হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আমার হেযবুত তওহীদ গ্রহণ

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম

জ্ঞান হবার পর থেকে আমি মনে প্রাণে চাইতাম আল্লাহ রসুলের ইসলাম সমাজে কার্যকর হোক। আল্লাহর দীন ইসলামের আদর্শ মোতাবেক আমাদের সমাজ পরিচালিত হোক। কলেমা তওহীদের উপরে মুসলমান জাতি ঐক্যবদ্ধ হোক। সেজন্য ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে আমি সম্পৃক্ত থাকতাম। যারা গ্রামে আমার বয়োজ্যেষ্ঠ, যারা সমবয়স্ক, যারা আমাকে চেনেন জানেন তারা বলতে পারবেন, যখনই এলাকায় বা আশেপাশে কোনো ওয়াজ মাহফিল হয়েছে আমি তাতে অংশগ্রহণ করতাম। আলেম ওলামাদের সঙ্গে দীনের বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতাম, তাদের সাহচর্য সব সময় চাইতাম। উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম সম্পর্কে জানা। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি তখনও ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে গিয়েছি। এমনকি ইসলামের উপর, মুসলমানদের উপর কোনো আঘাত আসলে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছি। কারণ আমি ইসলাম নিয়ে বাঁচতে চাই।

আমি যখন শিক্ষাজীবন শেষ করলাম তখনই আমার মনে একটি অনুভূতি জাগ্রত হলো যে, এই সমাজে আমি তিলে তিলে বড় হয়েছি, এই দেশ, মানুষ ও সমাজের মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করার দায়বদ্ধতা আমার রয়েছে। তাই আমার শিক্ষা, অর্থ, সামর্থ্য ও শ্রমকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করব। দেশের নাগরিক হিসাবে এটি যেমন আমার সামাজিক কর্তব্য, তেমনি একজন মো’মেন মুসলিম হিসাবে এটা আমার ঈমানি কর্তব্য। কারণ একজন মানুষ হিসাবে আমি আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি (সুরা বাকারা ৩০)। সুতরাং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করাই আমার জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই আমি সমাজের মানুষের কল্যাণ সাধনের সংগ্রামে আমি নিজেকে নিয়োজিত করতে উদ্যোগী হলাম। আমি বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুনিয়াময় মুসলমান জাতির উপর অন্যায়, অত্যাচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একে একে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, বসনিয়া, চেচনিয়া, মিয়ানমার, আরাকান, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশসহ যেখানেই মুসলিম আছে সেখানেই তাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে, তারা হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে, লাখে লাখে উদ্বাস্তু হচ্ছে। এক কথায় সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। মুসলমান জাতির তো এ অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। এক সময়ের শ্রেষ্ঠ জাতি, ঐক্যবদ্ধ জাতি আজ নিগৃহীত ও বিভক্ত কেন?

তাছাড়াও আমরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করি। আমাদের সমাজে অন্যায়, অশান্তি, সুদ-ঘুষ, মাদক, অপরাজনীতি, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, নারী নির্যাতন ইত্যাদি হওয়ার কথা নয়। অথচ এসব অন্যায় অবিচারে আমাদের সমাজ পূর্ণ। অর্থাৎ বাহিরে খাচ্ছি অন্য জাতির মার, আর ভিতরে নিজেদের মধ্যে অশান্তি। আমি এই দুরবস্থা থেকে মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে থাকি। পথের সন্ধানে আমি বিভিন্ন জায়গায় যাই, জানা-বোঝার চেষ্টা করি কিন্তু সঠিক নিদের্শনা পাইনি। অবশেষে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত পন্নী জমিদার পরিবারের সন্তান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর সংস্পর্শে যাই। এখানে তাঁর সম্পর্কে দু-একটা কথা না বললেই নয়।

ইতিহাসের বইতে পড়েছি সুলতানি আমলে গোটা ভারতবর্ষে ইরানি, আফগানি, তুর্কি সুলতানগণ শাসন করতেন। এমনই একটি রাজপরিবার (Dynasty) ছিল কররানি রাজবংশ যারা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামসহ বিস্তীর্ণ এলাকার শাসক ছিলেন। এই পরিবারেরই শেষ সুলতান ছিলেন দাউদ খান কররানী যিনি ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বঙ্গভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেন ঐতিহাসিক রাজমহলের যুদ্ধে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার পরও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এই পরিবার দুঃসাহসী ভূমিকা রেখেছে। অত্র অঞ্চলে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠায় এক কথায় ইসলামী মূল্যবোধের প্রসারে, মুসলমানদের অগ্রসর করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। করটিয়ার জমিদার হিসাবে বিখ্যাত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে আজও বহু স্থাপনা তাদের নামে রয়েছে যেগুলোতে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে। যাহোক, সেই জমিদারি ব্যবস্থা এখন নেই। সেই পরিবারের ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের ক’জনই বা জানে। সেই সুলতানী বংশেরই উত্তরপুরুষ জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী যাঁর ধমনীতে যেমন ইসলামের জন্য লড়াই করার চেতনা ছিল, তেমনি ছিল মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা।

