আম্মার ইবনে ইয়াসীর (র.)
আল্লাহর রসুল (সা.) যখন তওহীদের দিকে মানুষকে আহ্বান করতে শুরু করেন তখন যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় জীবন সম্পদ সঁপে দিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় তারা সংখ্যায় ছিলেন খুবই কম। বিশেষ করে প্রথমদিকে যারা সাড়া দেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, দুর্বল শ্রেণির মানুষ। অনেকেই ছিল পরাধীন ক্রীতদাস। কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধবাদীরা ছিল খুবই শক্তিশালী। তাই নবগঠিত উম্মাহর সদস্যদের জন্য ওই সময়টি ছিল এক ভয়ঙ্কর পরীক্ষাকাল। কারো তওহীদ গ্রহণের সংবাদ কাফেরদের আত্মায় যেন বিষাক্ত তীর বিদ্ধ করত। তারা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যেত, হিংস্রতায় ফেটে পড়তো। তারা শক্তি দিয়ে ইসলামের প্রদীপকে নিভিয়ে দিতে চাইত। তাই মো’মেনদের মধ্যে যাদের বংশের ও বিত্তের কোন প্রভাব ছিল না তাদের উপর তারা অমানুষিক নির্যাতন চালাতো। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুমাইয়া ও ইয়াসিরের পুত্র আম্মার ইবনে ইয়াসির।
আম্মার পরিবার মক্কার স্থানীয় ছিলেন না। হারানের ভাইয়ের খোঁজে আম্মারের পিতা ইয়াসির ও তার আরো দুই ভাই মক্কায় এসেছিল। তার দুই ভাই ইয়েমেন ফিরে গেলেও ইয়াসির আর ফিরে যায় না। আরবের প্রথা মোতাবেক একজন বাইরের মানুষকে আরবের কোনো এলাকায় বাস করতে হলে স্থানীয় কোনো গোত্রের বা ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হতো। ইয়াসীর সে মোতাবেক চুক্তি ও সন্ধিবদ্ধ হন মক্কায় আবু হুযাইফার সাথে। এক সময় তিনি আবু হুয়াইফার দাসী সুমাইয়্যাকে বিয়ে করেন এবং তার গর্ভেই আম্মারের জন্ম হয়। মক্কায় আম্মারদের কোন শক্ত খুঁটি ছিল না। বংশ-বিত্তের কোন প্রভাব ছিল না। তাই তারা যখন রসুলাল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসলো মক্কার কাফের মোশরেকরা যেন তীব্র রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ল। কেননা ক্রীতদাসদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো অধিকারই ঐ সমাজে স্বীকৃত ছিল না। তাদের সেই ক্ষোভ, ক্রোধ ও হিংস্রতা এক সময় চরম পাশবিক রূপ নিল।
মক্কার কাফেরদের রক্তচক্ষুর প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল এই দুর্বল আম্মার পরিবার। তাদের উপর কাফেররা পালাক্রমে চালাতো নিষ্ঠুর নির্যাতন। দিনের বেলায় সেই মরুভূমিতে হাঁটলে পায়ে ফোসকা পড়ে যেত মুহূর্তেই। মরুভূমির প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে অধিবাসীরা তাবুতে আশ্রয় নিতো। সেই উত্তপ্ত মরুভূমির উপর আম্মার পরিবারকে বুকে পাথর চাপিয়ে শুয়ে রাখা হতো। সেই তাপে গায়ের চর্বি পর্যন্ত গলে মরুভূমির মাটি ভিজে যেত। কিন্তু ওই হিংস্র-পাপী অত্যাচারীদের হৃদয় গলতো না। বরং দিনদিন তাদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছিল। তবুও কি অসীম ধৈর্য, কি বিশ্বাস-ভালোবাসা রসুলাল্লাহর প্রতি! ঈমানের প্রবল শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সাধারণের মধ্যে থেকেও যেন ধরা ছোয়ার অতীত।
