হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ঈমান নামক মহাশক্তির অপব্যবহার রোধ করার উপায়

রুফায়দাহ পন্নী

মানুষের ঈমান মহাশক্তিশালী চেতনা যা দিয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে, মানুষকে জান্নাতে নিতে পারে। কিন্তু যদি ঈমানদার ব্যক্তির ইসলাম সম্পর্কে আকিদা ভুল হয় তাহলে সেই ঈমানই ধ্বংসাত্মক ও ভয়ানক সঙ্কট সৃষ্টি করে। এজন্যই বোধহয় সমস্ত আলেমগণ একমত ছিলেন যে আকিদা সহিহ না হলে ঈমানের কোনো দাম নেই। এবং স্বভাবতই ঈমানের কোনো দাম না থাকলে ঈমানভিত্তিক আমলও মূল্যহীন হয়ে যায়। আকিদা সঠিক হওয়া এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলামের বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে হাজার হাজার বই রচনা করেছেন।

সংক্ষেপে আকিদা হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক সম্যক ধারণা, ইসলামের কোন কাজটি কেন করতে হয়, না করলে কী ক্ষতি হয় এটা বোঝা। এ জানলে একজন মানুষ বুঝতে পারবে যে ইসলামের কোন কাজটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি কম গুরুত্বপূর্ণ। এটা বোঝা যে আল্লাহ কি উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, নবী-রসুল পাঠিয়েছেন, কেতাব দিয়েছেন? সেটা কি দেখে দেখে পড়ার জন্য নাকি প্রতিষ্ঠা করার জন্য? ধর্ম আগমনের উদ্দেশ্য কী, মানব জীবনের সার্থকতা কী, কোন কাজটা সওয়াবের, কোন কাজটা গোনহের, কোনটা মানবতার কল্যাণ করবে কোনটা মানবতার ক্ষতি করবে, কোনটি করলে ব্যক্তির পরিশুদ্ধি আসবে, কোনটি করলে সমাজের পরিশুদ্ধি আসবে ইত্যাদি সামগ্রিক জানার নাম হল আকিদা। আল্লাহ স্বয়ং, তাঁর সমস্ত সৃষ্টি, জান্নাত-জাহান্নাম, হাশর, তকদির ইত্যাদি বিষয়গুলোও আকিদার আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। এই আকিদা সঠিক হওয়া প্রত্যেক মো’মেনের জন্য অপরিহার্য। তা না হলে ধর্মের কর্তৃপক্ষ দাবিদার স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বার বার মানুষের ঈমানকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে তাণ্ডবলীলা বাধিয়ে দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার করবে। দুঃখজনক এই দৃশ্য আমরা সারা দুনিয়ার ইতিহাসে ও বর্তমানেও দেখতে পাচ্ছি।

কিছুদিন পর পর আমাদের দেশে এমনই দাঙ্গাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে। ঈমানের দাবি পূরণ করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই পরিস্থিতিতে জড়িত জড়িত হয়ে যায়। এসব পরিস্থিতি সৃষ্টিতে প্রায়ই গুজব ব্যবহার করা হয়, মিথ্যা কথা, অর্ধসত্য এমন কি ডাহা মিথ্যা কথাও প্রচার করা হয়। অর্থাৎ যে কোনো প্রকারেই হোক একটি ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করা চাই-ই চাই। তাছাড়া দেশে যখন একটি প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থা আছে, আইন-আদালত আছে সেখানে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এভাবে তাণ্ডব সৃষ্টি করে দিলে ধর্মও রক্ষা হয় না, দেশও রক্ষা হয় না, ঈমানও রক্ষা হয় না। সবদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

আর এদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা একটি শ্লোগান চালু করেছেন যে, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। এটা নিয়ে তর্কে যাবো না। কিন্তু মনে রাখতে হবে সকল বস্তুর যেমন ধর্ম রয়েছে, রাষ্ট্রেরও একটি ধর্ম রয়েছে। কিন্তু সেটা প্রচলিত অর্থে ইসলাম-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ ধর্ম নয়। বস্তুর ধর্ম না থাকলে যেমন বস্তুর স্বতন্ত্র, অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি রাষ্ট্রও ধর্ম হারালে তার অস্তিত্ব থাকে না। ধর্ম মানে ধারণ করা। রাষ্ট্রের ধর্ম কী? সে কী ধারণ করবে। সেটা হচ্ছে ন্যায়। সে ন্যায়দণ্ড ধারণ করবে। যেটা ন্যায় সেটা দুর্বলতম ব্যক্তি বললেও সেটাকে ন্যায় বলে গ্রহণ করতে হবে, যেটা অন্যায় সেটাকে অন্যায় হিসাবেই প্রতিপন্ন করতে হবে সেটা যত বড় ক্ষমতাশালীই করুন না কেন। এই ন্যায়ধর্ম হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি। রাষ্ট্র যদি হুজুগ কিংবা একটি গোষ্ঠীর অনুভূতি দ্বারা চালিত হয়ে ন্যায়কে বিসর্জন দেয় তাহলে রাষ্ট্র সময়ের স্রোতে ধ্বসে যাবে।

