নারী পুরুষের সৃষ্টিগত পার্থক্য:
মানবজাতিকে আল্লাহ সামাজিক জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মূল দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহ হুকুম-বিধান অনুসারে শাসন করা, শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এই মানুষের মধ্যে দুটি পৃথক বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত সৃষ্টি- নারী ও পুরুষ। পুরুষ শারীরিক দিক থেকে নারীর চেয়ে শক্তিশালী, তার পেশী, বাহু, হাড়ের গঠন, মেরুদণ্ড এককথায় তার দেহকাঠামো নারীর তুলনায় অধিক পরিশ্রমের উপযোগী। আল্লাহই তাকে রুক্ষ পরিবেশে কাজ করে উপার্জন করার বেশী সামর্থ্য দান করেছেন। তাই পুরুষ শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োগ করে রোজগার করবে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করবে এবং পরিবারের ভরণ পোষণ করবে, এটা তার দায়িত্ব। এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই পুরুষকে আল্লাহ নারীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছেন, নারীর অভিভাবক করেছেন। এটা মানব সমাজে বিশেষ করে পরিবারে পুরুষের দায়িত্ব। অপরদিকে নারীদেরকে আল্লাহ সন্তান ধারণের উপযোগী করে তৈরি করেছেন, সন্তানবাৎসল্য ও সেবাপরায়ণতা দান করেছেন। তাই নারী সৃষ্টিগতভাবেই কোমলমতি। প্রকৃতিতে যখন কোনো প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন সবচেয়ে দূর্বল ও কোমল প্রাণীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তেমনি সমাজ যখন নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে গেল, নারী যখন হারিয়ে ফেললো স্রষ্টা প্রদত্ত রহমত ও বরকত তখনই এই কোমলমতি নারীরা সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদানকে উল্লেখ না করে কোনো উপায় নেই। অধিকাংশ মহৎ কাজের স্বীকৃতি ও পুরস্কার পুরুষ সগৌরবে গ্রহণ করলেও তার সাফল্যের জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে নীরবে কাজ করে গেছে কোনো না কোনো নারী, অন্ধ সমাজের দৃষ্টি খুব কমই সেই নারীর দিকে আকৃষ্ট হয়। কোনো স্বীকৃতিতো নেইই উল্টো আজকের এই সভ্যতার মুখোশ পরা সমাজে নারীরা পদে পদে হচ্ছেন নির্যাতিত, নিষ্পেষিত।
নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য:
সৃষ্টির প্রথম মানব আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর স্রষ্টা তাঁকে স্বর্গে বা জান্নাতে থাকতে দিলেন। যেখানে খুশি যাবার, যা খুশি খাবার, যা খুশি করার অনুমতি দিলেন। অথচ স্বর্গ সুখের মাঝে থেকেও তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, দুঃখী আর উদাসীন। কিসের যেন প্রচণ্ড অভাব বোধ করছিলেন। তারপর তাঁর অন্তরের প্রশান্তির জন্য, তাঁর নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য স্রষ্টা মা হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করলেন। জান্নাতের সুখ বা স্বর্গ সুখ যাকে ছাড়া মলিন ছিল সে-ই হলো নারী, সমস্ত রকম সুখ শান্তি যাকে ছাড়া অপূর্ণ ছিল সে-ই হলো নারী। নারী হলো শান্তির পায়রা, সুখের আধার। জান্নাতের সুখকে পরিপূর্ণ করে দেবার জন্য নারীর সৃষ্টি। অর্থাৎ সমাজ, সংসার ও পরিবারে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকে সৃষ্টি করা হলো। প্রত্যেকটি মানব শিশুর প্রথম ও প্রধান শিক্ষালয় হলো তার পরিবার এবং প্রথম শিক্ষক হলো তার মা। মা সন্তানকে যা শিখাবে তাই তার জীবনে পাথেয় হয়ে থাকবে। সন্তানের উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগায় মা, সামনে এগিয়ে যেতে দৃঢ়প্রত্যয়ী করে মা। তেমনি স্বামীর জন্যও তার স্ত্রী হলো অনুপ্রেরণা, জীবনে চলার পথের বিশ্বস্ত একজন সাথী। অর্থাৎ নারী কখনও মা হয়ে, কখনও বোন হয়ে, কখনও স্ত্রী হয়ে, কখনও কন্যা হয়ে পরিবার ও সমাজের শান্তি রক্ষার জন্য কাজ করে থাকে। এককথায়, নারী হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, বরকত ও নেয়ামত স্বরূপ।
