হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মক্কার মোশরেকদের ধর্মপালন ও বর্তমান মুসলমান

রিয়াদুল হাসান

বর্তমানে বিকৃত এসলামের অনুসারীদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস অর্থাৎ আকীদা হচ্ছে এই যে, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ.) যাদের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন অর্থাৎ তদানিন্তন আরববাসীরা আল্লাহকে বিশ্বাস করত না, তাদের আল্লাহর ওপর ঈমান ছিল না। এই ধারণা সম্পুর্ণ ভুল। তখনকার আরবরা বিশ্বাস করত যে তারা আল্লাহর নবী ইব্রাহীমের (আ.) উম্মাহ। তারা নিজেদের ‘হানীফ’ বলতো। হানীফ অর্থ একাগ্র। অর্থাৎ তারা তওহীদ এবং ইব্রাহীমের (আ.) একাগ্র অনুসারী। সুতরাং তদানিন্তন আরববাসীরা আল্লাহকে তেমনই বিশ্বাস করত যেমন বর্তমানের পৃথিবীময় মুসলিম বলে পরিচিত লোকেরা এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরা বিশ্বাস করে। ঐ আরবরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে, পালনকারী বলে বিশ্বাস করত, নামাজ পোড়তো, কাবা শরীফকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত, ঐ কাবাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক হজ্ব করত, কোরবানি করত, রোযা রাখতো, আল্লাহর নামে কসম করত, নিজেদের সন্তানদের নাম আব্দুল্লাহ (আল্লাহর দাস) রাখতো, এমনকি বর্তমান সময়ের ‘মুসলিমদের’ মতো খাত্নাও করত। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে শাদীর কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আমরা যেমন বেসমেল্লাহ লেখি তেমনি তারাও আল্লাহর নাম লিখতো। তারা লিখতো বেস্মেকা আল্লাহুম্মা, অর্থাৎ তোমার নাম নিয়ে (আরম্ভ কোরছি) হে আল্লাহ। নবুয়াত পাবার আগে মহানবীর সঙ্গে আম্মা খাদীজার (রা.) বিয়ের যে কাবিন লেখা হয়েছিল তা লিখেছিল আরবের লোকেরা যাদের আমরা এখন কাফের মোশরেক বলি এবং তা তারা শুরু করেছিল আল্লাহর নাম দিয়ে। তওহীদের  ডাক দেবার ‘অপরাধে’ আল্লাহর রসুলকে তাঁর পরিবার পরিজন ও আসহাবসহ মক্কার বাইরে উত্তপ্ত উপত্যকায় নির্বাসন দেবার জন্য যে বিজ্ঞপ্তি মোশরেক কোরায়েশ নেতারা সর্বসাধারণের জানার জন্য পবিত্র কাবার দরজার ওপর ঝুলিয়ে দিয়েছিল সে বিজ্ঞপ্তির প্রথমেই তারা লিখেছিল- বেসমেকা আল্লাহুম্মা। হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র লেখার সময় আলী (রা.) যখন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ দিয়ে আরম্ভ করলেন তখন মোশরেক কোরায়েশদের প্রতিনিধি সুহায়েল বিন্ আমর প্রতিবাদ করে বলল, আমরা এ রকম করে লেখি না, আমরা যে ভাবে আল্লাহর নাম লেখি ঐ ভাবে লিখতে হবে, অর্থাৎ বেস্মেকা আল্লাহুম্মা। তখন আল্লাহর রসুলের আদেশে আলী (রা.) ঐ ভাবেই লিখলেন। এগুলো ঐতিহাসিক প্রমাণ।

