ইমাম মাহদীর (আ.) আগমন সংক্রান্ত হাদীস প্রায় সবাই জানেন। হাদিসে বোঝানো হয়েছে যে শেষ যামানায় একজন হেদায়াতপ্রাপ্ত নেতা আসবেন। যিনি আবারো মুসলিম জাতিকে হেদায়াতের উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন। ইমাম মাহাদির আগমন ঘটবে এতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ এটি রসুলাল্লাহর ভবিষ্যতবাণী। ‘ইমাম মাহদী’ কোনো নাম নয়। এটি একটি উপাধি। ইমাম মাহদী অর্থ হেদায়াতপ্রাপ্ত নেতা। যখন ইসলাম শুধু নাম থাকবে কিন্তু বাস্তবে কোথাও শান্তি থাকবে না, কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে কিন্তু বাস্তবে কোর’আনের হুকুম কার্যকরী হবে না, মসজিদসমূহ হবে লোকে লোকারণ্য কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, তখন হেদায়াতের আলো নিয়ে আবির্ভূত হবেন ইমাম মাহদী (আ.)। এটি আমাদের সর্বজনবিদিত বিশ্বাস। তিনি এসে মুসলমান জাতির বর্তমান দুর্দশার অবসান ঘটাবেন। মুসলিম জাতি আবার তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। যাবতীয় অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটে সমস্ত দুনিয়া আবার ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও নিরাপত্তায় ভরে উঠবে। এরকমই নানা কল্পনা-জল্পনা নিয়ে শত শত বছর যাবত কাঙ্ক্ষিত সেই মহাপুরুষের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন আমাদের আলেম সমাজ।
কিন্তু এখন প্রশ্ন এটা নয় যে তিনি কবে আসবেন? প্রশ্ন হলো এটা যে, তিনি কেন আসবেন? এখানে কয়েকটি বিষয়ের দিকে লক্ষ করুন, ইমাম মাহাদি হচ্ছেন হেদায়াতপ্রাপ্ত নেতা অর্থাৎ তিনি হেদায়াত নিয়ে আসবেন। হেদায়াত আসার দরকার কখন পড়ে? যখন হেদায়াত থাকে না তখন, তাই নয় কি? এই হাদীস দ্বারা কি আমরা এই বার্তাই পাচ্ছি না যে, শেষ যামানায় এমন সময় আসবে যখন এই জাতি সমষ্টিগতভাবে হেদায়াত বা সঠিক পথ হারিয়ে ফেলবে? সব দল-মত-ফেরকা-মাজহাবের মুসলমানই ইমাম মাহদীর আগমন সংক্রান্ত হাদীসকে সত্য বলে স্বীকার করে। সন্দেহ করে না কেউই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এই জাতির ধর্মীয় নেতারা মনে করেন যে, তারা ঠিকই আছেন, তারা প্রকৃত ইসলামেই আছেন, হেদায়াতেই আছেন। এ কারণে কেউ যখন বলে যে, এই জাতি আজ হেদায়াতে নাই, এরা আল্লাহ-রসুলের দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে তখন তার দিকে সম্মিলিত প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসে- কী! এত বড় কথা? আমরা সবাই গোমরাহ হয়ে গিয়েছি? পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছি? তুমি একাই মুসলমান? অথচ তারাই আবার মনে করেন যে, ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাবের সময়ও হয়ে গেছে। তাহলে কি তারা স্ববিরোধী কথা বলছেন না? তারা যদি হেদায়াতেই থাকতেন তাহলে ইমাম মাহদীর আবশ্যকতা কেন হবে? এই জাতি একদিন না একদিন সম্মিলিতভাবে পথভ্রষ্ট হবে বলেই তো ইমাম মাহদীকে আসতে হবে।
