মানুষ সমাজ থেকে শেখে। কোনো সমাজে যে মূল্যবোধের চর্চা হয় মানুষ সেটাই নিজের জীবনে ধারণ করে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব পাশ্চাত্য সভ্যতাকে তাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাদের জীবনবিধান ও জীবনযাত্রাকে অনুসরণ করার প্রতিযোগিতা করছে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোও পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা দাজ্জালের প্রবর্তিত গণতন্ত্র, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতিকে অনুসরণ করছে। কেউ অনুসরণ করতে রাজি না হলে তাদের উপর অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক অবরোধ এবং প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা মূলত প্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো উৎকর্ষ দিয়ে মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করছে। এমন সব কাজ করে দেখাচ্ছে যা আগের মানুষ কল্পনাও করতে পারত না। মানুষের জীবনযাত্রাকে সে অনেক সরল করেছে। মানুষ মনে করছে যে সে এখন অনেক সভ্য ও শিক্ষিত হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষও আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এখন এমন আরাম ভোগ করছে যা অতীতের রাজা বাদশাহরাও পারতেন না। সে মুহূর্তেই পৃথিবীর অপরপ্রান্তে কথা বলতে পারছে, বিদ্যুৎশক্তিতে চাকরের মত কাজে লাগাতে পারছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের জীবনব্যবস্থা বা দীন অনুসরণের ফলে কী চরিত্রের মানুষ তৈরি হচ্ছে সেটা একবার ভেবে দেখা দরকার। কেননা দিনশেষে কোনো সমাজ সভ্যতার মানুষ যদি স্যুটবুট পরা পশুতে পরিণত হয় তাহলে সভ্যতা কথাটারই কোনো মানে থাকে না।
দাজ্জাল শব্দের অর্থ চোখ ধাঁধানো, চাকচিক্যময় প্রতারক। মাকাল ফল যেমন দেখতে সুন্দর কিন্তু খেতে কুৎসিত ঠিক তেমনি। পাশ্চাত্য সভ্যতার সুন্দর কথার প্রলোভনে পড়ে কেউ যদি তাকে গ্রহণ করে তাহলেই সে এর ভিতরের জঘন্য রূপের দর্শন পায়।
এই যে কথিত আধুনিক সভ্যতা, এর আদর্শিক ভিত্তি ছিল মানবতাবাদ যা রোমান হিউমিনিটাসের ধারণা থেকে উদ্ভূত। যেমন প্রোটোগোরাস বলেছিলেন, “Man is the measure of all things- মানুষই সমস্তকিছুর মানদণ্ড।” এর আগে ঐশ্বরিক বিধানই ছিল সবকিছুর মানদণ্ড। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পণের সময়ে অর্থাৎ ১৪০০-১৭০০ সন পর্যন্ত এই বৃহৎ সময়ে ইউরোপে নতুন এই কথিত ‘মানবতাবাদী’ চিন্তার বিকাশ ঘটে। এর মাধ্যমে মধ্যযুগের সংকটের পর যে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে রেনেসাঁ (Renaissance) বা নবজাগরণ বলা হয়ে থাকে। শিল্প, স্থাপত্য, নৈতিক দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সাহিত্যে এই নতুন চিন্তার প্রকাশ ঘটে। ধর্মের কর্তৃত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করাই ছিল রেনেসাঁর মূল লক্ষ্য, যদিও শুরুতে চেষ্টা করা হয়েছিল মধ্যযুগে ইউরোপময় চালু থাকা বিকৃত খ্রিষ্টীয় মোল্লাতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে নিউ টেস্টামেন্টের মূল শিক্ষায় ফিরে যেতে। ১৫২৭ সালে মার্টিন লুথার তাঁর ‘দ্য নাইন্টি ফাইভ থিসিস’ গ্রন্থে রোমান ক্যাথেলিক যাজকীয় নীতি, তাদের প্রচলিত খ্রীস্ট বিশ্বাস নিয়ে অনেক ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেন। