হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

উম্মতে মোহাম্মদীর মৃত্যু

আবু ফাহাদ

মহানবীর (সা.) ভবিষ্যবাণী মোতাবেক ৬০/৭০ বছর পর যখন উম্মতে মোহাম্মদীর জাতি হিসাবে মৃত্যু হলো তখন কি রইল? রইল জাতি হিসাবে মুসলিম। মুসলিম শব্দের অর্থ হলো- যে বা যারা আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে তসলিম অর্থাৎ সসম্মানে গ্রহণ করে নিজেদের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা করে, অন্য কোনো রকম জীবন বিধানকে স্বীকার করে না, সে বা তারা হলো মুসলিম। এখানে অতি পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে যে, উম্মতে মোহাম্মদী কাকে বলে। অল্প কথায় বলা যায়, মহানবী যে উদ্দেশ্যে আগমন করেছেন সে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যাঁরা সেই কাজ করবে তারাই উম্মতে মোহাম্মদী। এখন জানতে হবে রাসুল কী উদ্দেশ্যে এসেছেন। আল্লাহ তাঁকে হেদায়াহ ও সত্যদীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন পৃথিবীর অন্যান্য সকল দীনের উপর এই দীনকে বিজয়ী এবং প্রতিষ্ঠা করার জন্য। অর্থাৎ তিনি এসেছেন হেদায়াহ ও সত্যদীন মানবজাতির উপরে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এই জাতি রাসুলাল্লাহর (সা.) প্রকৃত সুন্নাহ অর্থাৎ তাঁর মাধ্যমে প্রেরিত দীনকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দেবার ফলে জাতি হিসাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হয়ে শুধু একটি মুসলিম জাতিতে পরিণত হলো। এ জাতির সংবিধান রইল কুরআন ও হাদীস, রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক সবরকম ব্যবস্থা শাসন ও দণ্ডবিধি (penal code) সবই রইল ঐ কুরআন ও হাদীস মোতাবেক। ওর বাইরে অন্য কোনো রকম রাজনৈতিক বা আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে তাঁরা শেরক বা বহু ঈশ্বরবাদ মনে করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাদের আকিদা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই তারা ঐ বিশাল ভূখণ্ডের শাসক হয়ে পৃথিবীর আর দশটা রাজ্যের মত রাজত্ব করতে লাগলেন। এই অবস্থায় কয়েক’শ বছর পার হয়ে গেল।

ফিরে দেখা: জাতির গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়

আমি এইখানে একটু থামব। কারণ এই সময় থেকে নিয়ে কয়েকশ’ বছর পর এই জাতির পতন ও ইউরোপের অন্যান্য জাতিগুলির কাছে যুদ্ধে হেরে যেয়ে তাদের গোলামে পরিণত হওয়া পর্যন্ত কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিন্তা করার আছে। উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যখন এই জাতি বন্ধ করল, ঠিক তখনকার পরিস্থিতি এই রকম।

ক) পৃথিবীর দুইটি বিশ্বশক্তিকে (Super Power) উম্মতে মোহাম্মদী সশস্ত্র সংগ্রামে পরাজিত করেছে।

খ) একটি (পারস্য) এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে স্বীকার ও গ্রহণ করে এই জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে ও অন্যটি (পূর্ব রোমান অর্থাৎ বাইজেনটাইন) তার সাম্রাজ্যের বেশীর ভাগ হারিয়ে শক্তিহীন ও দুর্বল হয়ে গেছে। খ্রিস্টান শক্তি বলতে তখন ইউরোপের ছোট ছোট কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছু নেই।

গ) উম্মতে মোহাম্মদী যদি তখন তাদের উদ্দেশ্য ভুলে না যেত তবে পৃথিবীময় এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠায় আর কোনো বড় বাঁধা ছিল না। থাকলেও তা ঐ দুই বিশ্বশক্তির মতই পরাজিত হত। সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত হত, আল্লাহ তার শেষ রাসুলকে (সা.) যে দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন’ তা পূর্ণ হত, পৃথিবী থেকে অন্যায় অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত বন্ধ হয়ে পূর্ণ শান্তিতে মানব জাতি বাস করতে পারত, মালায়েকদের আশংকা মিথ্যা হত, ইবলিসের মাথা নত হয়ে যেত, বিশ্বনবীকে আল্লাহর দেয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন উপাধির অর্থ পূর্ণ হত।

ঘ) এই সংগ্রাম যখন আরম্ভ হয়েছিল তখন উম্মতে মোহাম্মদীর মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখেরও কম। কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, পৃথিবীর দরিদ্রতম জাতিগুলির অন্যতম, যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র নিতান্ত প্রয়োজনের চেয়েও কম। আর প্রতিপক্ষ তদানীন্তন পৃথিবীর দুই মহাশক্তি, জনসংখ্যায়, সম্পদে সুশিক্ষিত সৈন্যের সংখ্যায় অস্ত্র ও সরঞ্জামে এক কথায় কোনোদিক দিয়েই তুলনা চলে না। আর ৬০/৭০ বছর পর যখন এ সংগ্রাম বন্ধ করা হলো তখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। এই নিঃস্ব জাতি আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত আর উত্তরে উরাল পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের তীর পর্যন্ত বিশাল এলাকার শাসনকর্তা। তখন আর নিঃস্ব নয়, তখন সম্পদে, সামরিক শক্তিতে জনবলে প্রচণ্ড শক্তিধর পৃথিবীর কোনো শক্তির সাহস নেই এই জাতির মোকাবেলা করার। অর্থাৎ প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী যারা নিঃসংশয়ে জানতেন তাদের নেতার (সা.) জীবনের উদ্দেশ্য কী ছিল এবং তাদের নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী তারা ডানে বামে কোনও দিকে না চেয়ে একাগ্র লক্ষ্যে (হানিফ) সেই উদ্দেশ্য অর্জনে পার্থিব সব কিছু কোরবান করে পৃথিবীতে বের হয়ে পড়ে ছিলেন। আল্লাহ তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তাদের সঙ্গে ছিলেন। আর স্বয়ং আল্লাহ যাদের সাথে তারা কেমন করে বিফল হবে, কেমন করে পরাজিত হবে? তাই মানব ইতিহাসে দেখি এক অবিশ্বাস্য অধ্যায়। অজ্ঞাত ছোট্ট একটি নিঃস্ব জাতি অল্প সময়ের (৬০/৭০ বছর) মধ্যে মহাপরাক্রমশালী দুইটি বিশ্ব শক্তিকে পরাজিত করে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীতে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করল। উম্মাহর উপর দায়িত্ব দেয়া কাজের এই পর্যন্ত অগ্রগতি হওয়ার পর দুর্ভাগ্যক্রমে এই উম্মাহ তার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে গেল, এর আকিদা নষ্ট হয়ে গেল, পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠার বদলে তাদের আকিদা হয়ে গেল রাজত্ব করা, অন্য দশটা সাম্রাজ্যের মত। এই উম্মাহকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল সে কাজ ত্যাগ করে সে অন্য পথ ধরল।

কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ত্যাগ করলেও যেহেতু তারা এই শেষ জীবন ব্যবস্থা, দীনের উপরই মোটামুটি কায়েম রইল তাই এর সুফলও তারা লাভ করল। কোর’আনের ও হাদীসের নির্দেশ মোতাবেক শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার ফলে জাতি আইন শৃঙ্খলা ও সম্পদ বিতরণে অপূর্ব সাফল্য লাভ করল, আল্লাহ ও রসুলের (সা.) জ্ঞান আহরণের আদেশ উৎসাহ ভরে পালন করে অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে উপবিষ্ট হলো। যে সময়টার (Period) কথা আমি বলছি অর্থাৎ জাতি হিসাবে সংগ্রাম ত্যাগ করে উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে পতিত হওয়া থেকে কয়েকশ’ বছর পর ইউরোপের বিভিন্ন জাতির পদানত ও গোলামে পরিণত হওয়া পর্যন্ত এই যে সময়টা, এই সময়টা পার্থিব হিসাবে অর্থাৎ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ইত্যাদিতে এক কথায় উন্নতি ও প্রগতি বলতে যা বোঝায় তাতে এই জাতি পৃথিবীর সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রইল। শেষ নবীর (সা.) মাধ্যমে শেষ জীবন ব্যবস্থা মোটামুটি নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করার অনিবার্য ফল হিসাবে এই জাতি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হলো যে, তদানীন্তন বিশ্ব সভয়ে ও সসম্ভ্রমে এই জাতির সামনে নতজানু হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে এই জাতির সাফল্য, কীর্তি বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন, গবেষণা, পৃথিবীর অজানা স্থানে অভিযান ইত্যাদি প্রতি বিষয়ে যে সাফল্য লাভ করেছিল তার বিবরণ এখানে দেওয়ার স্থান নেই এবং প্রয়োজনও নেই। এ ব্যাপারে বহু বই কেতাব লেখা হয়ে গেছে। এই সময় (Period) টাকেই বলা হয় ইসলামের স্বর্ণ যুগ।

