হেযবুত তওহীদ যে কথাই বলে তা একদিকে যেমন যুক্তির নিরীখে বলে, অপরদিকে তার পড়্গে কোর’আন হাদিস বা ইতিহাসের দলিলও পেশ করে। ফলে কেউই আজ পর্যন্ত আমাদের একটি বক্তব্যও পারে নি। মানুষ তার অভ্যস্ত বিশ্বাসে এতটাই যুক্তিহীন থাকে যে এর বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্যকে গ্রহণ করে নেওয়া তার জন্য খুব কঠিন। বিশেষ করে ধর্মান্ধ শ্রেণির মানুষের পক্ষে এই কাজ একেবারেই অসম্ভব। তারা অপর কারো বক্তব্য যাচাই বাছাই করার চিন্তাও করবে না। হেযবুত তওহীদের বক্তব্যের বিরোধিতা করার কোনো যুক্তি না পেয়ে এই শ্রেণির লোকেরা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, আপনি কি মাদ্রাসায় পড়েছেন? মাদ্রাসায় না পড়ে ইসলামের কথা বলতে আসছেন কেন?
অর্থাৎ হেযবুত তওহীদের বক্তব্যের কোনো জবাব তাদের কাছে নাই। কিন্তু সত্যটা মেনে নিতেও পারছেন না, কারণ তা নিজের অভ্যস্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সুতরাং যে কোনো একটা কিছু বলে লোকটার মুখ বন্ধ করে দাও। যাহোক, এই প্রশ্ন যতই অবাস্ত হোক না কেন এমন প্রশ্নকর্তার সংখ্যা কিন্তু অগণিত। হয়তো ভাবছেন তারা অশিক্ষত বা মাদ্রাসার লোক? না। তারা অনেকেই আছে সাধারণ শিড়্গায় উচ্চ শিক্ষতী, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ধর্মের বিষয়ে গেলে তারাও সমান অন্ধ। এমন এমন কথা বলতে থাকেন যার মধ্যে কোনো যুক্তিবুদ্ধি বা চিন্তার ছাপও থাকে না। ধর্ম সম্পর্কে তাদের অনেকেরই অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা দুটোই সীমাহীন। ভাবখানা এমন যে অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয় নিয়ে এত গবেষণার সময় কই? এই বিশ্বাস তাদের মগজে প্রথিত যে ইসলামের কথা বলবেন কেবল মাদ্রাসাশিক্ষত লোকেরা। এর বাইরে কারো ইসলামের কথা বলা সঙ্গত নয়। তারা হবে মাদ্রাসাশিক্ষতিদের অন্ধ অনুসারী, ব্যাস।
হেযবুত তওহীদ তাদের এই ধ্যান-ধারণাকে সমর্থন করে না। আমাদের কথা হচ্ছে, আমাদের আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী একজন চিকিৎসক যিনি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তিনি নিজে প্রচুর পড়াশুনা করেও অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। আর বর্তমান এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্ততকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা দুজনেই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষতি। এই কারণ দর্শিয়ে বহু মানুষ তাঁদের কথাকেই নাকোচ করে দেন। তারা কোর’আনের আয়াত পড়ে পড়ে শোনালেও বলেন, উনি কোর’আন পড়বেন কেন? উনি ইসলামের কী বুঝেন? উনি কি মাদ্রাসায় পড়েছেন? এক কথায় তাদের ইসলামের কথা বলার অধিকারই নেই। হেযবুত তওহীদের অধিকাংশ সদস্যও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষতি। আমরা দীনের দাওয়াত দিব এটা কথিত আলেম ওলামাদের কাছে একদমই গ্রহণযোগ্য না। তারা একবাক্যে বলে দেন যে- অতএব বোঝা গেল, হেযবুত তওহীদ একটি বাতিল ফেরকা। অথচ আলস্নাহ তা’আলা কোর’আনে বলেন, “ঐ ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে, যে আল্লাহর পথে আহ্বান করে এবং সৎ আমল করে। আর বলে নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।” (সুরা হা-মিম-সিজদাহ: ৩৩)। সুতরাং মুসলিম হলেই সে আল্লাহর পথে আহ্বান করার অধিকারী। এখানে মাদ্রাসায় পড়ার কোনো শর্ত রাখা হয় নি।
ইসলামকে আল্লাহর বলেন সহজ সরল দীন। এটি ঐতিহাসিক সত্য যে আলস্নাহর রসুল পড়তে ও লিখতে জানতেন না। তাঁর মাধ্যমে আরবের জ্ঞানহীন মানুষগুলোও ইসলাম বুঝেছিলেন, ইসলাম ধারণ করেছিলেন এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐ নিক্ষর মানুষগুলো যদি ১৪শ’ বছর আগে অর্ধ দুনিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করে যেতেন, তাহলে আজকে যারা মাদ্রাসায় পড়ার অহঙ্কার করছেন বা মাদ্রাসায় পড়াকে ইসলাম প্রচারের শর্ত বানিয়ে নিয়েছেন, তারা কেউ হতেন হিন্দু, কেউ হতেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষগুলোর কল্যাণেই আজকে আমরা নিজেদেরকে শেষ নবীর উম্মত হওয়ার দাবি তুলতে পারছি।
