এই দীনের প্রবেশদ্বার (Entrance) হচ্ছে তওহীদ- “আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে হুকুমদাতা মানবো না” এই সাক্ষ্য দেওয়া। মুসলিম বলে কথিত জাতিটি আজ এই তওহীদে নেই যা আগেই বলে এসেছি। যারা এ তওহীদ থেকে বহির্গত হয়ে গেছে তারা ইসলাম থেকেই বহির্গত হয়ে গেছে এতো স্বাভাবিক কথা। আল্লাহ আরও একটি কাজের কথা বলেছেন যেটা ত্যাগ করলে জাতি ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যায়, সেই কাজটি হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম (জেহাদ)। অর্থাৎ জেহাদ ত্যাগ হচ্ছে এই দীন থেকে বহির্গত হয়ে যাওয়ার পথ (Exit)। আল্লাহ কোর’আনে অন্তত তিনবার বলেছেন যে, তিনি (আল্লাহ) তার রসুলকে (দ.) সঠিক দিক নির্দেশনা ও সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন এই জন্য যে তিনি এটাকে অন্যান্য সমস্ত দীনের ওপর বিজয়ী করবেন (সুরা ফাতাহ- ২৮, সুরা তওবা- ৩৩, সুরা সফ- ৯)। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার নবী ঘোষণা করলেন, “আমি আদিষ্ট হয়েছি সমস্ত মানব জাতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না তারা একথা মেনে নেয় যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন হুকুমদাতা নেই, এবং মোহাম্মদ (দ.) তাঁর রসুল (হাদিস- আব্দুল্লাহ এবনে ওমর (রা.) থেকে বোখারি)।”
ইতিহাস সাক্ষী যতদিন তিনি এই দুনিয়ায় ছিলেন ততদিন তিনি ও তাঁর আসহাব একদেহ একপ্রাণ হয়ে আল্লাহর দেয়া ঐ আদেশ ও দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং তা করতে যেয়ে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ১০৭টি ছোট বড় যুদ্ধ করেছেন। তারপর যখন আল্লাহর রসুল (দ.) এই দুনিয়া থেকে চলে গেলেন তখন ঐ দায়িত্ব স্বভাবতই এসে পড়লো তার গঠন করা জাতিটির ওপর অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর, কারণ রসুলের ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব তখনও পূর্ণ হয় নি। শুধু আরব দেশটাকে আল্লাহর আইনের শাসনের মধ্যে আনা হয়েছে; বাকি পৃথিবী মানুষের তৈরি আইনের অধীনে চলছে। রসুলাল্লাহর (দ.) নিজ হাতে গড়া জাতিটি অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদী তার জান্নাতবাসী নেতার ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব তাদের মাথায় এসে পড়া সম্বন্ধে এত সচেতন ছিলেন যে নেতার দুনিয়া থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার পরিবার পরিজন, এক কথায় পার্থিব সব কিছু কোরবান করে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ করতে অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীতে এই সত্য-ন্যায় জীবনব্যবস্থা কায়েম করতে অস্ত্র হাতে তাদের স্বদেশ আরব থেকে বের হয়ে পড়েছিলেন। এই কাজকে তাদের নেতা বলেছিলেন আমার সুন্নাহ, সুন্নাতি এবং বলেছিলেন আমার এই সুন্নাহ যে বা যারা ত্যাগ করবে তারা আমার কেউ নয়, মান তারাকা সুন্নাতি ফালাইসা মিন্নি, অর্থাৎ তারা উম্মতে মোহাম্মদীই নয়। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছেন- মান রাগেবা আন সুুন্নাতি ফালাইসা মিন্নি (বোখারি, মুসলিম) অর্থাৎ যে আমার সুন্নাহ থেকে শুধু মুখ ফিরিয়ে নেবে সেও আমার কেউ নয়।
জেহাদ ছেড়ে দেবার পর নবীর সুন্নাহর বিকল্প হিসাবে নেয়া হলো তাঁর ব্যক্তিগত অভ্যাস-অনভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি যে গুলোর সাথে তার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য, তাঁর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বের কোন সম্বন্ধই নেই; যে গুলো নেহায়েৎ ব্যক্তিগত ব্যাপার। নিষ্ঠুর পরিহাস এই যে, জেহাদ ত্যাগকারীদের কাছে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবীর সুন্নাহ হয়ে দাঁড়ালো, তার বিপ্লব নয়, তার মেসওয়াক করা, খাবার আগে জিহবায় একটু নিমক দেওয়া, খাবার পর একটু মিষ্টি খাওয়া, ডান পাশে শোয়ার মত ছোট-খাট অসংখ্য তুচ্ছ ব্যাপার। মানুষের ইতিহাসে কোন জাতি তার নেতার এমন অপমানকর অবমূল্যায়ন করেছে বলে আমার জানা নেই। জেহাদ ত্যাগ করে ঐ জাতি মো’মেন ও উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাওয়া ছাড়াও আরও ভয়ংকর পরিণতি হলো। তা হলো এই যে আল্লাহ সুরা তওবায় ৩৮ এবং ৩৯ নং আয়াতে এই জাতিকে জেহাদ ছেড়ে দেবার পরিণতি সম্বন্ধে এই বলে সাবধান করে দিয়েছেন- “হে মো’মেনরা তোমাদের কি হয়েছে যে, যখন তোমাদের বলা হয় আল্লাহর পথে অভিযানে বের হও, তখন যেন তোমরা ঝুঁকে পড়ে মাটির সাথে মিশে যাও। (তাহলে কি) তোমরা পরকালের পরিবর্তে এই জীবনকেই প্রাধান্য দিয়েছো? এই জীবনের ভোগ তো পরকালের জীবনের তুলনায় অতি সামান্য। যদি তোমরা সামরিক অভিযানে বের না হও তবে তিনি তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের স্থলে অন্য কোন জাতিকে প্রতিষ্ঠা করবেন (অর্থাৎ তোমাদের অন্য কোন জাতির দাস, গোলাম বানিয়ে দেবেন) এবং তোমরা তার কোনই ক্ষতি করতে পারবেনা, আল্লাহ সমস্ত কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।” এই কঠোর সতর্কবাণী সত্ত্বেও আকীদা অর্থাৎ জাতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে সঠিক সম্যক ধারণার (Comprehensive Conception) বিকৃতিতে এই জাতি জেহাদ ছেড়ে দিয়ে নফসের সাথে নিরাপদ জেহাদ শুরু কোরল। আল্লাহও তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কিছুদিন পরই ইউরোপের খ্রিষ্টান জাতিগুলিকে দিয়ে ঐ জাতিকে সামরিক ভাবে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করে শাসনভার ও কর্তৃত্ব তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে খ্রিষ্টানদের হাতে তুলে দিলে।
এখানে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, আল্লাহ যাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়ে অন্য জাতির গোলাম বানিয়ে দেবেন তারা কি মো’মেন? কখনও নয়, যে মো’মেনদের জন্য আল্লাহ তাঁর অগণিত মালায়েকদের সঙ্গে নিয়ে সর্বক্ষণ সালাত ও সালাম প্রেরণ করেন, যে মো’মেনদের সম্মান আল্লাহর কাছে তাঁর ঘর কাবারও উর্ধ্বে, সেই মো’মেনদেরকে আল্লাহ কখনওই শাস্তি দিতে পারেন না। আল্লাহর শাস্তি, গজব, লানত, পরাজয়, হীনতা এবং জাহান্নাম ইত্যাদি হচ্ছে কাফের মোশরেকদের জন্য নির্ধারিত আর মো’মেনদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রহম, দয়া, স্নেহ, মমতা, সাহায্য, তাদের জন্য রয়েছে উভয় জগতে বিজয়, উৎকর্ষ, সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও জান্নাতের অঙ্গীকার। সুতরাং আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে বহির্গত হওয়া ত্যাগ করলেই এই জাতি আর মো’মেন থাকে না। আজ এই মুসলিম জাতি কেবল জেহাদ ত্যাগ করেছে তা-ই নয়, তারা জেহাদ বিরোধী, জেহাদের নাম শুনলেই ভয়ে তাদের হাত পা পেটের ভিতরে ঢুকে যায়। কোথাও জেহাদ শব্দটি শুনলেই হাজারটা প্রশ্ন তাদের মনে ঝাঁক বেঁধে আসে- এই বুঝি সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ হানা দিলো। জেহাদ সম্পর্কে যে বিভ্রান্তিকর ধারণা দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিষ্টান সভ্যতা মিডিয়া ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কায়েম করে ফেলেছে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অধিকাংশ মানুষই মনে করছেন যে, জেহাদ মানেই সন্ত্রাস। তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে জেহাদ ও সন্ত্রাস সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ধারণা। জেহাদ শব্দের অর্থ সংগ্রাম, সর্বাত্মক সংগ্রাম, প্রচেষ্টা। জেহাদ হচ্ছে দীন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা মানুষকে মুখে বলে, লিখে জানিয়ে, বক্তৃতা করে, যুক্তি উপস্থাপন করে, বুঝিয়ে ইত্যাদি ভাবে বলা। আর কেতাল একেবারে ভিন্ন শব্দ যার অর্থ সশস্ত্র যুদ্ধ। জেহাদ ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠি ইত্যাদির পর্যায়ে এবং কেতাল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠি বা দলের কাজ হবে মানুষকে যুক্তি দিয়ে কোর’আন-হাদিস দেখিয়ে, বই লিখে, বক্তৃতা করে অর্থাৎ সর্বপ্রকারে মানুষকে এ কথা বোঝানো যে পৃথিবীতে অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, শোষণ, ক্রন্দন, রক্তপাত, যুদ্ধহীন একটি সমাজে নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারের মধ্যে অর্থাৎ নিরংকুশ শান্তিতে বাস করতে হলে একমাত্র পথ যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর দেয়া জীবন বিধান মোতাবেক আমাদের জীবন পরিচালনা করা।
যদি মানুষ এই কথা বোঝে, সাড়া দেয়, মানুষের সার্বভৌমত্বকে ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে তখন সৃষ্টি হবে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর প্রশ্ন আসবে যুদ্ধ বা কেতালের। কারণ কোন রাষ্ট্র কোনদিন ব্যক্তি বা দলের নীতিতে টিকে থাকতে পারে না। তখন তাঁর প্রয়োজন হয় অস্ত্রের, সৈনিকের, যুদ্ধের প্রশিক্ষণের। তওহীদ ভিত্তিক এই সত্যদীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি গোষ্ঠি বা দলগতভাবে কোনও কেতাল অর্থাৎ সশস্ত্র যুদ্ধ নেই, আছে শুধু তওহীদের, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের আহ্বান, বালাগ দেয়া, এটাই জেহাদ। ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আছে সশস্ত্র যুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অস্ত্র, যুদ্ধ ইত্যাদি সর্বযুগে, সর্বদেশেই আইনসম্মত। কোর’আন ও হাদিসে যে কেতালের কথা আছে তা রাষ্ট্রগত।