চিনের শিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ উইঘুর মুসলিম। এই প্রদেশটি তিব্বতের মত স্বশাসিত একটি অঞ্চল। চিনের বিরুদ্ধে শিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিদেশী মিডিয়ার ওপর এখানে যাবার ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। এই অঞ্চলে সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনার নামে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে উইঘুর জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর গণহত্যা এবং নির্যাতন চালানোর অভিযোগ নতুন নয়। চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চিন সরকার এসব মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা উঠে এসেছে।
সম্প্রতি চিন শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের প্রতি ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার মিশেল ব্যাশেল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। চিন জাতিসংঘকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করার আহ্বান জানিয়েছিল। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, চিনা কর্তৃপক্ষ ১ কোটি ২০ লাখ মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশের প্রায় ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে আটকে রেখেছে সুরক্ষিত বন্দি শিবিরে। শিনজিয়াংয়ের সরকারি তথ্যভাণ্ডার হ্যাক করে ফাঁস করা নথিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ বেইজিংয়ের শীর্ষ নেতারা জোর করে তাদের ধরে আনার নির্দেশ দিচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্র জানায়, শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলমানদের ওপর চিন সরকারের বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিমদের বন্দি করা এখনো থামেনি। মিশেল ব্যাশেলের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় শিনজিয়াংয়ে বসবাসকারী উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নির্যাতন, ইচ্ছেমতো আটকে রাখা, ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন এবং সন্তান জন্মদানের অধিকার লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরা হয়। শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিমরা ব্যাপকহারে আটকের শিকার হচ্ছে। চিনে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবাহিত নারীদের শয্যাসঙ্গী করতে বাধ্য করা হচ্ছে। উইঘুর পুরুষরা চিনের আটক কেন্দ্রে বন্দি। এজন্য তাদের স্ত্রীদের বাসায় তদারকির জন্য যায় সরকারি কর্তারা। কখনও কখনও সরকারি কর্মকর্তাদের বাসায়ও ওই স্ত্রীদের যেতে বাধ্য করা হয়। উভয় সময়ই মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা হয়।
মুসলিম নির্যাতনের এসব তথ্য যাতে চিনের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য তারা প্রতিনিয়িত মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগে বিধি-নিষেধ আরোপ করছে। সরকারিভাবে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য শিনজিয়াং প্রদেশে ভ্রমণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
চিন সরকার কর্তৃক এসব অত্যাচার নির্যাতনে এখনও কোনো উইঘুর মুসলিম প্রতিরোধমূলক কিংবা আত্মরক্ষামূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তারপরও দেশটির সরকার উইঘুর মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে বর্হিবিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে প্রবাহিত করছে। অথচ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি তারা।
এদিকে চিন সরকার মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংসে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। যা ধীরে ধীরে তারা বাস্তবায়ন করছে। তার কিছু হলো-
১. শিনজিয়াং প্রদেশের কোনো পুরনো মসজিদ সংস্কার করতে না দেয়া ও নতুন মসজিদ নির্মাণের অনুমোদন না দেয়া। বৌদ্ধমন্দিরের আদলে মসজিদ সংস্কারে বাধ্য করা।
২. প্রকাশ্যে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা।
৩. পবিত্র হজকে পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
৪. শিনজিয়াং প্রদেশের হুই জেলার লিউ কাউলান ও কাশগড়ের প্রাচীন মসজিদে মুসলিমদের জুম’আর নামাজ আদায় নিয়মিত বাধা প্রদান করা হচ্ছে।
