হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি কোন পথে?

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম

বিশ্ব রাজনীতি অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন ধর্ম এক নম্বর ইস্যু। পাঁচ শতাব্দী আগে ইউরোপে বস্তুবাদী ধর্মহীন একটি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে তারা যখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয় তখন তাদের তৈরি ব্যবস্থাগুলোকে দুনিয়াজুড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে চর্চিত বস্তুবাদী ধর্মহীন পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র প্রভাবে পৃথিবীর মানুষ এখন এতটাই মানবতাবোধহীন, আত্মাহীন, জড়বাদী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়েছে যে সকল চিন্তাশীল, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই এখন একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, যদিও ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও পৈশাচিকতা রুখতে ধর্মকে বাদ দিয়েই জাতীয় জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত ইউরোপে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু সেটার ফল আশানুরূপ হয় নি, মানুষ শান্তি পায় নি। যেটা পেয়েছে সেটা হলো যান্ত্রিক প্রগতি (Technological advancement)। তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, বাস্তবে কোথাও ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় নি। শত সহস্র বছর থেকে মানুষের মনে লালিত ধর্মবিশ্বাস দূর করা যায় নি। এ কারণে তারা নীতি পাল্টিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিগত উপাসনার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যখন বর্তমানের কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare state) উপাধি ধারণ করে ব্যাপকভাবে জনসম্পৃক্ত হওয়া শুরু করল, মানুষও রাষ্ট্রের নানা কাজে অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেল, তখন সেই ধর্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে গণ্ডিবদ্ধ থাকে নি। নানা ইস্যুতে, নানা প্রেক্ষাপটে, ঘটনাপ্রবাহের নানা বাঁকে সেই ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী একটি গোষ্ঠী নানা ইস্যুতে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। তখন রাষ্ট্রকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসীমায় বন্দী রাখার চিন্তাটা মাঠে মারা গেছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দখলদারিত্ব নিয়ে এবং ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদের উত্থানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে মানবজাতি। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের সেক্যুলার দলগুলো রাজনীতির মাঠ দখল করেছিল সেই মাঠ এখন ডানপন্থী দলগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী ও জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। সেখানে অর্থ, অস্ত্র, সেনাবাহিনী নিয়োগ করছে পাশ্চাত্যের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। আর এই ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী কীভাবে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে সেটা সবাই জানেন।

ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ভারতবর্ষেও চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার জন্য। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে এ অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান এই দুটো ধর্মের অনুসারীই ছিল সংখ্যাগুরু। তার আগে ছিল বৌদ্ধরা। মুসলমানদের আগমনের পর কোটি কোটি ভারতবাসী ইসলামের সুশাসন, শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার, সাম্য ও উন্নত আদর্শের পরিচয় পেয়ে মুসলিম হয়। এখনও হিন্দু ও মুসলমান এ উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমানের সামাজিক বাস্তবতায় হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যগঠন করা, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত তাদের মানসিক দূরত্ব দূর করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালিয়ে প্রায়ই ধর্মীয় উগ্রতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এসব ঘটনা উভয় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সন্দেহ, দূরত্ব ও বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলছে। এই শত্রুতার ভাব যতদিন টিকিয়ে রাখা যায় ততদিন সাম্রাজ্যবাদী, অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এর সুফল ভোগ করবে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা শিয়া সুন্নীর দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তেলসম্পদ দখল করে নিচ্ছে। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটিকে তারা কাজে লাগাবে এটা সাধারণ জ্ঞান।