একদিন কিশোর আম্মারকে জলন্ত অঙ্গারে শুয়ে রেখে কাফেররা অত্যাচার করছিল। তখন পাশ দিয়ে রসুলাল্লাহ যাচ্ছিলেন। আম্মারকে দেখে তিনি ব্যথিত হলেন এবং তার পবিত্র হাত আম্মারের মাথায় রেখে বললেন, “হে আগুন তুমি ইবরাহীমের জন্য যেমন ঠাণ্ডা হয়েছিলে, আম্মারের জন্য তেমন ঠাণ্ডা হয়ে যাও।” কাফেররা বিভিন্ন কৌশলে তাদের উপর নির্যাতন চালাতো। একদিন তারা আম্মারকে দীর্ঘক্ষণ পানিতে চুবিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে এবং তার মুখ দিয়ে রসুলাল্লাহকে অস্বীকারের কথা কৌশলে বলিয়ে নেয়। জ্ঞান ফিরলে কিশোর আম্মার অনুশোচনাবোধে কাঁদতে কাঁদতে রসুলাল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে ঘটনা ব্যক্ত করে। রসুলাল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার ঈমান কি বলে? সে বললো, আমার হৃদয় ঈমানে পরিপূর্ণ। তখন রসুলাল্লাহ বললেন, “ঠিক আছে তারা আবার এমন করলে তুমি তাদের কথা মেনে নিও, এতে কোন পাপ হবে না।”কোরায়েশদের পৈশাচিকতা মাঝে মাঝে বন্য পশুদেরও হার মানাতো। কখনো তারা ফুটন্ত গরম পানির মধ্যে তাদের মাথা চেপে ধরতো, মাঝে মধ্যে লোহার পোশাক পড়িয়ে জ্বলন্ত কয়লার উপর শুইয়ে রাখতো। তখন শরীরের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরত। সেই নির্যাতন ছিল বর্ণনাতীত। তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকতো কেবলই আল্লাহকে। কারণ, এক আল্লাহ ছাড়া তাঁদের আর কোন সহায় ছিল না।
এতকিছুর পরও যখন তাদের সত্যের পথ থেকে তাদের বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করা গেল না। রসুলাল্লাহর প্রতি বিশ্বাস-ভরসায় সামান্য ঘাটতি দেখা গেল না। তখন তীব্র পরাজয়বোধে কুরাইশরা যেন উন্মাদ হয়ে গেল। ইসলামকে ধ্বংস করার জন্যে তারা তাদের পাশবিকতার চূড়ান্তে পৌছালো। অত্যাচার সইতে সইতে আম্মারের পিতা ইয়াসির শাহাদাত বরণ করলো। আম্মারের মা সুমাইয়াকে নির্মম ভাবে হত্যা করলো। তারা রেখে গেলেন তাদের বুকের ধন আম্মারকে। তারও অনেক পর যখন আল্লাহ মো’মেনদেরকে মদীনায় প্রতষ্ঠিতি করনে তখন তাঁরা ঘুরে দাঁড়ান। সত্যদীনকে প্রতষ্ঠিা করে মানবজীবন থেকে সকল অন্যায় অবিচার অশান্তি বিলুপ্ত করার অবিনাশী প্ররেণায় উজ্জীবতি নবীর সঙ্গীগণ শুরু করণে জীবনরে অন্য র্পব- শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। তাঁরা রুখে দাঁড়ান সন্ত্রাসী কাফেরদের বিরুদ্ধে সংঘটতি হয় ঐতহিাসকি বদর যুদ্ধ, সত্য-মিথ্যা আলাদা হয়ে ওঠার যুদ্ধে। আল্লাহর সৈনিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে সত্য প্রতষ্ঠিার যুদ্ধে। আল্লাহ বিজয় দান করেণ, মো’মেনদেরকে এমনকি মক্কার সবচেয়ে বড় কাফের আবু জহেলেও মারা যায় এই যুদ্ধে।
নবীজীর (সা.) পাশে তখন আম্মার। শহীদ জননীর বীর পুত্র আম্মার। সামনে হতভাগা আবু জেহেলের লাশ। তিনি চলে যান ১০ বছর আগে। অসহায় বৃদ্ধা মায়ের রক্তমাখা বদনখানি যনে স্বরূপে ভেসে ওঠে আম্মারের স্মৃতিপটে নবীজী তখন সান্ত্বনার সুরে বললেন: “আল্লাহ তোমার মায়ের হত্যাকারীকে ধ্বংস করে দিয়েছেনে।” [সূত্র: সীরাতুল মুসতাফা-১:২২৫-২২৭ পৃ.]