আজ সমগ্র বিশ্বে মুসলিম জাতির কী করুণ অবস্থা পৃথিবী সম্পর্কে যারা কিছুমাত্র খবরও রাখেন তাদের বলে দিতে হবে না। ইউরোপের সর্বত্র আলবেনিয়া, কসভো, চেকোস্লোভাকিয়া, হারযেগোভিনা, চেচনিয়া ইউরোপের বাইরে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইথিওপিয়া, বসনিয়া, ভারতে কাশ্মিরে, থাইল্যান্ড, কামপুচিয়ায়, চীনের জিংজিয়াং এ অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বত্র এই মুসলিম নামক জাতিকে যে যেভাবে পারছে অপমানিত, পরাজিত, লাঞ্ছিত, নিগৃহিত, অপদস্থ করছে। তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের নির্মমভাবে গুলি করে, তলোয়ার দিয়ে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করছে। তাদের নিজেদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্তু শিবিরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের মা বোনদের ধর্ষণ করছে। ইউরোপ-আফ্রিকার বেশ্যালয়ে বিক্রি করছে। এই হচ্ছে আজ সারা বিশ্বময় মুসলিম জাতির করুণ অবস্থা। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় যে, বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত অন্য জাতির দ্বারা লাঞ্ছিত, অপমানিত, নিগৃহিত, পরাজিত, অপদস্ত হচ্ছে কোন জাতি? নিজেদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে দিন যাপন করছে তারা কারা? প্রতিনিয়ত অন্য জাতির হাতে যেসব মা-বোন ধর্ষিত, লাঞ্ছিত হচ্ছে তারা কোন হতভাগা জাতির সদস্য? তবে সবাই একবাক্যে উত্তর দিবেন যে মুসলিম জাতি। এভাবেই আজ সারাবিশ্বময় মুসলিম জাতি অন্য জাতির লাথি, মার খেয়ে দিন যাপন করছে।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা যদি হেদায়াতেই থাকি তবে আমাদের তো এমন অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। মুসলিমরা তো ছিল সেরা জাতি, তারা তো ছিল শিক্ষকের জাতি তবে আজ কিভাবে আমরা অন্য জাতির গোলাম দাসে পরিণত হলাম? কিভাবে আমরা পথহারা হলাম? কোথায় আমরা ভুল করেছি? আজ আমাদের ভাবতে হবে। পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। মুসলিম জাতির গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে।
আরো একটি প্রশ্ন সামনে আসছে, বর্তমান মুসলিম জাতির মধ্যে লক্ষ লক্ষ আলেম, মুফতি, মাওলানা, পীর, ফকিহ, শায়েখ, দরবেশ বিদ্যমান। আমাদের হাজার হাজার মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা রয়েছে। আমাদের ঘরে ঘরে রয়েছে চকচকে কাগজে বাধাই করা অসংখ্য কোর’আন শরীফ ও হাদিসের কেতাব। সারাবিশ্বে আমরা সংখ্যায় ১৫০ কোটি মুসলমান। আমাদের নামাজের অভাব নেই, রোজার অভাব নেই, আমলের অভাব নেই। অথচ এত কিছুর পরও আমরা নাকি হেদায়াত বা সরল পথে নেই? কী সাংঘাতিক কথা। এখন ইমাম মাহদী এসে যদি আমাদের আলেম-উলামাদের বলেন যে তারা হেদায়াতে নেই তাহলে কী আমাদের আলেম সমাজ এ কথা মেনে নিবেন? যারা দিন রাত এক করে প্রতিনিয়ত ইবাদত বন্দেগি, অসংখ্য আমল করে যাচ্ছেন, ইসলামের খুটিনাটি বিষয়েও যাদের পাণ্ডিত্যের কোন অভাব নেই। যারা সমাজে ধর্মের ধারক, বাহক বলে পরিচিত, যাদের উপর সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের অগাধ ভরসা, বিশ্বাস রয়েছে, যাদের কথা শুনে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ উজ্জীবিত হয়, যাদের রয়েছে লক্ষ লক্ষ অন্ধঅনুসারী। তারা কি মানতে পারবেন যে তারা হেদায়াতে নেই। ইমাম মাহাদি যদি তাদের হেদায়েতের দিকে আহ্বান করে তারা কি দল, মত নির্বিশেষে তাঁর কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন?