বাংলার ইতিহাসের অন্যতম ঐতিহাসিক যুদ্ধ হচ্ছে তুকারয়ের যুদ্ধ যা বাজহুয়ারার যুদ্ধ বা মুঘলমারির যুদ্ধ নামেও পরিচিত। তুকারইয়ের যুদ্ধ ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ঊড়িষ্যার বালাশ্বর জেলার তুকারয় গ্রামে মুঘল সাম্রাজ্য ও বাংলার সুলতানদের মধ্যে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বাংলার সুলতান দাউদ খান কররানি মুঘলদের কাছে পরাজিত হন।
১২০৩-১২০৪ সাল। দিল্লীর তৎকালীন অধীশ্বর খিলজি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার সর্বশেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে তৎকালীন রাজধানী নবদ্বীপসহ বাংলার অধিকাংশ এলাকাকে নিজের অধীনে নিয়ে আসেন। হিন্দু রাজাদের মধ্যে ‘সেন’ বংশই সর্বশেষ শাসক যারা সমস্ত বাংলাকে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলাকে শাসন করত এবং চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই বংশের শাসনের অবসান ঘটে।
মুসলিমদের পূর্বে বাংলার সিংহাসন সেন বংশের দখলে ছিল এবং একে সালাতানাত-এ-বাংলা বলা হত। বিহারও এই বাংলার অধীনেই ছিল। এই বিরাট অংশ বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন ও দিল্লীর অংশ হিসেবে শাসিত হয়েছে। তুর্কি ও আফগানদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বের দরুন কয়েকবার বাংলার ক্ষমতার রদবদল হয় যা ষোড়শ শতাব্দির দিকে মুঘলদের হাতে গিয়ে স্থির হয়।
মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতা যখন জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের হাতে তখন বাংলার সুলতান ছিলেন দাউদ খান কররানী। কররানি রাজবংশের অপর নাম পন্নী। দাউদ খান পন্নী মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত জামানিয়ার দুর্গ দখল করলে আকবর বাংলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপযুক্ত কারণ পেয়ে যান। আকবর সে সময় গুজরাটে অবস্থান করছিলেন এবং এই ঘটনা শোনামাত্রই তিনি জৈনপুরের সুবেদার খান ই খানান মোনেম খানকে বাংলা আক্রমণ করার ফরমান পাঠান। মোনেম খান আদেশ পাওয়ামাত্রই শক্তিশালী মুঘল বাহিনী নিয়ে পাটনা অভিমূখে রওনা হয় এবং সেখানে আফগান সেনানায়ক লোদি খান দ্বারা বাধার সম্মুখিন হয়। লোদি খান সুলতান দাউদ খান পন্নীকে সিংহাসনে বসতে সহযোগিতা করেছিলেন এবং সুলতানের সভার মন্ত্রীও ছিলেন। মোনেম খান বয়সের ভারে নুব্জ ছিলেন এবং কয়েকদফা যুদ্ধের পরই তিনি লোদি খানের সাথে আপসে গেলেন এবং দাউদ খান এর প্রতি পরম ক্ষমাশীল আচরণ প্রদর্শন করলেন। দুই দলের কেউই এতে সন্তুষ্ট ছিল না এবং এরই প্রেক্ষিতে মুঘল সম্রাট আকবর ভাবলেন মো’নেম খান সামরিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত কোমল ও দুর্বল ব্যক্তি। অন্যদিকে দাউদ খান পন্নী মোঘলদের সঙ্গে সন্ধি করার জন্য মন্ত্রী লোদি খানের প্রতি রাগান্বিত হলেন। সম্রাট আকবর বিহারের দায়িত্বভার রাজা টোডরমলের উপর অর্পণ করেন এবং রাজ্যের দাপ্তরিক কাজগুলোর দার্য়িত্বভার সাময়িক সময়ের জন্য রায় রাম দাসের উপর হস্তান্তর করেন। দাউদ খান পন্নী তার নির্দেশ ব্যতিরেকে মোঘলদের তার মন্ত্রী লোদি খানকে হত্যা করে এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। মোনেম খান আকবরের আচরণে নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং পাটনায় গিয়ে সৈন্যদলের দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করে এবং অভিযান পরিচালনা করে কিন্তু অল্পক্ষণেই বুঝতে পারে যে তার বর্তমান শক্তি দ্বারা দূর্গ উদ্ধার সম্ভব নয় তাই মুঘল সম্রাটের নিকট পত্রযোগে অভিযান পরিচালনা করার আমন্ত্রন জানায়।