আরবের মোশরেকরা যে আমাদের মতই আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিল এ কথায় সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের (আরবের মোশরেক, কাফের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (সুরা যুখরুফ- ৯)। অন্যত্র বলেছেন- তুমি যদি তাদের প্রশ্ন করো আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন এবং কে সূর্য ও চন্দ্রকে তাদের (কর্তব্য কাজে) নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, তবে তারা নিশ্চয়ই জবাব দেবে- আল্লাহ (সুরা আনকাবুত- ৬১)। আল্লাহ আবার বলছেন- যদি তাদের প্রশ্ন করো, কে এই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তবে তারা নিশ্চয়ই জবাব দেবে আল্লাহ (সুরা লোকমান- ২৫)। আল্লাহ তাঁর নবীকে আবার বলছেন ঐ মোশরেকদের প্রশ্ন করতে (পানির অভাবে শুকিয়ে, ফেটে যেয়ে) মাটি যখন মরে যায়, তখন আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে কে তাকে পুনর্জীবন দান করেন- তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- আল্লাহ (সুরা আনকাবুত- ৬৩)। আল্লাহ তাঁর নবীকে আবার বলছেন, ‘এই পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যারা আছে তারা কার? যদি তোমরা জানো তবে বলো। তারা বলবে, ‘সবই আল্লাহর।’ (সূরা মুমিনুন ৮৪-৮৫)। ইতিহাস ও আল্লাহর সাক্ষ্য, দু’টো থেকেই দেখা যায় যে, যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর রসুল প্রেরিত হলেন তারা আল্লাহকে গভীর ভাবে বিশ্বাস করত অর্থাৎ আল্লাহর ওপর তাদের ঈমান ছিল। সে সময় বৃহত্তর জনসাধারণকে ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মের কর্তৃপক্ষ সেজে একদল লোক জনসাধারণের মধ্যে ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করে নিজেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। যেমন আবু জাহেল ছিল আরবের মধ্যে একজন প্রখ্যাত ‘আলেম’। এজন্য তাকে ডাকা হতো আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানীদের পিতা। বর্তমানেও পৃথিবীর সর্বত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ধর্মকে জীবিকা উপার্জনের পুুঁজি হিসাবে ব্যবহারকারী একটি শ্রেণি রয়েছেন। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও ধর্মীয় যে কোন বিষয়ে তাদের উপর নির্ভর করে থাকে। একেবারে মক্কার অবস্থা।

তাহলে আজ মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি (কোন উম্মাহ নয়) যে দীনটাকে পালন করে নিজেদের মো’মেন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে বিশ্বাস করে এবং মৃত্যুর পর জান্নাতে যাবার আশা করে ঐ জনসংখ্যাটি এবং আরবের ঐ মোশরেকদের জাতিটি যার মধ্যে তাদের হেদায়াহর জন্য আল্লাহ তাঁর রসুল প্রেরণ করলেন এ দু’টোর মধ্যে প্রভেদ কোথায়? কথাটা আরও পরিষ্কার কোরছি। বর্তমানের এই দীন পাঁচটি রোকনের (স্তম্ভ) ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এ কথায় কোন সন্দেহ আছে কি? অবশ্যই নয়; এবং সেগুলি হলো- ১) কলেমা, ২) সালাহ (নামায), ৩) যাকাহ, ৪) হজ্ব, ৫) সওম (রোযা)। যারা এগুলির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে ওগুলি পালন করেন তাদের বলা হয় মো’মেন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী। এখন দেখা যাক তদানীন্তন আরবদের সাথে অমিল কোথায়।

১) কলেমা। বর্তমানের এই মুসলিম বলে পরিচিত জনসংখ্যা বিশ্বাস করে আল্লাহ এক, তিনি উপাস্য, তিনি স্রষ্টা, তিনি রক্ষাকর্তা, তিনি রব অর্থাৎ ভরণ-পোষণকারী, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি পরম দয়ালু, পরম ক্ষমাশীল ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। ঐ সময়ের আরবরাও ঠিক এই কথাই বিশ্বাস করত যার প্রমাণ উপরে দিয়ে এসেছি।

