটা লাগাম থাকা উচিত। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে, ৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। অথচ আমি যে তথ্য পেয়েছি তাতে দেখা যাচ্ছে, গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পুরো অর্থ বছরের হিসাব পেলে তা ২০ বিলিয়ন ডলারও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমদানি রফতানির মধ্যে এত বড় ফারাক নিয়ে আমরা আগাব কিভাবে?
এভাবে দেশের টাকা কোন কোন পথে বাইরে চলে যাচ্ছে সেই আলোচনা চালিয়ে গেলে তা খুব দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। আর আমাদের অর্থনীতি শুধু এই একটি দিক দিয়েই আক্রান্ত নয়। এখানে অনিয়ম আর হতাশার তালিকা অনেক দীর্ঘ। যেমন ব্যাংকগুলোর অবস্থা যদি বলি- গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকখাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। বছরের প্রথম ছয় মাসে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা, যেখানে এর আগে পুরো এক বছরে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ পূর্ববর্তী এক বছরে খেলাপির পরিমাণ যা বেড়েছিল, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই তারচেয়ে বেশি বেড়েছে। অথচ খেলাপি টাকা উদ্ধারের জন্য ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবসা করে লাভের মুখ দেখা এখন অমাবশ্যার চাঁদ দেখার মতো দুর্লভ। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতিটি জায়গায় তৈরি হয়েছে একেকটি সিন্ডিকেট। কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা এখন পরোটা আর ঝালমুড়িও বাজারজাত করছে, কোনো কিছু বাদ রাখছে না। পুকুরের বড় মাছেরা ছোট মাছদের যেভাবে গিলে খায় ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতিও এখানে অনেকটা তাই। বড় ব্যবসায়ীদের আগ্রাসনের সামনে ছোট ব্যবসায়ীরা সহায় সম্বল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। একবার কেউ ঋণে জড়িয়ে গেলে তা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। ব্যাংকগুলোও বড় ঋণ শুধু তাদেরকেই দিচ্ছে যারা এরই মধ্যে অঢেল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে আছে, এমনকি শত শত কোটি টাকার ঋণ খেলাপ থাকলেও। ফলে একদিক ধনী-গরিবের বৈষম্য যেমন বাড়ছে, বেকারত্বের হারও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই বেকারের হার সবচেয়ে বেশি।
এদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। নিয়মিত বিরতিতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠছে। এমন নয় যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুধু আমাদের এখানেই সৃষ্টি হয়। না, এটা কম-বেশি সব দেশেই আছে। কিন্তু তার একটা সীমা-পরিসীমা থাকে। আর আমাদের এখানে বিষয় এমন যে, একবার শুরু হলে শেষ কবে হবে তার ঠিক নেই। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতির চাকা একেবারে স্থবির হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ২০১৩ সালের শেষ দিক থেকে ২০১৫ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত দেশে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। কথা হচ্ছে, এমন পরিস্থিতি যদি ফিরে ফিরে আসে তাহলে টেকসই উন্নয়নের কোনো সুযোগ নেই।
এ তো গেল দেশের ভেতরকার অবস্থা। কিন্তু আজকের বিশ্বব্যবস্থায় যে কোনো দেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক অর্থনীতি দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। বিশ্ব অর্থনীতি আগে থেকেই টাল-মাটাল। ইরান, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া সহ বিভিন্ন দেশে চলছে পশ্চিমাদের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্প্রতি যে ভয়ানক বিষয়টি যুক্ত হয়েছে তা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য অবরোধ দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির এই দুই পরাশক্তি একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বাণিজ্যযুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে তার এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতেও। বাদ যাবে না বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোও।
এই অবরোধ শুধু চীনে নয়, বিশ্বের আরো বহু দেশেই বাণিজ্যিক অবরোধ দিয়ে রেখেছে পশ্চিমা দেশগুলো। কথা হচ্ছে, এত সমস্যা, এত সংকট, এত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাব কিভাবে? এখান থেকে আমাদের উত্তরণের পথ কী? এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, আমি কোনো অর্থনীতিবিদ নই, কিংবা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিত নই। তবে এদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি আমার ভাবনাগুলো তুলে ধরলাম। যদিও জানি না এই ক্ষুদ্র কণ্ঠের আওয়াজ কতদূর পৌঁছুবে।
প্রথমত অর্থনীতির ব্যাপারে আমার দু’টি সহজ সূত্র আছে-
১. নিজের টাকা রাখব, বাহির থেকে আনব।
২. টাকা যত চলবে, ভাগ্য তত ঘুরবে।