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যেই প্রথাবিরোধী মানবতাবাদীরা প্রোটেস্ট্যান্ট নামক সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলেন। মানুষ সর্ব উপায়ে খ্রিষ্টধর্মের যাজকশ্রেণির অবদমনমূলক শাসন-ত্রাসনের হাত থেকে নিস্তার চাচ্ছিল। রেনেসাঁর ‘মানবতাবাদ’ ছিল মধ্যযুগীয় সংকীর্ণ যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি জাগরণ। এই রেনেসাঁর স্রষ্টা মানবতাবাদীরা (যাদের অধিকাংশই ছিলেন নাস্তিকতার দায়ে অভিযুক্ত) চেয়েছেন এমন একটি সভ্যতা গড়ে তুলতে যেখানে একটি জাতি তার বেসামরিক জীবনে তাদের স্বাধীন মতের প্রতিফলন ঘটাতে পারবে। এটা ছিল তাদের একটি স্বপ্ন যা কোনোদিন অর্জিত হয় নি। আজ ৫০০ বছর পর সেই বস্তুবাদী সভ্যতার মানবতাবাদী বুলি মিথ্যা পরিহাসে পরিণত হয়েছে। সেই সভ্যতা এক অতিকায় মহাশক্তিশালী দানব দাজ্জালের রূপ নিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করে চলেছে। সে কথা পরে হবে।
রেনেসাঁ কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তা বুঝতে মধ্যযুগীয় বর্বরতার (Dark Ages) পটভূমি জানা জরুরি। এ সম্পর্কে এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা, অক্সফোর্ড ডিকশনারি ও উইকিপিডিয়ায় যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ হচ্ছে- ৫ ম শতাব্দি থেকে ১৫ শ শতাব্দি পর্যন্ত যখন ইউরোপের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে জর্জরিত ছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে অনেক দুরে অন্ধকারে ছিল। এ সময়টিতে ইউরোপে খ্রিষ্টধর্ম প্রবল পরাক্রান্তভাবে রাজকীয় ক্ষমতার অংশীদার ছিল। ৩১৩ খ্রিষ্টাব্দের রোম সম্রাট কন্সটানটাইন ও বলকান অঞ্চলের সম্রাট লিসিনিয়াসের মধ্যে সম্পাদিত ‘এডিক্ট অব মিলান’ চুক্তির মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের সর্বত্র রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে কায়েম হয়ে যায়। সম্রাট খ্রিষ্টধর্মকে সার্বজনীন বা ক্যাথেলিক হিসাবে ঘোষণা করেন এবং পাদ্রিদেরকে উচ্চবেতন, ক্ষমতা ও পদমর্যাদা প্রদান করেন। কিন্তু খ্রীষ্টধর্মে জাতীয় জীবনের কোনো বিধান না থাকায় বাধে বিপত্তি। এতে আছে কেবল স্রষ্টার স্তব, ঈসা (আ.) এর জীবনের নানা ঘটনা, পূর্বের নবীদের ইতিহাস, প্রার্থনা, নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী ইত্যাদি যা মানুষের মানবিক গুণাবলিকে সমৃদ্ধ করবে, কিন্তু যা দিয়ে একটি জাতীর জাতীয়, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, বিচারিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি অঙ্গনের কোনো সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ এ বিষয়ে বাইবেলের নতুন নিয়মে কোনো আলোচনাই নেই। কেননা ঈসা (আ.) এর শিক্ষা কেবল বনি ইসরাইল গোত্রের জন্য প্রযোজ্য ছিল। ইহুদিদের বাইরে এই ধর্ম প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। ঈসা (আ.) বলেছিলেন, শুধুমাত্র ইসরাইলের পথভ্রষ্ট মেষগুলি ছাড়া অন্য কারো জন্য আমাকে পাঠানো হয় নাই (বাইবেল- নিউ টেস্টামেন্ট, ম্যাথু ১৫:২৪)। কিন্তু তাঁর অন্তর্ধানের তিন শতাব্দি পর খ্রিষ্টধর্মকে যখন রাজধর্ম তথা জীবনব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করা হল, তখন নিউ টেস্টামেন্টে জাতীয় জীবনের বিধানের অনুপস্থিতি একটি বিরাট ঘাটতি হিসাবে দেখা দিল। আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতিহীন একটি ব্যবস্থা দিয়ে একটি সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা অসম্ভব এটা সাধারণ জ্ঞান। অথচ পোপ ও ইউরোপীয় রাজারা সেই ব্যর্থ চেষ্টাই করলেন কারণ ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ বাদ দিয়ে অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেরা সার্বভৌম হয়ে নতুন সংবিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি প্রণয়ন করে নেয়া তখনও মানুষের কাছে অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার ছিলো। এই চেষ্টা করতে যেয়ে প্রতিপদে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের ব্যাপারে সংঘাত আরম্ভ হলো এবং ক্রমশ তা এক প্রকট সমস্যারূপে দেখা দিলো। এই সমস্যার কিছু বিবরণ দেওয়া আবশ্যক।
ব্রিটেনে আজ থেকে মাত্র দেড়শ বছর আগেও পুরুষরা জনসমাগমে স্ত্রীর ঘাড়ে, বাহুতে বা কোমরে লাগাম (Halter) বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াত এবং নিলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি করে দিত। ছবি: Selling a Wife (1812–1814), থমাস রোল্যান্ডসন
ঈসা (আ.) এর শিক্ষায় জাতীয় জীবনব্যবস্থার ঘাটতি পুরনে এগিয়ে এলেন ধর্মযাজকরা, যারা কিনা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। ক্ষমতা ও ঐশ্বরিক পদমর্যাদাবলে পাদ্রিরা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত দিতে লাগলেন এবং জনগণকে তা ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতে হল। তারা রাজার সকল অন্যায়-অত্যাচারকে ধর্মীয় বৈধতা দিতে লাগল। এভাবেই সমগ্র ইউরোপে চলতে থাকল দ্বৈতশাসন- একদিকে রাজা ও জমিদার শ্রেণির শাসন, অপর দিকে গির্জার শাসন।
গির্জার নিপীড়নের ভয়াবহতা ও সীমাহীন অন্ধত্বের চর্চা নিয়ে বহু বই লেখা হয়েছে রেনেসাঁর যুগে। সে যুগের বর্বরতা কতটা তুঙ্গস্পর্শী ছিল তা বোঝানোর জন্য ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ একটি বাগধারায় পরিণত হয়ে গেছে। তবু কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়- যেমন ডাইনি শিকার বা Witch-hunt.৭৮৫ সালে চার্চ অব প্যাডেরবর্ন ডাকিনীবিদ্যা নিষিদ্ধ করে। এই বিধানের আওতায় প্রায়ই ডাইনি শিকার করা হত। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে সে বিচার দেখত এবং ডাকিনীবিদ্যা বা শয়তান উপাসনায় জড়িত থাকায় বা ধর্ম-অবমাননার দায়ে অভিযুক্তদেরকে ধরে পুড়িয়ে মারা হত। সারা ইউরোপে প্রায় ১২,০০০ জনকে ডাইনি বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছিল যাদের অধিকাংশই ছিল নারী। এছাড়া বহু বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজবিপ্লবীকে ডাইনি সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে এবং বিশ্বজগৎ একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে বলায় বিজ্ঞানী জিওর্দানো ব্রুনোকে রোমের রাজপথে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। উল্লেখ্য, যিশু রক্তপাতের ঘোর বিরোধী ছিলেন; তাই পাদ্রীরা বিনা রক্তপাতে মৃত্যু ঘটানোর জন্য ফাঁসি দেওয়া, বৃহদাকৃতির কড়াইতে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফেলে দিয়ে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে মারার পক্ষপাতি ছিলেন। বিজ্ঞানী ব্রুনোকে সমর্থন করার অপরাধে গ্যালিলিও গ্যালিলিকে দীর্ঘ আট বছর অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছিল।