বাংলাদেশের পেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি, যদি আমরা সত্যিই দেশকে ভালোবাসি, আমাদের এই দেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। যারা দেশের গুরুত্ব বোঝেন না, তাদের উচিত সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করা। এ বাংলার মাটিতে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, এই মাটি দিয়েই হিন্দুরা প্রতিমা বানায় আর মুসলমানেরা এই মাটিতেই সেজদা করে। এ মাটির ফল-ফসলে হিন্দু-মুসলিম পুষ্ট হয়। তাই দেশকে রক্ষার প্রশ্ন আসলে তখন ধর্মীয় বিভেদ ভুলে দেশরক্ষায় এগিয়ে আসাটা জরুরি। এখন দেশের অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে, তাই হিন্দু-মুসলিমের বিদ্বেষ দূর করা এখন আমাদের প্রথম কর্তব্য। যখন ইরাক আক্রান্ত হলো তখন সিরিয়ার লোকেরা ফুর্তি করেছে। কিন্তু এখন সিরিয়ার সেই লোকেরা ইউরোপে গিয়ে ভিক্ষা করে। আগুন লাগলে মন্দির মসজিদ দুটোই ছাই হয়ে যায়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা সোজা কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন কঠিন কাজ। সরকারগুলো আইন প্রয়োগ করে দাঙ্গা থামাতে পারে কিন্তু সম্প্রীতি স্থাপন করবে কী দিয়ে? তারা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ান, ক্রন্দনরত মানুষের মাথায় হাত বুলান, ভাঙা উপাসনালয় গড়ে দেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষের মন সরকার জোড়া লাগাবেন কী দিয়ে? এটা করার জন্য উভয় সম্প্রদায়কে পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মকে অপব্যবহার করে যেমন এ দ্বন্দ্ব লাগানো হয়েছে তেমনি ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দিয়েই তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। এই শিক্ষাটি প্রচলিত নেই, কিন্তু তাদের উভয়ের ধর্মের মর্মে ও গ্রন্থে তা বিরাজ করছে। এ শিক্ষাকে অবধারণ করতে অবশ্যই ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত মন নিয়ে প্রয়াস করতে হবে। এক্ষেত্রে পূর্বসিদ্ধান্ত আবশ্যক যে, তারা আসলেই ঐক্যবদ্ধ হতে চাই কিনা। যদি চায় তাহলে তাদেরকে উভয়ের গোড়া কোথায় সেখানে দৃকপাত করতে হবে। যে কোনো ঐক্যপ্রক্রিয়ায় উভয়পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। এই ছাড় তাদেরকে দিতে হবে ধর্মের নামে প্রচলিত প্রথা ও সংস্কার থেকে। যেহেতু বিষয়টি ধর্মীয় তাই ধর্মবিশ্বাসের মধ্য থেকে কতটুকু তারা বিসর্জন দিতে পারবে, কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, ঐক্যের স্বার্থে তারা কতটুকু উদারতা নিজেদের মধ্যে আনয়ন করতে পারবে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

হিন্দু ও মুসলমানের বিশ্বাসগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে হাজারো সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুটো ধর্মের মধ্যে বহু মৌলিক বিষয় এক, দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ডালপালা নিয়ে। যেমন:

১. একেশ্বরবাদ: ওয়াহদানিয়াত বা একত্ববাদ। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসাবে মানা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। সনাতন ধর্মেরও মর্মবাণী একমেবাদ্বীতিয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬:২:১), একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে প্রভু ব্রহ্ম একজন। তাঁর কোনো শরিক নাই।

২. এক বাবা-মা: এক দম্পতি থেকে মানবজাতির উদ্ভব এমন বিশ্বাস সনাতন ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরাই লালন করেন। ইসলামের গ্রন্থে তাঁরা বাবা আদম ও মা হাওয়া আর সনাতন শাস্ত্রে আদম ও হব্যবতী (ভবিষ্যপুরাণ)।