প্রকৃত ইসলামে নারী:
প্রকৃত ইসলামে নারীরা কেমন ছিলেন? তারা ছিলেন মা, বোন, কন্যা, স্ত্রী, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী, সেবিকা, কমান্ডার, গভর্ণর সহ অনেক কিছু। তারা আল্লাহর রসুলের সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধাহতদের সেবা করেছেন, যুদ্ধের রসদ সরবরাহের কাজ করেছেন। সর্বপোরি পুরুষ মোজাহেদদের যুদ্ধের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। অনেক নারী সারা জীবন তার স্বামীর সাথে জিহাদের ময়দানে কাটিয়েছেন। সেখানে সন্তান জন্ম দিয়েছেন এবং তাদের লালন পালন করেছেন। প্রকৃত ইসলামে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, হাসপাতাল পরিচালনা করেছেন এবং স্বয়ং যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি থেকে তারা সব কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। আজ নারী শিক্ষার জন্য মৌলবাদীদের গুলিতে আহত হওয়ায় মালালা ইউসুফ জাইকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে। পুরো বিশ্ব আজ তাকে এর জন্য চেনে। অথচ ১৪০০ বছর আগে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগের সেই বর্বরতা থেকে মুক্তি দেবার জন্য, মানবজাতিকে শান্তি ও নিরাপত্তা দেবার জন্য যে সুমাইয়া (রা.) নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, তাঁকে কয়জন চেনে? আহত লোকদের সেবা শুশ্রুষার জন্য ফ্লোরেন্স নাইটেংগেল এর নাম সবাই জানে, মাদার তেরেসার নাম সবাই জানে, অথচ রুফায়দাহ (রা.) যিনি আহত লোকজনের সেবার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিলেন তাঁকে কতজন জানে? মক্কার ধনাঢ্য মহিলা ব্যবসায়ী ছিলেন আম্মা খাদিজা (রা.)। মানবতার কল্যাণের জন্য নিজের সমস্ত সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত অর্থের অভাবে পুষ্টিহীনতায় মৃত্যুবরণ করেন সেই ইতিহাস আমরা কয়জন জানি?
আল্লাহর রসুল নারীদের পর্দার দোহাই দিয়ে ঘরের কোনায় বসিয়ে রেখেছিলেন এমন কোনো ইতিহাস তো আমরা পাই না। তারা আল্লাহ রসুলের সাথে একসাথে সালাহ কায়েম করতেন, রসুলের সামনে বসে আলোচনা অনুষ্ঠান শুনতেন, এমনকি ব্যক্তিগত তুচ্ছ ঘটনাও রসুলের সাথে আলাপ করতেন। এইতো কয়েক বছর আগে নারীদের ভোটের অধিকার দিয়ে এবং সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব বলছে যে তারা নারীদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৪০০ বছর আগে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে যখন মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো সেই সময়ে আম্মা আয়েশা ১০,০০০ সৈন্যের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন আম্মা খাদিজা, মদীনার বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রের দায়িত্বে ছিলেন একজন নারী উম্মে শেফা (রা.)। মায়েরা তাদের সন্তানকে নিজের হাতে সাজিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি করে দিতেন আর বলতেন আল্লাহর রাস্তায় শহীদ না হয়ে ফিরবে না । সন্তানকে এমন শিক্ষা দিয়েছিল যে সন্তান তার মায়ের মুখের কথা জীবন দিয়ে পালন করে গেছে।