মধ্যযুগে ইউরোপে নারী নির্যাতন প্রবল আকার ধারণ করেছিল। ১৭৫৩ সনে বিবাহ আইন প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপে বিয়ে করতে যথাক্রমে ১২/১৪ বছরের নারী পুরুষের সম্মতিই যথেষ্ট ছিল, কোনো সাক্ষী লাগত না, কোনো লেখাজোখা থাকত না। ফলে ব্যভিচার চরম আকার ধারণ করেছিল। নারীদের জীবনের কোনো মূল্যই ছিল না। খোদ ব্রিটেনে আজ থেকে মাত্র দেড়শ বছর আগেও পুরুষ তার স্ত্রীকে বিক্রি করতে পারে। স্বামীরা জনসমাগমে স্ত্রীর ঘাড়ে, বাহুতে বা কোমরে লাগাম ((Halter) বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াত এবং নিলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি করে দিত। ১৮৬৯ সালে এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়। (দেখুন Wife Selling – Wikipedia)
সমাজবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন পাশ্চাত্যের ইতিহাসের মধ্যযুগে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কর্তৃত্বের স্বরূপ তুলে ধরেন এভাবে, “ঈশ্বর ও সম্রাট, গির্জা ও রাজ্য, আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কর্তৃত্ব পশ্চিমা সংস্কৃতিতে দ্বৈতভাবে বহুকাল যাবৎ প্রচলিত ছিল। ইসলামে আল্লাহই সম্রাট, চীন ও জাপানে সম্রাটই ঈশ্বর আর অর্থডক্স খ্রিষ্টান ধর্মে ঈশ্বর হলেন সম্রাটের জুনিয়র পার্টনার। ধর্মশালা ও রাষ্ট্রের মধ্যে বারবার সংঘর্ষ ও বিচ্ছিন্নতা পশ্চিমা সভ্যতার প্রতীকরূপে চিহ্নিত।” [দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড অর্ডার- স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন]
খ্রিষ্টধর্মের মধ্যে ছিল বহু মতবাদ, আর প্রতিটি মতবাদের ছিল পৃথক পৃথক চার্চ। ক্যাথলিক যাজকরা ক্রমেই প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে যান এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করতে শুরু করেন। জার্মান সম্রাটগণ চার্চকে রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা লর্ডদের উপরে বিশপদেরকে বহাল করেছিলেন। কিন্তু যতই দিন যায়, চার্চ আরো বেশি ক্ষমতার জন্য দাবি তুলতে থাকে। পোপগণ নিজেদেরক সম্রাটের চেয়ে উঁচু মর্যাদায় নিয়ে যেতে প্রবৃত্ত হন। একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পোপ সপ্তম গ্রেগরি নাটকীয়ভাবে খ্রিষ্টান দুনিয়ার নেতৃত্বে চলে আসেন। চার্চের ক্ষমতাকে সুসংহত করে তিনি ক্রমে সম্রাটের প্রতিপক্ষে পরিণত হন। পোপ সপ্তম গ্রেগরির মতে, ‘পোপ সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভ করেন। পোপ পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এ কারণে পোপ পৃথিবীতে কারও অধীন হতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারও কাছে পোপের কাজের জবাবদিহিতা উচিত হতে পারে না। সপ্তম গ্রেগরি দাবী করেন যে, পোপ ঈশ্বরের অধীন আর ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলেই পৃথিবীর সকল মানুষ পোপের অধীন। ১০৭৫ সালে তিনি তাঁর নতুন বিধান সম্বলিত গ্রন্থ ‘ডিক্টেটাস পাপা’ প্রকাশ করেন। জনগণের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ধর্মযাজকরা। গির্জার চাপে ক্রমে রাজারা দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ভূস্বামী বা জমির মালিকরা সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। বর্বর আক্রমণ, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, শিক্ষা-দীক্ষার অভাব, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সভ্যতা সংস্কৃতির অবনতি ছিল মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য। একদিকে রাজা, একদিকে জমিদার, আরেকদিকে চার্চ- এই ত্রিমুখী নিষ্পেষণে পিষ্ট মানবাত্মা মুক্তির জন্য ত্রাহিসুরে চিৎকার করতে থাকে। অথচ প্রাচ্যে মুসলিম শাসনের তখন স্বর্ণযুগ। জ্ঞানবিজ্ঞান, ধন-সম্পদ সবদিকে মুসলিমরা সেরা জাতি। পোপ তাঁর হারানো মর্যাদা ও শক্তিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের ডাক দেন। দুইশ বছর ধরে চলে ধর্মের নামে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যাকে ইউরোপের রাজারা নিজেদের রাজ্যবিস্তারে ব্যবহার করেন। ক্রুসেডে যোগদান ছিল সকল যুদ্ধক্ষম পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক। পোপ দ্বিতীয় আরবানের পক্ষ থেকে বলা হয়, যিশু তাদেরকে কবর থেকে ডাকছেন যেরুজালেম উদ্ধার করার জন্য। পাদ্রীরা সমগ্র ইউরোপে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে। ছড়িয়ে দেয় একটি শ্লোগান- এটাই আল্লাহর মর্জি (Deus uvlt- ‘God wills it’)। উত্তেজিত জনগণকে সর্বস্ব বিক্রি করে, আরো নিঃস্ব হয়ে যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটাতে হয়। ইউরোপে তাদের জীবন হয়ে যায় নরকতুল্য। কিন্তু দুইশ বছরের এই যুদ্ধের দ্বারা পোপ ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করলেও তার প্রতি মানুষের নিঃশর্ত আনুগত্য আর ফিরিয়ে আনা গেল না।
১০৯৫ সালে পোপ দ্বিতীয় আরবান যাজকতন্ত্রের হারানো মর্যাদা ও শক্তিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য ফ্রান্সের ক্লারমন্ট চত্তরে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের ডাক দেন। তার ভাষণ ইউরোপের খ্রিষ্টানদের মধ্যে মুসলিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও জিঘাংসা সৃষ্টি করে। ইতালিয় চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিসকো হেইজ ১৮৩৫ সনে ছবিটি আঁকেন।
এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতেই ধর্মের বিরুদ্ধে নবজাগরণ বা রেনেসাঁর দ্বার উন্মোচিত হয়। সমাজবিপ্লব হয়। মানুষকে এই অন্ধত্বের অচলায়তন ভাঙার জন্য শিল্পীরা হাতে নেন রংতুলি, ভাস্কররা হাতে নেন হাতুড়ি ছেনি, নাট্যকাররা প্রতিষ্ঠা করেন থিয়েটার, লিখনি হাতে তুলে নেন লেখকরা। ডিভাইন কমেডি লিখলেন মহাকবি দান্তে (১২৬৫-১৩২১)। ছবি আঁকলেন ইতালির চিত্রকর গিয়োট্টে দ্য বাইন্ডন (১২৬৭-১৩৩৭), সান্দ্রো বত্তিচেল্লি (১৪৪৫-১৫১০), লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯), রাফায়েল (১৪৮৩-১৫২০)। ভাস্কর্য গড়লেন দোনাতেল্লো (১৩৮৬-১৪৬৬), মাইকেল এঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪) প্রমুখ। নাটক লিখলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬), ক্রিস্টোফার মার্লো (১৫৬৪-১৫৯৩), বেন জনসন (১৫৭২-১৬৩৭)।