সম্রাট আকবর সে সময় আজমির শরিফে বার্ষিক সফর শেষ করে আগ্রায় রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবং এরই সাথে সাথে ১৫৭৪ সালে জলযানযোগে বহরসহ নদী পথে পাটনার দিকে যাত্রা আরম্ভ করেন। ১৫ জুন সম্রাট আকবর এই অভিযান শুরু করেন এবং তার সাথে তার অনেক যোগ্য, সামর্থ্যবান ও কুশল হিন্দু ও মুসলিম সেনাপতি অংশ নেয়। আকবরের সভার বিখ্যাত নবরত্নের অন্তর্ভুক্ত ঐতিহাসিক আবুল ফজল ইবনে মোবারক যে তেরো জনের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভগবান দাস, রাজা মান সিংহ, রাজা বীরবল, শাহবাজ খান, কাসিম খান ও নৌপ্রধান বা আমীর আল বহর। বর্ষকালের সব থেকে বৃষ্টিপ্রবণ সময়ে, উত্তাল নদীতে এ যাত্রা শুরু হয় এবং এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। বহু জলযান পানিতে নিমজ্জিত হয় এবং ১১টি জাহাজ এলাহবাদে নিমজ্জিত হয়। ২৬ দিনের ক্লান্তিকর যাত্রার পর আকবর বেনারস পৌঁছান এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান করেন। গঙ্গা নদী ও গোমতি নদী যেখানে মিলিত হয় সেখানকার কাছাকাছি তারা নোঙ্গর করে। এরই সাথে সাথে স্থলবাহিনীও সেখানে এসে পৌঁছায়। পুরো অভিযানটিতে অনবদ্য কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায় কারণ অভিযানটিতে ভীষণভাবে আবহাওয়ার প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়েছিল। নারী ও শিশুদের জৈনপুরে রাখা হয় এবং সম্রাট আকবর মোনেম খানের অনুরোধ অনুসারে সর্বশক্তি নিয়ে চৌসার ঘাটের দিকে অগ্রসর হন। সম্রাট আকবরের পিতা, ভূতপূর্ব মুঘল সম্রাট হুমায়ুন এই চৌসারেই ১৫৩৯ সালে বাংলার সুলতান শের শাহের বাহিনীর কঠিন বাঁধার সম্মুখীন হন ও পরাজিত হন। বাহিনীকে নদীর দক্ষিণদিকে জড়ো করা হয়।
মোনেম খানের অধীনে পাটনা বেশ কয়েকমাস অবরুদ্ধ ছিল। আকবর নৌপথে যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং আগস্টের ৩ তারিখ ১৫৭৪ সালে পাটনার পাশেই অবস্থান গ্রহণ করেন। এখনে অবস্থান নিয়ে আকবর তার সেনাপতিদের সাথে আলোচনায় বসেন। পাটনায় মূলত হাজিপুর থেকে রসদ সরবরাহ হতো যা মূলত গঙ্গার উত্তর অংশের একটি শহর তাই আকবর সিদ্ধান্ত নিলেন প্রথমে হাজিপুর দখল করা প্রয়োজন যাতে পাটনা দখল করা সহজতর হয়। সম্রাট আকবরের অকুতোভয় সেনাপতির মাধ্যমে বর্ষার উত্তাল নদী দ্বারা বেষ্টিত ও শক্তিশালী সেনাদল দ্বারা রক্ষিত হাজিপুরের দুর্গ পরাজতি হয়। আফগান সেনাপতিদের মাথা কেটে আকবরের সামনে উপস্থাপন করা হয় এবং সেগুলোকে সুলতান দাউদ খানের নিকট প্রেরণ করা হয় সতর্কবার্তা হিসেবে।
এর পরই সম্রাট আকবর শহরে দক্ষিণে অবস্থিত ‘পঞ্চ প্রহরী’ নামক কৃত্রিম একটি পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হন এবং সেই অংশটিকে নিজের আওতায় নিয়ে আসেন। যদিও সুলতান দাউদ খানের কাছে ২০ হাজার ঘোড়া, একটি বিশাল অঞ্চল জুড়ে তোপ-কামান ও অনেকগুলি হাতি ছিল তবুও তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঐ সময় মুঘলদের রাজকীয় বাহিনীর সাথে লড়াই না করার এবং সেখান থেকে সরে যাওয়ার। রাতে তিনি পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান এবং বাংলায় চলে আসেন। রাতের বেলা চুপিসারে যে সৈন্যদল নিয়ে পিছু হটা হয়েছিল সেই সৈন্যদলের বেশ ক্ষতি হয়। সম্রাট আকবর তখনই অভিযান চালাতে চেয়েছিলেন কিন্তু ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন এবং ভোরে দিল্লি দরজা দিয়ে পাটনায় প্রবেশ করলেন। তিনি নিজে ৫০ মাইল পর্যন্ত গিয়েছিলেন দাউদ খানের পিছনে পিছনে কিন্তু তাদের ধরতে ব্যর্থ হন।
সুলতান দাউদ খান পন্নী বিশাল রসদ পিছনে ফেলে যান যার মধ্যে অনেক সম্পদ ও স্বর্ণমুদ্রা ছিল যা সাধারণ জনগণ তুলে নেয় এবং ২৬৫ টি যুদ্ধের হাতি, একই ধরনের বেশ কিছু অস্ত্রও ছিল। একটি বিশাল শহর বর্ষার উত্তাল সময়ে দখল করাটা সম্রাট আকবরের জন্য বিশাল এক বিজয় ছিল যা অন্যদিকে বাংলার সুলতানের জন্য ছিল কষ্টকর এক পরাজয়। সুলতান দাউদ খান পুনরায় হিসাব-নিকাশ করে আকবরের বিরুদ্ধে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভারতীয় প্রাচীন রীতি অনুসারে ‘দাসহেরা’ উৎসবের পর যাত্রা আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু সম্রাট আকবর প্রতিকূল পরিবেশকে পাত্তা না দিলে এবং ভারতীয় পুরাতন শাস্ত্র অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত না নিলে অবশ্যই বিজয় অর্জন করতে পারেন।