৩. নূহ (আ.) ও রাজা মনুহ্: মহর্ষী মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক। তিনিই কোর’আনে বর্ণিত নূহ (আ.)। বৈদিক শাস্ত্রে তাকে বৈবস্বত্ব মনু, রাজা ন্যূহ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর উপরই আসে বেদের মূল অংশ। তাঁর সময়ে এক মহাপ্লাবন হয় যাতে কেবল তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একটি বড় নৌকায় আরোহণ করে রক্ষা পান। তাদের সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর এক জোড়া করে রক্ষা পায়। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে আবার মানবজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্যই হাদিসে নূহ (আ.) কে দ্বিতীয় আদম বলা হয়। মৎস্যপুরাণ ও মহাভারতেও এ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বৈবস্বত মনুর জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। সেই মহাপ্লাবনের পর এই মনু থেকেই মনুষ্যপ্রজাতির বিস্তার ঘটে। সনাতন ধর্মে মনুকেও মানবজাতির আদিপিতা বলা হয়।

৪. সনাতন ধর্ম ও দীনুল কাইয়্যেমাহ: ইসলামের এক নাম দীনুল কাইয়্যেমা। শব্দটি এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ শ্বাশ্বত, সুপ্রতিষ্ঠিত, চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। সনাতন অর্থও তাই। যে নীতি বা ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে সেটাই হচ্ছে সনাতন বা কাইয়্যেমাহ।

৫. দুই জীবন: উভয় ধর্মেই ইহকাল ও পরকাল, জান্নাত-জাহান্নামের ধারণা রয়েছে। ইসলাম বলছে জান্নাতে যাওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুলসিরাত পার হতে হবে, আর সনাতন ধর্ম বলছে বৈতরণী নদী পার হয়ে বৈকুণ্ঠে যেতে হবে।

৬. উপাসনা পদ্ধতি: উভয় ধর্মের উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেও অনেক মিল। কোরবানি ও বলিদান, সিয়াম পালন ও উপবাস, সুরা ও মন্ত্রপাঠ, যিকির ও যপতপ, হজ্ব ও তীর্থযাত্রা, সেজদা ও প্রণিপাত, তসবিহ ও যপমালা, উপাসনার ওয়াক্ত ও তিথি বা ত্রিসন্ধা ইত্যাদি বহুকিছু একই রকম।

৭. মালায়েক ও দেবদেবী: ইসলামে সৃষ্টিজগৎ পরিচালনার জন্য অসংখ্য ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে তেমনি হিন্দু ধর্মে আছে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। স্বভাবতই এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ আছে।

এরকম উদাহরণ হাজার হাজার দেওয়া যাবে। বেদ ও কোর’আনের যেসব বক্তব্য হুবহু এত সেগুলোর তালিকাও বিরাট লম্বা। মূল বিষয়ে এত মিল থাকা সত্ত্বেও এই দুটো সম্প্রদায় মিলতে পারছে না কিছু গৌণ বিষয় যেমন খাদ্যাভ্যাস, উপাসনাপদ্ধতি, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়ে। এক সময় এদেশের মুসলমানেরাও ধুতি পরত, কিন্তু ধুতিকে হিন্দুর পোশাক বলা হচ্ছে। কিন্তু আটকে গেছে ঐ তুচ্ছ বিষয়গুলোতেই। এখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত মুসলমানদেরকেই। কারণ আমাদের নবী কেবল আরবের নবী নন, তিনি বিশ্বনবী। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি সমগ্র পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে। আল্লাহ নিজেও পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, হে নবী আপনি বলুন, আমি তোমাদের সকলের জন্য (জামিয়া) আল্লাহর রসুল (সুরা আরাফ, ১৫৮)। তাঁর উপাধি রহমাতাল্লিল আলামীন বা সৃষ্টিজাহানের জন্য রহমত। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কোনো ভেদাভেদ রাখা হয় নি। এক সাহাবির উপর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, অচিরেই এমন সময় আসবে যখন একা একটা সুন্দরী মেয়ে সর্বাঙ্গে অলঙ্কারপরিহিত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে সা’না থেকে হাদরামাউত চলে যাবে, তার মনে আল্লাহ ও বন্য পশুর ভয় ছাড়া কোনো ভয় থাকবে না (খাব্বাব রা. থেকে বোখারি)। এখানে বলা হয় নি যে সেই কোন ধর্মের অনুসারী। কাজেই এটি পরিষ্কার যে, নবী এসেছেন সমগ্র মানবজাতির অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ দায়িত্ব আল্লাহই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরাই সেরা জাতি। তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে মানবজাতিকে ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (সুরা ইমরান, ১১০)। তাই সকল জাতি, ধর্মের মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বনী আদমকে এক কাতারে নিয়ে আসা উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব। এজন্যই এ দীনের অন্যতম একটি নীতিই হলো দীনের কোনো বিষয় নিয়ে জবরদস্তি বা বাড়াবাড়ি করা চলবে না।

মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত সকল নবী-রসুলদের প্রতি এবং আল্লাহর নাজেলকৃত সকল ধর্মগ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা। পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি প্রত্যেকটি জনপদে, প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের জন্য নবী পাঠিয়েছেন (সুরা ইউনুস ৪৮, সুরা রাদ ৮)। তাহলে এত বিরাট ও প্রাচীন জনপদ ভারতবর্ষে কি কোনো নবী আসেন নি, কোনো কেতাব আসে নি? অবশ্যই এসেছেন, তবে কালের আঘাতে তাদের শিক্ষাও বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের নবী হওয়ার ব্যাপারে ঈমান রাখাও মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। আল্লাহ নবী-রসুল পাঠিয়েছেন এক লক্ষ চব্বিশ হাজার অথবা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। তার মধ্যে কোর’আনে এসেছে মাত্র সাতাশ/আটাশ জনের নাম। বাকিদের অনুসারীরাও তো পৃথিবীতে আছেন, তাদেরকেও হেদায়াতের পথে আনার দায়িত্ব শেষ রসুল ও শেষ কেতাবের অনুসারী মুসলমানদের উপরই আল্লাহ অর্পণ করেছেন। শেষ ইসলাম প্রমাণ দিয়েছে কীভাবে সকল জাতিধর্মের মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা যায়।

কাজেই মুসলমানদের বেশি উদার হতে হবে। আল্লাহর দীনের ঘরের দরজা অনেক বড়। এ দরজা দিয়ে গোটা মানবজাতি প্রবেশ করবে। ঐ দরজার গোড়ায় নানা শর্তারোপ করে প্রবেশাধিকার সংকীর্ণ করা হবে আত্মঘাতী। কিন্তু গত কয়েক শতাব্দী এটাই করা হচ্ছে। শরিয়তের টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বাড়াবাড়ি আর জবরদস্তি করে ইসলামকে দুর্বোধ্য ও ভারী করে ফেলা হয়েছে।

তবে সাম্প্রদায়িক ঐক্য গঠনে হিন্দু সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব কম নয়। এটা চরম মূর্খতার পরিচয় যে আমরা এক স্রষ্টা থেকে আগত, এক জাতি, এক বাবা মায়ের সন্তান হয়েও এভাবে একে অপরকে বিধর্মী মনে করি। আমরা এক ভাই আরেক ভাইকে অশুচি অপবিত্র মনে করি। আচারের নামে এইসব অনাচার ধর্মের সৃষ্টি নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের সৃষ্টি। স্রষ্টা তো শুধু মসজিদে মন্দিরে চার্চে প্যাগোডায় থাকেন না। স্রষ্টা আর্ত-পীড়িত, নির্যাতিত মানুষের আর্তচিৎকারে ব্যথিত হন। অথচ ধর্মব্যবসায়ীরা অসহায় আর্ত মানবতার দেখভালের দায়িত্ব শয়তান, অত্যাচারী, ডেভিল, দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায়, প্যগোডায় ঢুকেছেন। তারা ধর্মকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব, উপাসনা, পূজা-প্রার্থনার বস্তুতে পরিণত করেছেন। তারা নবী-রসুল ও অবতারদের প্রাণান্তকর সংগ্রামকে অবজ্ঞা করে চলেছেন। তারা ধর্ম ত্যাগ করে লেবাসি ধার্মিকের ভেক ধরেছেন। তারা মানুষকে জানতে দিচ্ছেন না যে, সকল ধর্মে ধর্মব্যবসা নিষিদ্ধ। আমরা যারা প্রকৃতপক্ষেই স্রষ্টার সান্নিধ্য চাই, তাদেরকে বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোযা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মানুষের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সকল ধর্মের লক্ষ্য, সকল ধর্মের আত্মা। মানুষের কল্যাণসাধনই প্রকৃত এবাদত। যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন ভগবান ও দেবতারা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন।

আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোন মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোন ব্যক্তির অধিক নামায ও অধিক রোযা দেখে ভুল করো না, বরং লক্ষ্য করো সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না, তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা।’ (সিরাত বিশ্বকোষ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।

একই শিক্ষার প্রতিধ্বনী করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “কেহ ধার্মিক কি অধার্মিক পরীক্ষা করিতে হইলে দেখিতে হইবে, সে ব্যক্তি কতদূর নিঃস্বার্থ। যে অধিক নিঃস্বার্থ সে অধিক ধার্মিক। সে পণ্ডিতই হউক, মূর্খই হউক, সে শিবের বিষয় জানুক বা না জানুক সে অপর ব্যক্তি অপেক্ষা শিবের অধিকতর নিকটবর্তী। আর যদি কেহ স্বার্থপর হয়, সে যদি পৃথিবীতে যত দেবমন্দির আছে, সব দেখিয়া থাকে, সব তীর্থ দর্শন করিয়া থকে, সে যদি চিতা বাঘের মতো সাজিয়া বসিয়া থাকে, তাহা হইলেও সে শিব হইতে অনেক দূরে অবস্থিত (রামেশ্বর-মন্দিরে প্রদত্ত বক্তৃতা)।

এ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের আগে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা একটিও হয় নি। ব্রিটিশরা এখানে চালালো Divide and rule নীতি। তারা উভয়ের জন্য আলাদা স্কুল-কলেজ বানালো, আলাদা রাজনৈতিক দল বানালো, আলাদা হোটেল বানালো, কলেজে আলাদা হোস্টেল বানালো। তারা হিন্দুদেরকে শেখালো মুসলিমরা বিদেশি। এতদিন যে দেশে হিন্দু মুসলিম শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে সে দেশেই সৃষ্টি হলো রায়ট। লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানের লাশ পড়ল, বাড়ি পুড়ল, উদ্বাস্তু হলো। শেষতক দেশ ভাঙতে হলো। এ সবই হলো ব্রিটিশ বুদ্ধির ফল। হিন্দু মুসলমানের গলাগলির সম্পর্ক আজ গালাগালির সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী কীভাবে কাজে লাগায় সে তথ্যও সকলের জানা।