তাঁর কথা শোনার পর এবং তাঁর লেখা বই পড়ার পর আমার সামনে সেই মুক্তির পথ সুস্পষ্টভাবে ধরা দিল। আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের মুসলমান জাতির ইহজগৎ ও পরকালের মুক্তির একমাত্র পথ – একটা কথার উপরে সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যে আমরা আমাদের সামগ্রিক জীবনে আল্লাহর হুকুম বিধান ছাড়া আর কারো হুকুম বিধান (আদেশ-নিষেধ) মানবো না, আল্লাহ যেটাকে ন্যায় বলে ঘোষণা করেছেন সেটাকে ন্যায়, যেটাকে অন্যায় বলে ঘোষণা করেছেন সেটা অন্যায় বলে বিশ্বাস করব এবং মেনে নেব। অর্থাৎ যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর শেষ রসুলের কোনো কথা আছে সেখানে অন্য কারো কথা মানবো না। এটাই হচ্ছে তওহীদের ঘোষণা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.)” এর প্রকৃত দাবি। আমাদের প্রভু একজন – আল্লাহ, রসুল একজন মোহাম্মদ (সা.), কেতাব একটি – আল কোর’আন, স্বভাবতই জাতিও হবে একটি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকে মুসলমানদের মধ্যে বহু ফেরকা, মাজহাব, তরিকার বিভক্তি বিরাজ করছে। ফলে আমরা কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছি না এবং নিজেদের সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার, অনাচার দূর করতে পারছি না। সর্বত্র অপমান, লাঞ্ছনা, পরাজয়। এর থেকে নিস্তারের শর্তই হচ্ছে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এই ঐক্যের একটি মাত্র সূত্র আল্লাহ দিয়েছেন- তা হলো তওহীদ তথা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.)”- এর অঙ্গীকারে আবদ্ধ থাকা। আমরা সবাই যদি কলেমা, তওহীদে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে আমরা দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ জাতি হতে পারব।

আল্লাহর শেষ রসুল (সা.) যে কোর’আন আমাদের মাঝে রেখে গেছেন তার একটা বর্ণও কেউ বিকৃত বা পরিবর্তন করতে পারেনি, কোনোদিন পারবেও না ইনশাল্লাহ। তিনি আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে আরবের জাহেলিয়াতের সমাজকে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক সেই মহান আদর্শের দ্বারা শান্তি ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ একটি সমাজে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। ইতিহাস বলে, সেই সমাজের মানুষ ছিল পরস্পর হানাহানি, শত্রুতা, মারামারিতে লিপ্ত। তারা পরস্পর ভাই হয়ে গেল। নারীদেরকে সেখানে ভোগের সামগ্রী বলে গণ্য করা হতো, মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, সেই নারীরা সকল ক্ষেত্রে সম্মানিত হলেন। জাতির সামরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সকল সামষ্টিক কাজে তারা তাদের সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রমাণ দিলেন। ঘরে ঘরে চলত মদ্যপান। সেই মদ্যপান বন্ধ হয়ে গেল। চুরি ডাকাতি খুন রাহাজানি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে ঘরে বাহিরে নিরাপত্তা আসলো। দাসত্ব ব্যবস্থা দূর হয়ে মানুষ মুক্তি পেল, স্বাধীনতা পেল।

তাহলে আমরা কী বুঝলাম? এটা প্রমাণিত যে, প্রকৃত ইসলামের আদর্শ একটি সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে, ইসলাম একটি দুর্বল জাতিকে সেরা জাতি বানাতে পারে, ঐক্যহীন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। যেটা রসুল (সা.) করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আজকেও একইভাবে আমাদের জাতিকে জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, প্রযুক্তিতে পৃথিবীর সেরা জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম ইসলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে এই, আমরা গত কয়েক শতাব্দী ধরে আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান প্রত্যাখ্যান করে মেনে চলছি পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র তৈরি জীবনবিধান। হেযবুত তওহীদের আহ্বান হচ্ছে, সেই সত্য দীনে আবার প্রত্যাবর্তন করে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।

আমাদের এই ডাকে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধানত দু’টো শ্রেণি। এক) ধর্মব্যবসায়ী একটি গোষ্ঠী, দুই) ইসলামবিদ্বেষী আরেকটি গোষ্ঠী। এই উভয় শ্রেণির বহুমুখী অপপ্রচার ও বিরোধিতার ফলে আমাদের বিষয়ে ভয়ঙ্কর ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি ধর্মের লেবাস সুরত ও ধর্মীয় জ্ঞান ব্যবহার করে মানুষের কাছ থেকে স্বার্থ আদায় করছে। নিজেদের স্বার্থহানির ভয়ে তারা চায় না এমন কোনো সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক, যে সমাজে ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যবসা করা, স্বার্থ হাসিল করা, সন্ত্রাস সৃষ্টি ও অপরাজনীতি করা সম্ভব হবে না। তাদের একটাই চাওয়া- মানবজাতি, সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবীর যে পরিস্থিতিই হোক, তাদের ধর্মভিত্তিক জীবনজীবিকা যেন টিকে থাকে, এটায় যেন কোনো আঁচড় না লাগে। এই ধর্মব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ফেরকাবাজি, দ্বন্দ্ব টিকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু চিরন্তন সত্য হলো ধর্মের মধ্যে যখন কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িয়ে যায়, বিনিময় জড়িয়ে যায় তখন সেই ধর্ম স্বকীয়তা হারিয়ে বিকৃত হয়ে যায়। বহু হারাম জিনিসকে হালাল বানানো হয়, বহু বৈধ জিনিস অবৈধ হয়ে যায়। বহু ছোটখাটো বিষয়কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ধর্মকে কঠিন বানিয়ে ফেলা হয়, দীনের মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। আজকে ইসলামের বেলায় সেটাই হয়েছে। আল্লাহর সরাসরি আদেশ-নিষেধ অর্থাৎ ফরজ মান্য করা হচ্ছে না, অথচ সুন্নত নফল ইত্যাদি নিয়ে বাড়াবাড়ি, তর্ক বিতর্ক বাহাসের শেষ নেই। কাজেই হেযবুত তওহীদ মানুষকে সহজ সরল সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...