২) সালাহ (নামায)। মুসলিম বলে পরিচিত বর্তমানের এই জনসংখ্যার মত ঐ মোশরেক আরবরাও আল্লাহর ঘর কাবার দিকে মুখ করে সালাহ কায়েম করত এ কথা ইতিহাস। আল্লাহর রসুলের ক্রীতদাস, পরে মুক্ত ও তাঁর সন্তান হিসাবে গৃহীত যায়েদকে (রা.) খুঁজতে খুঁজতে তার বাপ-চাচারা যখন শুনতে পেলেন যে যায়েদ (রা.) মক্কায় মোহাম্মদ (দ.) নামের একজন লোকের কাছে আছে যিনি আল্লাহর নবী হবার দাবী করছেন। এ খবর শুনে তারা উত্তর আরব থেকে মক্কায় এসে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন- আমরা মোহাম্মদ (দ.) নামের একজন লোককে খুঁজছি, তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে। লোকজন বলল- নামাযের সময় কাবায় যাবেন, দেখবেন একজন লোক অন্য সব নামাযী থেকে বিচ্ছিন্ন, আলাদা হয়ে একা নামায পড়ছেন, তিনিই আপনারা যাকে খুঁজছেন তিনি, মোহাম্মদ (দ.); অর্থাৎ মক্কার মোশরেকরা কাবার দিকে মুখ করে জামাতে সালাহ (নামায) কায়েম করত। অবশ্য ঐ সালাহ আল্লাহর নবী এবরাহীমের (আ.) শেখানো পদ্ধতির ছিল, শেষ রসুলাল্লাহর পদ্ধতিতে ছিল না। বর্তমানের সালাতের এই নিয়ম পদ্ধতি পরে এসেছে। আরবের কাফের মোশরেকরা বিকৃতভাবে হলেও সালাহ (নামাজ) করত তার প্রমাণ আল্লাহ পবিত্র কোর’আনেও দিচ্ছেন, “তাদের (জাহেলী যুগের) নামায তো কিছু শিষ দেয়া ও তালি বাজানো ছাড়া কিছুই ছিল না” [সূরা আল আনফাল ৮-৩৫]।

৩) যাকাহ। যে উদ্দেশ্যে যাকাহ দেওয়া অর্থাৎ নিজের উপার্জিত অর্থ থেকে সমাজের অন্য দুঃস্থ, গরিব বা অন্যের প্রয়োজন পূর্ণ করতে সাহায্য দেয়া সে অর্থে ঐ মোশরেকরাও তাদের উপার্জিত সম্পদ থেকে বহু দান-খয়রাত করত, এটাও ইতিহাস। তাদের মধ্যে হাতেম তাঈ’র মত আরো অনেক দানশীল ছিল। আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলের মাধ্যমে সেই অনিয়মিত, ইচ্ছাকৃত দানকে একটা শৃংখলার (Discipline) মধ্যে এনে এটাকে শতকরা আড়াই (২১/২) ভাগে নিবন্ধন করেছেন।

৪) হজ্ব। এ কথা ইতিহাস যে তদানিন্তন মোশরেক আরবরা বছরে একবার কাবাকে কেন্দ্র করে হজ্ব পালন করত। হজ্বের প্রচলন শুরু হয় ইব্রাহীম (আ:) এর মাধ্যমে। তাদের হজ্বের সময়, মাস, তারিখ, নিয়ম কানুন প্রায় বর্তমানের হজ্বের মতই ছিল। পার্থক্য হলো, তারা উলংগ হয়ে হজ্ব করত কারণ হাশরের ময়দানে সমস্ত নারী-পুরুষ উলংগ থাকবে। এসলাম এসে দু’টুকরো সেলাইহীন কাপড় দিয়ে সেটাকে শালীন করেছে। নবী করীম (দ:) কাফেরদের এই হজ্বের সময় হাজীদের তাবুতে তাবুতে গিয়ে তওহীদের বালাগ দিয়েছেন।

৫) সওম (রোযা)। তখনকার মোশরেকরাও বর্তমানের দীনের মতই রমাদান মাসেই একমাস সওম (রোযা) পালন করত।

তাহলে যাদের মধ্যে আল্লাহর রসুল তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আসলেন তাদের সাথে বর্তমানের মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যার তফাৎ কোথায়? যদি বলেন যে তারা মূর্তিপূজা করত তবে তার জবাব হচ্ছে এই যে ঐ মোশরেক আরবরা ঐ মূর্তিগুলোকে আল্লাহ বলে বিশ্বাস করত না, তাদের স্রষ্টা বলেও বিশ্বাস করত না, তাদের প্রভু (রব) বলেও বিশ্বাস করত না। একটু আগেই কোর’আনের যে আয়াতগুলির উদ্ধৃতি দিয়েছি যেগুলোয় আল্লাহ তাঁর রসুলকে বলছেন তাদের প্রশ্ন করতে, মোশরেকদের জবাব থেকেই, যে জবাবগুলি আল্লাহ স্বয়ং দিচ্ছেন মোশরেকদের পক্ষ থেকে তা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তাহলে আরবদের কাছে ঐ মূর্তিগুলি কী ছিল? তাদের কাছে ঐ মূর্তিগুলি আল্লাহ ছিল না, তারা বিশ্বাস করত ওগুলি আল্লাহর নিকটবর্তী, ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়জন। তারা ওগুলির পূজা করত দু’টো কারণে- এক) যেহেতু ওগুলো আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সেহেতু তারা পূজারীদের পক্ষ হয়ে কোন ব্যাপারে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করলে আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন। যেমন রোগÑশোক থেকে মুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্য, কোন বিপদ থেকে উদ্ধার ইত্যাদি। এ কথার প্রমাণ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ বলছেন, তারা আল্লাহ ব্যতীত যার এবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এইগুলি আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’ (সুরা ইউনুস ১৮)। দুই) তারা বিশ্বাস করত যে যেহেতু ঐ মূর্তিগুলি, ঐ দেব-দেবীগুলি আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় কাজেই তাদের পূজা করে তাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তারা পূজারীদের আল্লাহর সান্নিধ্য (কুরবিয়াহ্) এনে দেবে। এ ব্যাপারেও আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে’ (সুরা যুমার ৩) দেখা যাচ্ছে আরব মোশরেকদের মূর্তিপূজার পেছনে দু’টো উদ্দেশ্য ছিল, একটি দুনিয়াদারী, অন্যটি আখেরাত- অনেকটা আমাদের সমাজে পীরদের কাছে মানুষ যে উদ্দেশ্যে যেয়ে থাকে। সুতরাং ঐ মূর্তিগুলিকে আরবের মোশরেকরা কখনই আল্লাহর স্থানে বসায় নাই।

এখন বিরাট প্রশ্ন হল এই যে- আল্লাহর কোর’আন মোতাবেকই তদানিন্তন আরবের অধিবাসীরা যদি আল্লাহতে বিশ্বাসী হয়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে তারা কাবাকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত, কাবার দিকে মুখ করে নামায পড়তো, রোযা রাখতো, সেই ঘরে এসে হজ্ব করত, কোরবানি করত, আল্লাহর নামে কসম করত, প্রতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আল্লাহর নামে আরম্ভ করত, তবে তাদের মধ্যে নবী পাঠিয়ে তাদের হেদায়েত করার প্রয়োজন হলো কেন? এবং আল্লাহর নবী এসে এদেরকে কলেমা অর্থাৎ তওহীদের ডাক দিলেন কেন? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে, আরবের মোশরেক অধিবাসীরা আল্লাহকে খুবই বিশ্বাস করত, আজ যেমন আমরা করি, কিন্তু তাদের মধ্যে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ’ ছিল না। তাদের সার্বভৌম, ইলাহ ছিল কাবা ঘরের অভিভাবক, কোরায়েশরা। তাদের দীন ছিল কোরায়েশরা যে সিদ্ধান্ত দেবে তা পালন করা। আল্লাহর দেয়া দীন, জীবন-বিধান মোতাবেক তাদের সমষ্টিগত জাতীয় জীবন পরিচালনা করত না। তাদের সামাজিক, জাতীয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দণ্ডবিধি এ সমস্তই পরিচালিত হতো হাবল, লা’ত, মানাত ও ওজ্জার কোরায়েশ পুরোহিতদের তৈরী করা আইন-কানুন ও নিয়ম দিয়ে। তারা বুঝতো না যে আল্লাহকে যতোই বিশ্বাস করা হোক, ব্যক্তিগতভাবে যতোই কঠিন এবাদত করা হোক, যতোই তাক্ওয়া করা হোক, জাতীয় জীবন আল্লাহর দেওয়া দীন, আইন- কানুন, দণ্ডবিধি অর্থনীতি দিয়ে পরিচালিত না হলে সেটা আল্লাহর তওহীদ হবে না, সেটা হবে র্শেক ও কুফর। কাজেই আল্লাহর ওপর ও ইব্রাহীমের (আ.) নবুওতের ওপর পূর্ণ ঈমান থাকলেও, কাবাকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করলেও, সেই কাবার দিকে মুখ করে নামায পোড়লেও, হজ্ব করলেও, কাবাকে তওয়াফ করলেও, আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করলেও, রমাদান মাসে রোযা রাখলেও, খাত্না করলেও, প্রতি কাজ আল্লাহর নাম নিয়ে আরম্ভ করলেও আরবরা মোশরেক ও কাফের ছিল। তাদের প্রকৃত তওহীদে সর্বব্যাপী তওহীদে আনার জন্যই আল্লাহর রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। আজ এই জাতির পথভ্রষ্টতার সাংঘাতিক ভুলের একমাত্র কারণ হচ্ছে কলেমার, ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ’র ইলাহ শব্দের অর্থকে বদলিয়ে মা’বুদ অর্থাৎ উপাস্য করা। অর্থাৎ আল্লাহ একমাত্র ‘আদেশদাতা, সার্বভৌম’ থেকে বদলিয়ে একমাত্র ‘উপাস্যে’ পরিণত করা যা আরবের মোশরেকরা করেছিল এবং তা করে তাদের সমস্ত এবাদত সত্ত্বেও মোশরেক হয়ে গিয়েছিল। এবং এ জন্যই আল্লাহ তাঁর রসুলকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর সার্বভৌমত্বকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে এবং তাই তাঁর রসুল এসে সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মক্কার সমস্ত মানুষকে ডেকে এনে প্রথমেই বলেছিলেন- বল (বিশ্বাস কর) ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ’। ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ’র অর্থ যদি আল্লাহ ছাড়া মা’বুদ অর্থাৎ উপাস্য নেই হয় তবে রসুলাল্লাহর ঐ ডাক অর্থহীন কারণ ঐ মোশরেকরা নামায পড়ে, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে, হজ্ব করে ও রমাদানের রোযা রেখে আল্লাহর উপাসক হয়েই ছিল, তাদের আবার আল্লাহকে উপাস্য মা’বুদ বলে বিশ্বাস করার জন্য ডাক দেবার প্রয়োজন কি? আরবের এ মোশরেকরা কি নামায, দান-খয়রাত, হজ্ব, রোযা এগুলি ঐ দেবদেবীর উদ্দেশ্যে করত? অবশ্যই নয়- তারা আল্লাহর এবাদত হিসাবে করত। মোশরেকরা কি উদ্দেশ্যে দেব-দেবীর পূজা করত তা আল্লাহ নিজে তাঁর কোরানে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন (সুরা যুমার ৩; সুরা ইউনুস ১৮)।