কিন্তু এত কিছুতেও কোনো লাভ নেই- কারণ আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলে বাকি আর যা কিছু থাকে সবই অর্থহীন। এ সত্য রাসুলাল্লাহর (সা.) ঘনিষ্ঠ সহচর এই জাতির প্রথম খলিফা আবু বকর (রা:) জানতেন। তাই খলিফা নির্বাচিত হয়ে তার প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্বোধন করে বলেছিলেন- হে মুসলিম জাতি! তোমরা কখনই সংগ্রাম (জেহাদ) ত্যাগ করোনা। যে জাতি জেহাদ ত্যাগ করে- আল্লাহ সে জাতিকে অপদস্থ, অপমানিত না করে ছাড়েন না। আবু বকর (রা:) এ কথা তার প্রথম বক্তৃতাতেই কেন বলেছিলেন? তিনি বিশ্বনবীর (সা.) ঘনিষ্ঠতম সাহাবাদের একজন হিসাবে এই দীনের প্রকৃত মর্মবাণী, হকিকত তার নেতার কাছ থেকে জেনেছিলেন। বিশ্বনবীর কাছ থেকে জানা ছাড়াও আবু বকর (রা:) আল্লাহর দেয়া সতর্কবাণীও কোর’আনে নিশ্চয়ই পড়েছিলেন যেখানে আল্লাহ এই মো’মেন জাতি ও উম্মতে মোহাম্মদীকে লক্ষ্য করে বলছেন- যদি তোমরা (জেহাদের) অভিযানে বের না হও তবে তোমাদের কঠিন শাস্তি (আযাব) দেব এবং তোমাদের বদলে (তোমাদের পরিত্যাগ করে) অন্য জাতিকে মনোনীত করব (সূরা তওবা ৩৮-৩৯)। এই জাতি যে একদিন তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যাবে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দেবে ফলে আল্লাহর গজবে পতিত হবে তাও বোধহয় তিনি তাঁর প্রিয় নেতার (সা.) কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন। তাই খলিফার দায়িত্ব হাতে নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম সেই সম্বন্ধেই জাতিকে সতর্ক করে দিলেন। শুধু আবু বকর (রা:) নয়, তারপর ওমর (রা:), ওসমান (রা:) এবং আলী (রা:) ও যে ঐ মর্মবাণী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন তার প্রমাণ এই যে, তাদের সময়েও এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদা তো নয়ই এমনকি মহানবীর (সা.) একজন মাত্র সাহাবাও কোনোদিন এই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরতির জন্য একটিমাত্র কথা বলেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ নেই। বরং প্রতিটি সাহাবা তাঁদের পার্থিব সব কিছু কোরবান করে স্ত্রী পুত্রকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে বছরের পর বছর আরব থেকে বহু দূরে অজানা অচেনা দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আবু বকরের (রা:) মত তারাও জানতেন যে, এই সংগ্রাম বিশ্বনবীর (সা.) উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব, যা তাঁর উম্মাহ হিসাবে তাদের উপর এসে পড়েছে। তারা জানতেন এ সংগ্রাম ত্যাগ করার অর্থ উম্মতে মোহাম্মদীর গণ্ডি থেকে তাদের বহিষ্কার, আল্লাহর রোষানলে পতিত হওয়া ও পরিণামে আল্লাহর শত্রুদের হাতে পরাজিত, অপমান, অপছন্দ ও লাঞ্ছনা, যা আবু বকর (রা:) বলেছিলেন।

যে সময়টার (Period) কথা এখানে আলোচনা করছি- সংগ্রাম থামিয়ে দেওয়া থেকে ইউরোপীয় শক্তিগুলির দাসে পরিণত হওয়া পর্যন্ত কয়েকশ’ বছর- একেই বলা হয় ইসলামের স্বর্ণ যুগ, কারণ একটু আগে বলে এসেছি। এলাকায়, জনসংখ্যায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে, শিক্ষায়, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে এক কথায় সর্বতোভাবে এই জাতি এই সময়টায় পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। এই বিস্ময়কর উন্নতি এই জাতি করতে পেরেছিল, তার কারণ মুল বিষয়ে ব্যর্থ হলেও মোটামুটিভাবে এই জাতির সংবিধান ছিল কুরআন ও সুন্নাহ। অন্য কোন রকম জীবন বিধানকে স্বীকার করে না নিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবন ও দণ্ডবিধি পরিচালনা করার দরুণ এই সময়কালের এই জাতিটাকে মুসলিম বলা যায়। কিন্তু বিশ্বনবীর (সা.) আরদ্ধ কাজ ত্যাগ করার দরুণ এখন আর একে জাতি হিসাবে উম্মতে মোহাম্মদী বলা যায় না। এই কয়েকশ’ বছরের মধ্যে ক্রমে ক্রমে এই ‘মুসলিম’ জাতির মধ্যে যে পরিবর্তনগুলি এলো তা গভীরভাবে লক্ষ্য করা প্রয়োজন।