সেনাবহর বৃষ্টির দিনে থেমে শীতকালে যাত্রা শুরু করবে নাকি এখনই করবে সে সিদ্ধান্তর জন্য সম্রাট আকবর মোটেও বসে রইলেন না তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এখনই যাত্রা শুরু করার। তিনি ২০ হাজার সৈন্য সমাবেশে একটি বাহিনী গঠন করলেন এবং সার্বিক নেতৃত্বের ভার মোনেম খানের উপর হস্তান্তর করে তাকে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করলেন। রাজা টোডরমল ও অন্যান্য কুশল সেনাপতিরা তার অধীনে বেনারস, জৈনপুর ও বিহারে নিযুক্ত হল এবং অন্যান্য অঞ্চলসমূহকেও সম্রাটের অধীন করা হল সেগুলোতেও আকবরের নিযুক্ত সুবেদার নিয়োগ করা হল। সম্রাট আকবর রাজধানীতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বাংলাকে দখল করার দায়িত্ব তার নিযুক্ত সেনপতিদের হাতে হস্তান্তর করলেন। সেপ্টেম্বরের শেষেই মোনেম খান থেকে তার বিজয়ের সংবাদ সম্রাটের কাছে পৌঁছালো। সাত মাসের অভিযান শেষ করে ১৮ জানুয়ারি ১৫৭৫ সালে তিনি ফাতেহপুর সিক্রিতে পৌঁছান।
তুকারয়ের যুদ্ধ
মুঘল বাহিনী বাংলার রাজধানী টান্ডায় (গৌড়র কাছাকাছি) অভিযান চালালে সুলতান দাউদ খান ঊড়িষ্যায় সরে আসেন। এর ফলে মোনেম খান প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পূর্বেই বাধ্য হন অভিযান পরিচালনা করার জন্য। ১৫৭৫ সালের ৩ মার্চ মোগল ও আফগানদের মধ্যে তুকারয়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে মুঘল সেনাপতিগণ বেশ কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং দেখে মনে হচ্ছিল বাংলার সেনাবাহিনী জয়ী হচ্ছে। কিন্তু দিনের পরবর্তীতে সুলতান দাউদ খানের সেনাপতি গুজার খানের নিহত হওয়ার ফলে ভাগ্য মুঘলদের সহায় হয় এবং সুলতান দাউদ খান পন্নী যুদ্ধে পরাজিত হন। যুদ্ধের পর আফগানরা উড়িষ্যার কটকের দিকে পিছু হটে। উভয় দলের মধ্যে ‘কটক সন্ধি’ সাক্ষরিত হয় যেখানে বাংলা ও বিহার মুঘলদের অধীনে চলে যায় এবং শুধুমাত্র ঊড়িষ্যায় সুলতানের আধিপত্য থাকে। মোগলরা তৎকালীন বাংলার আফগান রাজধানী তান্ডা দখল করে নেয়। মোনেম খান তান্ডা থেকে গৌড়ে রাজধানী সরিয়ে নেন। ছয় মাস পর বাংলায় প্লেগ মহামারী ছড়িয়ে পড়লে ৮০ বছর বয়সী মুনিম খান অক্টোবরে মৃত্যুবরণ করেন। সুলতান দাউদ খান পন্নী এই সুযোগটি কাজে লাগান এবং আবার বাংলায় আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে সেনাপতি কালাপাহাড় ও পন্নী রাজবংশের অন্যতম অধিনায়ক ঈসা খান মোগল বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
রাজমহলের যুদ্ধ
আকবর এরপর খান জাহান কুলির অধীনে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। তিনি তেলিয়াগড় দখল করে রাজমহলের দিকে অগ্রসর হন। দুই বাহিনী রাজমহলের যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ অনেক দিন ধরে চলতে থাকে। বিহারের গভর্নর মোজাফফর খান তুরবাতি ও অন্যান্য সেনাপতিদের আকবর তাদের সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে দাউদ খানের পাশে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আফগান নেতা, জুনায়েদ, কুতলু খান ও কালাপাহাড় ছিলেন। ভয়াবহ যুদ্ধের পর ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই ভয়াবহ যুদ্ধের পর দাউদ খান চূড়ান্তভাবে পরাজিত ও নিহত হন। তার মৃত্যুর পর বাংলা সরাসরি মোগলদের অধীনে চলে আসে। সিদ্ধান্তকারী এ যুদ্ধের পর থেকে বাংলা সুবা একজন সুবেদারের অধীনে শাসিত হতে থাকে, যদিও আফগান সেনানায়ক ও জমিদারগণ আরো পঁচিশ বছর ধরে মোঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে যান। এই জমিদার অধিনায়কগণই বাংলার বারো ভুঁইয়া নামে পরিচিত।