কিন্তু এই শত্রুতা আর কতদিন? এখনও কি সময় হয় নি শত্রুতা ভুলে নিজেদের সত্যিকার পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে আবার ভাই ভাই হয়ে যাওয়ার? এটা করার জন্য প্রয়োজন কেবল মানসিকতার পরিবর্তনের, প্রয়োজন সত্য সম্পর্কে জানার। এ দুটো জাতির মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির জন্য তাদেরকে একটি শিক্ষা দিতে হবে যে, ধর্ম কোনো আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়, ধর্ম হচ্ছে একটি বৈশিষ্ট্য যা কোনো বস্তু ধারণ করে। আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো, চুম্বকের ধর্ম আকর্ষণ করা। আগুন যদি না পোড়ায়, পানি যদি না ভেজায়, চুম্বক যদি না টানে তাহলে সে তার ধর্ম হারালো। তেমনি মানুষের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা। এই মানবতাবোধে মানুষকে জাগ্রত করার জন্যই নবী-রসুল-অবতারগণ যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন। তারা সত্য নিয়ে এসেছেন, যারা সেই সত্যকে ধারণ করেছেন তারাই হয়েছে ধার্মিক। যদি মানুষ সত্যকেই ধারণ না করে, মানবতাবোধে পূর্ণ না হয় সে যতই উপাসনা করুক সে ধর্মহীন। ইসলামের একটি নাম হচ্ছে দীনুল হক যার অর্থ সত্য জীবনব্যবস্থা। যে জীবনব্যবস্থা মানবজাতিকে সত্যে পূর্ণ করবে, ব্যক্তিকে সত্যাভিমুখী করবে সেটাই প্রকৃত ধর্ম। শেষ কেতাব আরবিতে এসেছে, কিন্তু সনাতন ধর্ম এসেছে সংস্কৃত ভাষায়। শেষ নবী আরবে এসেছেন, তাই কোর’আনও এসেছে আরবিতে। কিন্তু ভারতবর্ষের ধর্মগুলো এসেছে সংস্কৃত বা পালি ভাষায়। কিন্তু ভাষার পার্থক্য থাকলেও বক্তব্য এক। খালের পানি, নদীর পানি, সাগরের পানি, বৃষ্টির পানি সব পানিরই আণবিক গঠন অভিন্ন।

মুসলমানেরা যদি মনে করে আরবভূমি তাদের, হিন্দুরা যদি মনে করে ভারত কেবল তাদের, খ্রিষ্টানরা যদি মনে করে ইউরোপ শুধু তাদের, ইহুদিরা যদি মনে করে ফিলিস্তিন কেবল তাদের, বৌদ্ধরা যদি মনে করে মিয়ানমার কেবল তাদের তাহলে সেটা হবে চরম মূর্খতা হবে। কারণ পৃথিবী আল্লাহর, সমস্ত ভূমি আল্লাহর। মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই এই মাটির উপর অধিকার রয়েছে প্রত্যেক বনি আদমের। প্রতিটি মানুষ স্রষ্টার প্রতিভূ। সেই মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করে কেউ আল্লাহর, পরমাত্মার, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে না।

একইভাবে খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদিধর্ম, জরোথুস্ত্রীয় ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মও একই স্রষ্টা থেকে আগত, যদিও তাদের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। এদের সকলকেই তাদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে এক মহাজাতিতে পরিণত করা সম্ভব। তবে সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে একটা কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, এলি, ভগবান, পরমব্রহ্ম চান মানবজাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব। আর ইবলিস, শয়তান, এভিল স্পিরিট, ডেভিল, লুসিফার, আসুরিক শক্তি চায় মানুষে মানুষে অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ। প্রকৃত যারা ধার্মিক তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহর এই চাওয়াকে পূরণ করাই হলো ধর্ম।

এত কথার মূল উদ্দেশ্যটা আবারো বলছি, এ অঞ্চলে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যের মতো জঙ্গিবাদী তাণ্ডব সেভাবে এখনও বিস্তার লাভ করে নি, তবে সেই ষড়যন্ত্র চলছে। আর এই তাণ্ডবকে রুখে দিতে হলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে পরস্পরের দিকে ঐক্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। কেবল ঈদের দিনে মুসলমানে মুসলমানে কোলাকুলি আর পূজার দিনে হিন্দুতে হিন্দুতে আলিঙ্গন করলে হবে না। তাদের উভয়ের সঙ্গে উভয়েরই কোলাকুলি ও আলিঙ্গন করতে হবে। জানি না কবে আমরা ধর্মের নামে দাঁড়িয়ে থাকা অধর্মের এই প্রাচীরকে ভাঙতে পারবো, তবে এটা জানি সত্যের মোহনায় একদিন সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ এসে মিলিত হবে। সেদিন পরাজিত হবে ইবলিস শয়তান, সেদিন আল্লাহর বিজয় হবে। আল্লাহর বিজয় মানেই মানবতার বিজয়।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...