প্রথমটার কথা বলি। এত দুর্নীতি, এত অবক্ষয়, এত অনিয়মের পরও আমাদের অর্থনীতিটা যে আজও কোনো রকম টিকে আছে, তার পেছনে প্রধান দু’টি কারণ আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত দেশের এক কোটি তরুণ-তরুণী পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবাসে মানবেতর জীবন যাপন করে কোটি কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত, পোশাকশিল্পে কর্মরত আরেকদল অর্ধ-শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ যারা দিন-রাত পরিশ্রম করে পোশাক তৈরি করছে। মূলত এই রেমিট্যান্স আর তৈরি পোশাক খাত থেকে আগত বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতিকে এখনো ধসে পড়তে দেয় নি। আমি মনে করি, দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে এরকম আরো বহু পরিকল্পনা করতে হবে যার মূলনীতিই হবে- বিদেশ থেকে অর্থ ও সম্পদ এই দেশে আসবে, এখানকার মানুষদের সমৃদ্ধ করবে, কিন্তু এখান থেকে কোনো অর্থ বাইরে বেরিয়ে যাবে না। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে এখানে সম্পদ উপচে পড়তে বাধ্য।
দ্বিতীয় সূত্র হচ্ছে, অর্থের দ্রুত সঞ্চারণ। চলমান ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে যে সঞ্চয়ভিত্তিক ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। পশ্চিমা অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান ব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে- যত পার অর্থ সঞ্চয় কর; ব্যাংক আছে, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি আছে, তা টাকা জমা করো। এর শেষ ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে? মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোতে এসে জমা পড়ছে আর হাতে গোনা কিছু ধনী-বণিক শ্রেণি সেই টাকা ঋণ নিয়ে লাভবান হচ্ছে। তাদের খেলাপি ঋণের বোঝাও আবার রাষ্ট্র তথা সাধারণ জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিপুল অর্থ অলস-অচল পড়ে থাকছে। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান মতে ব্যাংকগুলোতে ৭৬ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। আমি মনে করি, আমাদের ঠিক উল্টো পথে হাঁটা উচিত। সঞ্চয়ভিত্তিক অর্থনীতির বদলে অর্থের দ্রুত সঞ্চারণ নিশ্চিত করতে হবে। এমন একটি অর্থনৈতিক কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে যেখানে অর্থ কোনো হাতে এসে অলস পড়ে থাকবে না বরং তা দ্রুত হাত বদল হয়ে যাবে (fast and still faster circulation of wealth)। একটি একশ’টাকার নোট যদি সারা দিনে দশজন মানুষের হাত বদল হয় তাহলে সে কোনো না কোনোভাবে এই দশজন মানুষকে উপকৃত করবে। কিন্তু সেই নোটটাই যদি ব্যাংক বা অন্য কোথাও পড়ে থাকে তাহলে তার মূল্য এক টুকরা কগজের চেয়ে অধিক কিছু নয়।
এর বাইরে আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ আমাদেরকে নিতে হবে। যেমন বাজারব্যবস্থা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা যদি বলি, একেবারে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে- সমস্ত সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। প্রথমে হয়তো এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। বাজারকে ঢেলে সাজাতে হবে, ছোট ছোট মূলধন নিয়ে ব্যবসা করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, নতুন উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার অনুকূল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাগবে। এক কথায় দেশের গোটা অর্থনীতিকে সিন্ডিকেটমুক্ত করে এমন একটি কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে হবে যা বিশেষ কোনো শ্রেণি নয় বরং সকলের স্বার্থ রক্ষা করবে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হানাহানির রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে চলা জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করতে হবে। চলমান পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোনো ঐশীবাণী নয় যে এর বিকল্প চিন্তা করা যাবে না। পূর্বে বলেছি, সংকট হবে খুবই ভয়াবহ। এই সংকট মোকাবেলায় এমন একটা রাজনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে যেখানে সিদ্ধান্ত হবে এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে, এর মাঝখানে কোনো কথা থাকবে না। সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত হবে জনকল্যাণে আর সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পুরো জাতি থাকবে ঐক্যবদ্ধ।
এই মৌলিক পরিবর্তনগুলো যদি আমরা নিয়ে আসতে পারি কিংবা পরিবর্তনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে আরো অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে। তবে গোড়ার কথা হচ্ছে, যে কোনো লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন জাতিগত ঐক্য। ঐক্যহীন জাতির লক্ষ্যের যেমন কোনো স্থিরতা থাকে না, তেমনি কোনো লক্ষ্য অর্জনের পথে যেসব বাধা-বিপত্তি আসে সেগুলো মোকাবেলার করার সামর্থ্যও থাকে না। বর্তমানে আমরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে এত বেশি বিভক্ত যে, কোনো বৃহত্তর প্রয়োজনেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না। এই জায়গাটাতে প্রথমে আমাদের সমাধানে আসতে হবে। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা সাধারণ মানুষ তথা জাতির স্বার্থে কাজ করবে নাকি নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকবে? তেমনি সাধারণ মানুষকেও এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে, সরকার জাতির কল্যাণে কোনো বৃহৎ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলে তা নিজেদের সাময়িক ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালেও তাকে স্বাগত জানাবে নাকি তার চরম বিরোধিতা করবে? শুধু শাসক আর শাসিত নয়, এখানে সক্রিয় প্রতিটি শ্রেণি-গোষ্ঠীর বিবাদ-বিসম্বাদের অবসান ঘটানো জরুরি। জাতীয় স্বার্থে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থগুলোকে জলাঞ্জলি দেওয়ার মতো মানসিকতাটুকু থাকতে হবে।