একইভাবে বর্তমানে ‘মুসলিম’ বলে পরিচিত জনসংখ্যাটি তদানিন্তন আরবের মানুষের মতই আল্লাহকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, তাকে স্রষ্টা বলে, জীবন-মরণের প্রভু, একমাত্র উপাস্য ‘মাবুদ’ বলে মানে, কিন্তু আরবের ঐ মোশরেকদের মতই তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর) দেয়া দীন, জীবন-বিধান মোতাবেক সমষ্টিগত, জাতীয় জীবন পরিচালনা করে না। আরবের মোশরেকরা দেব-দেবীর পুরোহিতদের দেয়া বিধান অনুযায়ী তাদের জাতীয় জীবন পরিচালনা করত, বর্তমানের মুসলিম দুনিয়ার ইলাহ হলো দাজ্জাল, তারা তাদের নতুন দেব-দেবী গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রের পুরোহিত ইহুদী-খ্রীস্টান ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের তৈরী করা জীবন-বিধান, তন্ত্র, মন্ত্র, বাদ, ক্র্যাসি অনুযায়ী তাদের জাতীয় জীবন পরিচালনা করছে। তফাৎ শুধু এইটুকু যে আরবদের হাবল, লা’ত, মানাতের মূর্তিগুলি ছিল কাঠ এবং পাথর দিয়ে তৈরী, বর্তমানের মূর্তিগুলি কাঠ পাথরের নয়, তন্ত্রের মূর্তি। বরং এই তন্ত্রের মূর্তিগুলোর পুজা ঐ কাঠ পাথরের মূর্তিপূজার চেয়েও বড় র্শেক ও কুফর। কারণ লা’ত, মানাতের পূজা করা হতো আল্লাহর কাছে পুজারীদের জন্য সুপারিশ করার জন্য, এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য, কিন্তু বর্তমানে যে তন্ত্রগুলির পূজা করা হচ্ছে এই তন্ত্রগুলির আল্লাহর সাথে কোন সম্পর্ক নেই বরং এগুলো আল্লাহর বিরোধী, আল্লাহর ভাষায় তাগুত। তাহলে বিশ্বনবী যাদের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন আরবের সেই আল্লাহয় বিশ্বাসী অথচ মোশরেক কাফেরদের সঙ্গে বর্তমানের আল্লাহয় বিশ্বাসী কিন্তু কার্যত মোশরেক ‘মুসলিম’ জনসংখ্যার তফাৎ কোথায়? আল্লাহর ওপর ঈমান নিয়েও যে মোশরেক হওয়া যায় তার প্রমাণ আল্লাহ বলেন, তাদের অধিকাংশ আল্লাহর উপর ঈমান পোষণ করে, আবার শিরকও করে (সূরা ইউসুফ: ১০৬)।