ক) ফকীহ মুফাস্সির, পণ্ডিতদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে ক্রমে ক্রমে জাতি নানা মাযহাবে ও ফেরকায় বিভক্ত হয়ে যেয়ে এর ঐক্য সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেল, শক্তি শেষ হেয়ে গেল।

খ) সুফীদের অনুপ্রবেশ ও প্রভাবে জাতি মানসিকভাবে নির্জীব হয়ে গেল।

গ) ঐ দুইটির সম্মিলিত প্রভাবে উম্মাহর বহির্মুখী (Extrovert)  ও বিস্ফোরণমুখী (Explosive) চরিত্র অন্তর্মুখী (Introvert)  ও অনড় (Inert)  হয়ে গেল। জাতি স্থবির, মৃত হয়ে গেল। যার গতি নেই তাই মৃত।

ঘ) এই মৃত অবস্থায় জাতির পচনক্রিয়া (Decomposition) চলতে লাগল।

এই পচনক্রিয়া যে কয়েকশ’ বছর ধরে চললো এই সময়টায় কিন্তু এই উম্মাহর শত্রুরা বসে ছিল না। তারা ক্রমাগত চেষ্টা করে চলছিল এই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু এই উম্মাহর জনক মহানবী (সা.) এর মধ্যে যে বিপুল পরিমাণ সামরিক গুণ ও চরিত্র সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন তার প্রভাবে ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি কোনো বড় রকমের বিজয় লাভ করতে পারে নি। কিন্তু ফকীহ, মুফাস্ফির ও সুফীদের প্রভাবে উম্মাহর আকিদা বিকৃত হয়ে যাবার ফলে পচনক্রিয়া আরও যখন ভয়াবহ হয়ে উঠলো তখন আর এই জাতির শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি রইল না। কারণ সুফিবাদ একটি সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন আধ্যাত্মিক দর্শন। একে তাসাওয়াফ বলেও অভিহিত করা হয়। এতে দীনের আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি এবং এগুলিকে প্রতিষ্ঠার জেহাদের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কেবলমাত্র আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হলো এই দর্শনের মর্মকথা। এই সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে মূলতঃ পারস্যে। সেখানকার সুফি-দরবেশ এবং কবি-সাহিত্যিকগণ তাদের বিভিন্ন কাব্য ও পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। এই সুফীরা সাধারণ মানুষের কাছে ওলী, কামেল, পীর, মুরশিদ, দরবেশ, গাউস, কুতুব, শায়খ, খাজা ইত্যাদি বহু নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কালক্রমে তাদের অবলম্বন করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে চারটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে:

১) বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা,

২) খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা,

৩) খাজা বাহাউদ্দিন নকশ্বন্দী প্রতিষ্ঠিত নকশ্বন্দিয়া তরিকা এবং

৪) শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানী সারহিন্দী প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।

এছাড়া সোহ্রাওয়ার্দিয়া, মাদারীয়া, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে। মনে রাখতে হবে, সমস্ত ফকীহ, মুফাস্সির ও পীর দরবেশদের আবির্ভাব হয় এই সময়কালেই (Period) অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদী সংগ্রাম থামিয়ে দেওয়া থেকে ইউরোপীয় শক্তিগুলির দাসে পরিণত হওয়া পর্যন্ত কয়েকশ’ বছরের মধ্যে, যে সময়টাকে বলা হয় ইসলামের স্বর্ণযুগ। এদের মতবাদের বিষ কেমন করে এই উম্মাহকে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের ক্রীতদাসে পরিণত করেছে তার একটি মাত্র উদারহণই বোধহয় উন্মুক্ত মনের মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। (চলবে)

[সমস্ত পৃথিবীময় অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ ও রক্তপাত ইত্যাদি নির্মূল করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সনে এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী হেযবুত তওহীদ নামক আন্দোলনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ তাঁকে প্রকৃত ইসলামের যে জ্ঞান দান করেছেন তা তিনি যতটা সম্ভব হয়েছে বই-পুস্তক লিখে, বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারের চেষ্টা করেছেন। এই নিবন্ধটি লেখকের বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্য থেকে সম্পাদিত।]

                                         (এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে সম্পাদিত)

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...