কীভাবে? রাষ্ট্র যখন তার এই ন্যায় ধর্ম ত্যাগ করবে তখন জনগণ রাষ্ট্রের উপর আস্থা হারাবে। তখন আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হবে, ডাকাতকে পুলিশে না দিয়ে নিজেরাই মেরে ফেলবে। পৃথিবীতে যে রাষ্ট্রগুলো তার ন্যায়ধর্ম হারিয়েছে সেখানেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের আস্থা অর্জন ছাড়া কোনো রাষ্ট্র টিকতে পারে না। আর জনগণের আস্থা ফিরে পেতে হলে রাষ্ট্রকে তার ন্যায়বিচারের ধর্ম ধারণ করতেই হবে।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের সামষ্টিক অসন্তোষ প্রকাশের জন্য একটি মতবাদের ভাষা লাগে, একটি জ্বালামুখ লাগে। সমাজতন্ত্রের আদর্শের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল। সমাজতন্ত্রের পচন ও পতনের পর তাদের একটি অংশ হতাশাগ্রস্ত হয়ে সন্ত্রাসবাদের দিকে চলে যায়। ঠিক একই অবস্থায় ইসলাম রয়েছে কেন্দ্রবিন্দুতে। মুসলিম বিশ্বে পুঁজিবাদী শোষণ, ইসলামবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা ও সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশের অবলম্বন হিসাবে এখন ইসলামকে ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু এখানেও একটি অংশ মতবাদভিত্তিক সন্ত্রাস তথা জঙ্গিবাদ বা অনুভূতিবাদ।

রাষ্ট্র যদি ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান না হয় তাহলে কোনোভাবেই অসন্তোষের অগ্নুৎপাতকে ফেরাতে পারবে না, কোনো না কোনো ইস্যু দিয়ে সে তার জ্বালামুখ খুঁজে নেবেই। আজ রাষ্ট্রধর্ম তো কাল শিক্ষানীতি, পরশু ধর্ম অবমাননা ইত্যাদি। ইস্যুর কোনো অভাব হবে না, ইস্যুগুলো কেবল একটার পর একটা সৃষ্টি হতেই থাকবে। এই সব ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ও সহিংসতার মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্রকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। এভাবে তো বেশি দিন চলা যাবে না। আর এজন্য শুধু শুধু ধর্মকে দোষারোপ করে লাভ নেই, রাষ্ট্র ন্যায়দণ্ড ধারণ করুক, জাতি রক্ষা পাবে।

পাশাপাশি বর্তমানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হচ্ছে, সহিংসতার নিয়ামক হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কেবল নির্দিষ্ট একটি ধর্ম নয়, যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। আমাদের এখানে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম তাই এখানে ইসলামের নামে অরাজকতা সৃষ্টির পথ রোধ করতে হলে রাষ্ট্রের ন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীন হওয়ার পাশাপাশি ইসলামের প্রকৃত আকিদা সাধারণ জনগণকে অবগত করা খুবই জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমাদের সাধারণ জনগণের মধ্যে ইসলাম সম্বন্ধে প্রকৃত আকিদা নেই। ইসলামের নাম বলে একেকজন একেক দিকে তাদের ঈমানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একেক গোষ্ঠী একেকভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করছে। কেউ মানুষ হত্যা করাকে জেহাদ-কেতাল আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উদ্বুব্ধ করছে, কেউ কেউ রাজনীতিক স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার জনগণের ধর্মীয় চেতনাকে। যেভাবে হালভাঙা নৌকা মুহুর্মূহু স্রোতের টানে দিক পাল্টায় ঠিক সেভাবে কোর’আন হাদীসের উক্তি ব্যবহার করে যখন জনগণের সামনে কেউ তার প্রচারণা চালায় তখন ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঈমান বিভিন্ন দিকে ধাবিত হয়। তাদেরকে যেন এভাবে যে যেভাবে খুশি বিভিন্ন চোরাগলিতে টেনে নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য প্রয়োজন তাদেরকে ধর্মের প্রকৃত পথটি দেখিয়ে দেওয়া অর্থাৎ তাদের আকিদা ঠিক করে দেয়া। ধর্মের পূর্ণ ও প্রকৃত চিত্রটি তাদের সামনে তুলে ধরা। এখন এটা লাগবে। এটা যতদিন না করা হবে ততদিন মানুষ গুজব শুনে ধর্মরক্ষার জন্য উন্মাদিত হবে।