জানা কথা বাইবেল দিয়ে রাষ্ট্র চলবে না, সেখানে ওই আলোচনা নেই। মুসলিম রাজারা তো নারী, সুরা নিয়ে ভোগবিলাসে মত্ত। ইউরোপে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কোনো স্বপ্নও তারা দেখেন না। সুতরাং নতুন জীবনব্যবস্থা রচনায় মনোনিবেশ করেন রাজনৈতিক দার্শনিকরা। মানুষের মন থেকে ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধত্ব, ধর্মভীতি দূর করার এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে নামেন রেনেসাঁর অগ্রনায়করা। তারা ধর্মকেই মিথ্যা-অসার বলে নানাভাবে প্রকাশ করতে লাগলেন। গির্জা ও রাজার সহাবস্থান যখন অসম্ভব হয়ে উঠল তখন ধর্মের সংশ্রব ছাড়া রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি প্রণয়ন করা হল। ধর্মকে যেহেতু একেবারে নির্মূল করে ফেলা সম্ভব নয়, এটা মানুষের বিশ্বাসের বস্তু, তাই ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ঘটল। আধুনিক রাজনীতি, কূটনীতির জনক এবং আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের পথ প্রদর্শক ইতলিতে জন্মগ্রহণকারী নিকোলো মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) যাঁকে রেনেসাঁর সন্তান বলেও আখ্যায়িত করা হয়। তিনি রাজনৈতিক বিষয়াদিকে ধর্মনিরপেক্ষ বা ইহজাগতিক চেতনার দ্বারা পরিচালিত করার মানসে তাকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় ও নৈতিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তবে তিনি জনগণের জন্য ধর্ম ও নৈতিকতাকে অস্বীকার করেন নি। তাঁর মতে ধর্ম কেবল পারলৌকিক ব্যাপার। তা মানুষকে বাস্তববাদী কর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ধর্ম নয়, রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বড়। নৈতিকতার ধারণা সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, নৈতিকতা আপেক্ষিক। তাছাড়া শাসক প্রয়োজনে ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন এমন কথাও তিনি বলেছেন। তাঁর যুগান্তকারী পুস্তক ‘দ্য প্রিন্স’ এ তিনি রাষ্ট্রচিন্তার মূল বিষয়গুলো বিবৃত করেন। ম্যাকিয়াভেলী তাঁর শাসককে ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি, দয়া-দাক্ষিণ্য সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতারণা, কপটতা ও নিষ্ঠুরতার পথকে গ্রহণ করতে বলেছেন। এটিকেই মূলত ম্যাকিয়াভেলিবাদ বলে।
স্থানীয় সাহিত্যেও এর প্রতিফলন ঘটল। বোকাচ্চিওর ‘ডেকামেরন’ ও চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেল্স’ পোপের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ দলিলরূপে পরিচিত। ইংল্যান্ডের ওয়াইক্লিফিট আন্দোলন ও জার্মানির বোহেমিয়ার হাসাইট আন্দোলন একাধারে ছিল গণআন্দোলন ও চার্চের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন।
ইউরোপীয় রাজা ও সমাজ নেতাদের সামনে দু’টো পথ খোলা রইল- হয় এই ধর্ম বা জীবন-ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে হবে, আর নইলে এটাকে নির্বাসন দিতে হবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণ পরিধির সীমাবদ্ধতার মধ্যে, যেখান থেকে এটা রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোন প্রভাব বিস্তার না করতে পারে। যেহেতু ধর্মকে মানুষের সার্বিক জীবন থেকে বিদায় দেয়া অর্থাৎ সমস্ত ইউরোপের মানুষকে নাস্তিক বানিয়ে দেয়া সম্ভব নয়, তাই শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র ও সমাজ নেতারা দ্বিতীয় পথটাকে গ্রহণ করলেন।
