মানবজাতির জীবনে কালের প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। হাজার হাজার বছর থেকে তাই সমসাময়িক যুগের জ্ঞানী মানুষেরা সময়ের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করে আসছে। কিন্তু বর্তমান সমাজের বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে এই কালের প্রভাব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। কালের যে প্রভাব রয়েছে এবং কালের অধ্যয়ন থেকে প্রাপ্ত উপলব্ধি জাতির ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারে সে সম্পর্কে আজ তারা যেন অনবহিত।ব্রিটিশদের দুশো বছরের ঔপনিবেশিক যুগে আমরা যতটা না শাসিত হয়েছি তার চেয়ে বেশি শোষিত হয়েছি। ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে স্বার্থপর আত্মপূজারী করেছে এবং তাদেরই প্রবর্তিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে আমরা অর্থ উপার্জনকে আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। এর ফলে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকেই বার্ধক্য পর্যন্ত শুধু অর্থের পিছনে দৌড়াচ্ছি। এর ফলে আমাদের আর কোন জিনিস নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। কালের চিন্তা এবং সমাজের চিন্তা করার মত অবকাশ পাওয়া তো দুষ্কর ব্যাপার।
মুসলিম জতিকে এখন কাল নিয়ে চিন্তা করতে হবে। তাদের ভাবতে হবে তাদের গৌরবময় অতীতের কথা। যে সময় একজন নারী সমস্ত শরীরে স্বর্ণালঙ্কার পরে নির্বিঘ্নে শত শত মাইল পথ একা চলে যেত সেই সময়ের নিরাপত্তার কথা। ভাবতে হবে যখন যাকাত নেয়ার মতো কোন লোক ছিলো না সেই সময়ের কথা। আজও তো আমরা নিজেদের ইসলামের অনুসারী দাবি করি, তাহলে কোথায় আজ সেই নিরাপত্তা? কোথায় আজ সেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা? ভাবতে হবে মুসলিম জতিকে। কোন সে জাদুমন্ত্র যার প্রভাবে জাতির অতীত হয়ে উঠেছিলো গৌরবময়?আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলকে যে সময়টিতে মক্কায় প্রেরণ করলেন সেই সময়টিকে বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়াত। তিনি সেই অন্ধকার যুগের মানুষগুলোর কাছে তওহীদের দাওয়াত পৌঁছে দেন। কিন্তু মিথ্যা বংশগরিমা এবং গোত্রীয় প্রভাবের অহংকারে মক্কার নেতারা সেই সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে রসুলাল্লাহকে মিথ্যাবাদী, জাদুকর ইত্যাদি বলে তিরস্কার করে এবং তাঁকেসহ তাঁর সাহাবীদের উপরও চরম নির্যাতন চালায়।
কিন্তু মদীনার লোকেরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। তিনি সেখানে গিয়ে একটি ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করেন যারা পরবর্তী কয়েক যুগে বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম পরাশক্তিতে পরিণত হয় এবং সর্ববিষয়ে সকল জাতির মধ্যে মহান জাতি হিসাবে পরিচিত হয়। আল্লাহর রাসুলের এই সাফল্যের মূলে ছিল একটি কথা- লা ইলাহা ইলল্লালল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর ছাড়া কারোও হুকুম মানি না এবং এই কথাটির অধীনে সমগ্র মানবজাতিকে সমবেত করার সংগ্রাম করা। এর দ্বারা তারা হয়েছিল মো’মেন, আর মো’মেনকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠত্ব দিবেন এটা তো তাঁরই প্রতিশ্রুতি। তাই মুসলিম জাতির এখন কর্তব্য কী করে সেই স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ইতিহাসকে মূল্যায়ন করা।
মুসলিম জাতি বর্তমানে হাজারো চেষ্টা করেও তাদের আর্থসামাজিক সংকটের কোনো সমাধান করতে পারছে না, কারণ তারা এখনও তাদের জাতীয় জীবনে পাশ্চাত্যের দাজ্জালীয় সভ্যতার দাসত্ব করে যাচ্ছে, প্রতিটি বিষয়ে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। তাদের যে আসলে অন্যের থেকে কিছুই ধার নেওয়ার প্রয়োজন নেই, তারা যে স্বনির্ভর হতে পারে এ কথাটি এখন তারা নিজেরাও বিশ্বাস করে না। মনে রাখতে হবে যে জাতি অতীতের শিক্ষাকে কাজে লাগায় না তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ উভয়ই ব্যর্থতার চাদরে ঢাকা পড়ে যায়। আমাদের অতীত গৌরব নিয়ে কেবল আত্মপ্রসাদ লাভ করলে চলবে না, আমাদের বর্তমানকে পরিবর্তন করার জন্য যেভাবে নবী করিম (সা.) একটি সত্যনিষ্ঠ জাতি গঠন করেছিলেন এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদেরকে কোরবান করেছিলেন আমাদেরকেও সেটাই করতে হবে। নয় তো আমাদের ভবিষ্যৎ আরো ভয়াবহ হবে।