সুতরাং বোঝা গেল একমাত্র মষ্কবিকৃত মানুষ ছাড়া সকলেই ইসলাম শিক্ষার করতে পারে, চর্চা করতে পারে। তাছাড়া মহানবী (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ (হাদিস: আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, সুনানে ইবনে মাজাহ)। এর মধ্যে জাগতিক জ্ঞান ও ইসলামের জ্ঞান উভয়ই অত্মর্ভুক্ত। প্রকৃত ইসলামের যুগে মসজিদে যেমন সালাহ কায়েম হতো, তেমনি মুসুলিস্নদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহের জন্য বিধিবিধানও এখান থেকেই লোকেরা শিখে যেত। আলাদা করে কাউকে মাদ্রাসায় গিয়ে ২০ বছর ধরে মাসলা-মাসায়েল শিখতে হতো না।
কিন্তু পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা যখন লুপ্ত হয়ে গেল তখন আল্লাহ ও জনগণের মাঝখানে এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি গজিয়ে উঠল। এই শ্রেণিটিই ইসলামের মধ্যে পুরোহিততন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। তারা জীবন চালানোর জন্য জরুরি উলিস্নখিত সাধারণ জ্ঞানগুলোও মানুষকে দান করছে না। ফলে আমাদেরকে ধর্মীয় ব্যাপারে বাধ্য হয়েই তাদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ইসলামের প্রতিটি বিষয়কে নিয়ে তারা বাড়াবাড়ি করে হাজার রকমের মাসলা মাসায়েল বের করে সহজ সরল ইসলামকে একটি জটিল ধর্মে পরিণত করেছে যা শিক্ষার করতে একজন মানুষকে তার জীবনের দেড় দুই যুগ পার করে দিতে হবে। সুতরাং সেটা সবার পক্ষে অসম্ভব।
ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবনদর্শন যা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। শেষ নবী কোনো গোত্রীয় নবী নন, তিনি বিশ্বনবী (সুরা আরাফ ১৫৮)। কাজেই তাঁর আনীত দীন ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট পুরোহিত শ্রেণির কুক্ষগিত থাকতে পারে না। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম কয়েকশ বছর এই শ্রেণির কোনো অস্তত্বই ছিল না। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি শুধুমাত্র ধর্মের কথা বলবে আর অন্যরা বলতে পারবে না- এই নীতি যে ইসলামের নীতি নয় এটা কেবল আমাদের দাবি নয়, ইসলামী বিশ্বকোষও এ কথাই বলছে। এতে ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে বলা হয়েছে, “ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো নবী অতি-মানব নহেন, তাঁহার কোনো উত্তরাধিকারী ধর্মাধিকরণরূপে অভ্রাত্ব (Infallible) বিধান দেওয়ার কোনো অধিকার লাভ করে না, অনুসারীর পাপ মোচনের ড়্গমতা অর্জন করে না। পৌরোহিত্য বা যাজকত্বের স্থান ইসলামে নাই। সুতরাং Theocracy (মোলস্নাতন্ত্র)-ও ইসলামে অবাšত্মর। ধর্মপু¯ত্মক অর্থাৎ কোর’আনের অধ্যয়ন এবং ইহার ব্যাখ্যা দান কোনো Consecrated সম্প্রদায়ের বা কোনো বর্ণের বিশেষ ইখ্তিয়ারভুক্ত নহে। বরং ইবাদাত এবং নীতিনিষ্ঠ জীবনের প্রয়োজনে কিছুটা কোর’আন শিক্ষার প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, এই বিবেচনায় ইসলাম বাধ্যতামূলক শিক্ষার-নীতির প্রবর্তক।” (সংক্ষীপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম খ- ১৯৪ পৃ, ইসলাম অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)।
ইসলামে জ্ঞান অর্জন ফরদ মানেই অন্ধত্ব হারাম, নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই জ্ঞান কুড়্গগিত হয়ে যাওয়ার কারণে আজ এই ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতি ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। মুসলিম সমাজের প্রত্যেককে কোর’আনের প-িত হতে হবে, ফকিহ মুফতি হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু জীবন চালাতে প্রয়োজন পড়ে এমন বিষয়গুলো সম্পর্কে মুসলিমদের আল্লাহর আদেশ নিষেধ, সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে জানতে হবে। যেমন যে ব্যবসা করবে তাকে অবশ্যই জানতে হবে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়ার বিধিনিষেধগুলো কী কী। যে বিয়ে করবে তাকে অবশ্যই বিয়ের ক্ষেত্র আল্লাহর দেওয়া বিধানগুলো জানতে হবে। এই জ্ঞানগুলো অর্জন করাই বাধ্যতামূলক। ইসলামী বিশ্বকোষে এটাই বলা হয়েছে যে, কোর’আন অধ্যয়ন এবং ব্যাখ্যা দান কোনো পৃথক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের এখতিয়ারভুক্ত নয়। এর অধ্যয়ন, শিক্ষার ও প্রচার প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। কাজেই আমরা মাদ্রাসায় পড়িনি বলে ইসলামের কথা বলতে পারব না, তাদের এমন বক্তব্য অমূলক, হাস্যকর।