আমাদের অনুসরণীয় অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব কে? নিঃসন্দেহে আল্লাহর রসুল। আসুন দেখি তিনি কীভাবে মানুষের ঈমানকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করেছেন এবং মানুষের আকিদাকে বিকৃত হতে দেন নি। তিনি একজন সত্যনিষ্ঠ মহামানব ছিলেন যিনি তাঁর জীবনে কোনো কাজই মিথ্যার ভিত্তিতে, গুজবের ভিত্তিতে, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেন নি। মদীনায় তাঁর ৩ বছরের ছেলে ইব্রাহীম যেদিন ইন্তেকাল কোরলেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ হলো। আরবের নিরক্ষর, অনেকটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের মনে এই ধারণা হলো যে, যার ছেলে মারা যাওয়ায় সূর্যগ্রহণ হয়, তিনি তো নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুল, না হলে তাঁর ছেলের মৃত্যুতে কেন সূর্যগ্রহণ হবে। কাজেই চলো, আমরা তাঁর হাতে বায়াত নেই, তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নেই, তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করি। তাদের এ মনোভাব মুখে মুখে প্রচার হতে থাকল। আল্লাহর রসুল (সা.) যখন একথা শুনতে পেলেন, তিনি নিজ গৃহ থেকে বের হোয়ে লোকজন ডাকলেন এবং বললেন- “আমি শুনতে পেলাম তোমরা অনেকেই বলছ, আমার ছেলে ইব্রাহীমের ইন্তেকালের জন্য নাকি সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এ কথা ঠিক নয়। ইব্রাহীমকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন আর সূর্যগ্রহণ একটি প্রকৃতিক নিয়ম। এর সাথে ইব্রাহীমের মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই।” (হাদীস, মুগীরা ইবনে শো’বা ও আবু মাসুদ (রা:) থেকে বোখারী)।

এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক খেয়াল করুন। ঐ সময় মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড টানাপড়েন ও বিতর্ক চলছে যে তিনি আসলেই আল্লাহর রসুল কি রসুল নন। এমতাবস্থায় রসুলাল্লাহ কিছু না বলে যদি শুধু চুপ করে থাকতেন, কিছু নাও বলতেন, দেখা যেত অনেক লোক তাঁর উপর ঈমান এনে ইসলামে দাখিল হতো, তাঁর উম্মাহ বৃদ্ধি পেত – অর্থাৎ যে কাজের জন্য আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন সেই কাজে তিনি অনেকটা পথ অগ্রসর হয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, এসেছিলেন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে, তাই তিনি এতটুকুও আপোস করলেন না। এতে তাঁর নিজের ক্ষতি হলো। কিন্তু যেহেতু এ কথা সত্য নয় গুজব, সত্যের উপর দৃঢ় অবস্থান থাকার কারণে তিনি সেটিকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিলেন না। তিনি শক্তভাবে এর প্রতিবাদ করলেন, তিনি জনগনের ঈমানকে সঠিক করে দিলেন। নিজের স্বার্থে তাদের ঈমানকে ভুল খাতে প্রবাহিত করেন নি। তাহলে সেখানে তাঁর উম্মত দাবি করে মুসলিমরা কীভাবে হুজুগের সুযোগ গ্রহণ করে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক অভিসন্ধি হাসিল করতে পারেন? গুজবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে মো’মেনদেরকে আল্লাহ নিষেধ করেছে। আল্লাহ বলেছেন, কেউ যেন কারো উপর অপবাদ আরোপ না করে এবং কোনো দুষ্কৃতকারী ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসলে বিশ্বাস করার আগে যেন তা অবশ্যই যাচাই করে নেয় (সুরা হুজরাত-৬)।

সুতরাং ধর্মকে যদি কল্যাণকর কাজে, জাতির উন্নয়নে ব্যবহার করতে হয় তাহলে ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর ধর্ম সম্পর্কে ধারণা, আকিদা সঠিক করতে হবে এবং পাশাপাশি সরকারকে সর্ব বিষয়ে ন্যায়ের ভিত্তিতে দণ্ডায়মান হতে হবে। অন্যথায় জাতি ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে এবং সেটা থেকে উত্তরণের সময় থাকবে না একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিশেষ করে যখন আমাদের সামনে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ রয়েছে তখন এই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে বলে হেযবুত তওহীদ মনে করে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...