৫. উইঘুর মুসলিমদের ইসলামি সাংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে চিন সরকার নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। মুসলিম যুবকদের বৌদ্ধ মেয়েদের বিয়ে করতে অর্থের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।
৬. মুসলিম গর্ভবর্তী নারীদের অবৈধভাবে গর্ভপাত করানো হচ্ছে আবার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছেলেদের কাছে মুসলিম মেয়েদের জোরপূর্ব বিয়ে দেয়া হচ্ছে বলেও বয়েছে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
৭. মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগও অত্যন্ত সীমিত করা হয়েছে। সুকৌশলে তাদের অশিক্ষিত রাখা হচ্ছে।
ফলে চিনের সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের অধিকার সীমিত হয়ে পড়ছে। মুসলিম বিধি-বিধান বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অন্যান্য সব বিধানও কৌশলে মুছে ফেলার অপতৎপরতা ব্যাপকহারে চালানো হচ্ছে। এমন কি মর্মান্তুদ নিপীড়নের একপর্যয়ে মুসলিম পুরুষ ও নারীদের জন্মশাসন ও বন্ধ্যা করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও শিনজিয়াং প্রদেশের যে কোনো একটি শহরকে ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা ও বিস্ফোরণের জন্য বাছাই করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করছে চিন সরকার। শুধু তাই নয়, ১৯৬৪ সাল থেকে শিনজিয়াং প্রদেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি ক্ষতিকর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
চিন সরকারের জুলুম অত্যাচার থেকে বাঁচার লক্ষ্যে শিনজিয়াংয়ের প্রায় ২৫ লাখ অধিবাসী পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। নানা অজুহাতে উইঘুর মুসলিম নেতৃস্থানীয়দের জেল-জুলুম এমনকি মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে সরকার। উইঘুর মুসলিমদের প্রতি এত নির্যাতন সত্ত্বেও দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা আজও অটুট। শত নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখেও দেশপ্রেমে ভাটা পড়েনি। তারা চিনকে ভালোবাসে। নিজ দেশে নিজেদের প্রিয় ও পবিত্র ধর্ম ইসলাম নিয়েই বেঁচে থাকতে চায় উইঘুর মুসলিম জাতি।
সম্প্রতি ৬ অক্টোবর, মিশেল ব্যাশেলের প্রতিবেদন প্রকাশের পর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিতর্কের একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করা হয় জাতিসংঘে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায় ভোটাভুটিতে। ৪৭ সদস্যের জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে এ প্রস্তাবের পক্ষ ভোট পরে ১৭ টি ও বিরুদ্ধে ১৯ ভোট পরে। এতে ভোটদানে বিরত ছিল ১১ টি দেশ। অত্যন্ত করুণ বিষয়টি হলো উইঘুর মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া ১৯ টি দেশের বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এভাবেই প্রচলিত সিস্টেমের মারপ্যাচে উইঘুরদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশায় গুড়ে বালি! মানবাধিকারের নামে প্রহসনের মঞ্চ সাজিয়েছে জাতিসংঘ। দিনশেষে সমগ্র সিস্টেমটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। প্রচলিত এই সিস্টেমে প্রথমে পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন, আলোচনা-সমালোচনা, ভোট অতঃপর ন্যায়বিচারের পর্বে গোটা সিস্টেমই অন্তঃসারশূণ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মানুষের তৈরি এই সিস্টেমের মাঝেই স্রষ্টার বিধান ও মানুষ প্রণীত বিধানের তফাৎ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। ইসলামের আদর্শে সত্য ও ন্যায়ই সার্বভৌম। ন্যায়ের পক্ষে কেউ থাকুক বা না থাকুক, এ বিষয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে অন্যায়কে দমন করাই মানবতা, আর এটাই ইসলামের শিক্ষা। অন্যদিকে মানবসৃষ্ট বিধান ন্যায়-অন্যায় নিয়ে মাথা ঘামায় না, বরং অধিকাংশের মতে গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে বেড়ানোর শিক্ষা দেয়। অধিকাংশ মানুষ যদি অন্যায়ে পক্ষে অবস্থান করে তবে সে অন্যায়কেই স্বীকৃতি প্রদানে বাধ্য আমাদের প্রচলিত এই সিস্টেম। এখানে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড হচ্ছে অধিকাংশের মতামত। এই মতামত আবার রাজনৈতিক, আর্থ-সামজিক, সামরিক স্বার্থের বেড়াজালে বন্দি। এমন একটি সিস্টেমের বিরুদ্ধাচারণের বদলে মানবিক বিবেককে শিকলবদ্ধ করে দাসত্বের মানসিকতা সহীত এই সিস্টেমের প্রতি আনুগত্য প্রর্দশনই এখন সভ্যতা, এটাই এখন উৎকর্ষ!