মক্কার সেই কাফের মোশরেক সমাজ থেকে যারা আল্লাহর রসুলের প্রতি ঈমান আনলেন, তারা তাদের পূর্ব পুরুষের বিকৃত ধর্ম ত্যাগ করলেন এবং রসুলাল্লাহর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হলেন। সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে, ‘তোমাদের দীন তোমাদের, আমাদের দীন আমাদের’ (সূরা কাফেরুন-৬)। এই যে শেরক ও কুফর থেকে, বিকৃত এসলামের অনুসারীদের থেকে নিজেকে পৃথক করে নেওয়া, এটা এক প্রকার হেজরত। হেজরত শব্দের অর্থ শুধু দেশ ত্যাগ করা নয়। হেজরত ক্রিয়াপদের অর্থ:- “সম্পর্কচ্ছেদ করা, দল বর্জন করা, স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া ভিন্নদেশে গমন করা” (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃঃ ৫৬০-৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। আল্লাহয় বিশ্বাসী অথচ মোশরেক ঐ আরবদের মধ্যে আবির্ভূত হয়ে বিশ্বনবী যখন প্রকৃত তওহীদের ডাক দিলেন তখন যারা প্রকৃত তওহীদ কী, তা বুঝে আল্লাহর রসুলকে স্বীকার করে তাঁর সাথে যোগ দিলেন তারা আরবদের ঐ র্শেক ও কুফর থেকে হেজরত করলেন। মক্কা থেকে শারীরিক হেজরত করে মদীনায় চোলে যাবার আগে পর্যন্ত আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাব প্রথম দুই প্রকারের হেজরত করলেন। তারা মোশরেক কাফেরদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, ওঠা-বসা সবই করতেন কিন্তু তাদের মধ্যে বাস করেও হৃদয়ের দিক থেকে তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন, তাদের দল বর্জন করলেন, তাদের সাথে এবাদত করা ছেড়ে দিলেন এবং আল্লাহর রসুলকে কেন্দ্র করে তওহীদ ভিত্তিক একটি আলাদা সমাজ, আলাদা ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুললেন। তারপর ১৩ বছর পর মক্কা থেকে মদীনায় চোলে যেয়ে তৃতীয় প্রকার হেজরত করলেন। এর ৯ বছর পর মক্কা জয়ের পর তৃতীয় প্রকারের হেজরতের আর প্রয়োজন রইল না, কিন্তু বাকী দুই প্রকারের হেজরতের প্রয়োজন রয়ে গেলো এবং আজও আছে। দীন যখনই বিকৃত হয়ে যাবে, বৃহত্তর জনসংখ্যা যখনই ঐ বিকৃত দীনের ভ্রান্ত পথে চোলবে, তখন আল্লাহ তাঁর অসীম করুণায় যাদের সেরাতুল মুস্তাকীমে হেদায়াত করবেন, তাদের ঐ বৃহত্তর জনসংখ্যা থেকে বিশ্বনবী ও তাঁর সাহাবাদের (রা.) মতই হেজরত করতে হবে। অর্থাৎ ঐ সংখ্যাগরিষ্ঠ পথভ্রষ্টদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের দল বর্জন করতে হবে। এ হেজরতের প্রয়োজন কোনদিনই শেষ হবে না। আল্লাহর রসুল বলেছেন – হেজরত শেষ হবে না যে পর্যন্ত তওবা শেষ হবে না, তওবা শেষ হবে না যে পর্যন্ত সূর্য তার অস্ত যাবার স্থান থেকে উদয় না হবে [মুয়াবিয়া (রা.) থেকে আহমদ, আবু দাউদ ও দারিমী]। কেয়ামতের একটি আলামত হচ্ছে পশ্চিম থেকে সূর্যোদয়। তারপর থেকে আর কারো তওবা কবুল হবে না। অর্থাৎ হেজরতের প্রয়োজন কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে, যেমন থাকবে জেহাদেরও প্রয়োজন কেয়ামত পর্যন্ত (হাদীস)।

চৌদ্দশ’ বছর আগে আল্লাহয় বিশ্বাসী আরবের মোশরেকদের মধ্যে মহানবী ও তাঁর আসহাবদের (রা.) যে ভূমিকা ছিল, আজ আল্লাহ বিশ্বাসী কিন্তু কার্যতঃ মোশরেক সমাজের মধ্যে হেযবুত তওহীদের সেই ভূমিকা। সেদিন আল্লাহর রসুল যেমন মানুষকে আল্লাহর প্রকৃত তওহীদে, সর্বব্যাপী তওহীদে আহ্বান করেছিলেন, সেই নবীর প্রকৃত উম্মাহ হিসাবে হেযবুত তওহীদ সেই একই আহবান করছে। সেদিন আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবারা (রা.) যেমন দীনের ব্যাপারে ঐ সমাজ থেকে হেজরত করেছিলেন, তাদের সাথে এবাদত করা ছেড়ে দিয়েছিলেন, আজ ঠিক তেমনি ভাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী হবার প্রচেষ্টারত হেযবুত তওহীদকেও বর্তমান ‘মুসলিম’ নামের মোশরেক সমাজ থেকে হেজরত করেছে, কারণ তা নইলে নবীর সুন্নাহ পালন করা হবে না, এবং এই দীনুল এসলামকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আল্লাহর রসুলের সুন্নাহ ত্যাগ করলে আল্লাহর সাহায্য ও সাফল্য আসবে না।  আল্লাহর সাহায্য আসলে পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের পরাজিত করবে? কারুর সে সাধ্য নেই। তবে আমাদের সেই মো’মেন হতে হবে যে মো’মেন হলে আমাদের সাহায্য করা তাঁর দায়িত্ব হয়ে যায়।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...