বিভিন্ন দেশের জাতীয় সরকারগুলো পোপের অধীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হয়ে উঠল। এরই ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ডে চতুর্দশ শতাব্দিতেই পোপের ক্ষমতার বিরুদ্ধে রাজা অষ্টম হেনরির (২৮ জুন ১৪৯১ – ২৮ জানুয়ারী ১৫৪৭) Reformation Parliament কয়েকটি আইন পাস করে। তার আমলেই মানব ইতিহাসের এই মহাগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে। প্রথমে ‘অ্যাক্ট ফর দ্য সাবমিশন অফ দ্য ক্লারজি’র দ্বারা যাজকদের রাজার অধীনে আনা হয় (১৫৩৩)। ‘অ্যাক্ট অফ অ্যাপিল’ প্রণয়নের দ্বারা ইংল্যান্ডের সমস্ত চার্চগুলির ওপর পোপের ক্ষমতা রদ করেন (১৫৩৩)। এরপরেই ‘অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি’র দ্বারা রাজাকে চার্চের সর্বময় কর্তা হিসেবে স্বীকৃতি জানানো হয় (১৫৩৪)। অষ্টম হেনরির রাজত্বকে ইংরেজ ইতিহাসের “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ” সময় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে (The Tudors: A Very Short Introduction – John Guy)|ইতিহাসের এই বাঁকটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ তার একটু ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, মানবজাতির ইতিহাস যতটুকু জানা যায় তাতে এর পূর্বে স্রষ্টার বিধান বা ধর্মের অনুশাসন দ্বারাই সকল রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে (সীমিত কালখণ্ডে ব্যতিক্রম গ্রিসের ক্লাসিকাল যুগ)। যদিও সব সময় ধর্মের শিক্ষা অবিকৃত ছিল না, তবু ধর্মের নাম দিয়েই সেই বিধানগুলো জাতীয় রাষ্ট্রীয় জীবনে চালাতে হয়েছে। রাজা যত ক্ষমতাবানই হোন, তাকে ধর্মজ্ঞানী পুরোহিত শ্রেণিকে পৃষ্ঠপোষণ করতে হয়েছে, তাদের মনতুষ্টি করেই রাজ্য চালাতে হয়েছে। মানুষ কখনও নিজের হাতে আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি সংবলিত জীবনবিধান রচনার ভার তুলে নেয় নি। এই প্রথম ইহলৌকিক জীবনের পরিচালনার সমগ্র দায়িত্ব মানুষ নিজে গ্রহণ করে স্রষ্টাকে কেবল পরকালের অধিকর্তা হিসাবে, উপাস্য হিসাবে সাব্যস্ত করল। জাগতিক জীবনের কাঠামোতে ধর্মের কোনো কর্তৃত্ব রাখা হল না। নৈতিকতার কোনো সার্বজনীন মানদণ্ড রাখা হল না। এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মকে মানুষের সার্বিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসিত করা হলো, দাজ্জালের জন্ম হলো।
১৫৩৪ সনে ব্রিটেনে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মকে মানুষের সার্বিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসিত করার সময় থেকেই শুরু হয় মধ্যযুগ থেকে আধুনিক ইউরোপের পথচলা। একটি নতুন সভ্যতার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। অবশ্য এই বিকাশ ও উন্নতি কেবল বৈষয়িক জীবনের, চারিত্রিক নয়। ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা ক্রমেই বস্তুবাদী (Materialistic) হয়ে পড়তে শুরু করল। এটা একটা পরিহাস (Irony) যে, যে জাতির সকল লোক এমন একটি ধর্ম গ্রহণ করলো যে ধর্মের মূলমন্ত্রই হচ্ছে আত্মশুদ্ধি, কেউ এক গালে চড় দিলে তাকে অন্য গাল পেতে দাও, জোর করে গায়ের কোট খুলে নিলে তাকে আলখেল্লাটাও দিয়ে দাও, সেই জাতি একটি কঠোর বস্তুবাদী সভ্যতার জন্ম দেবে। তারা প্রথমেই সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে অনুসন্ধান ও ভৌগোলিক আবিষ্কার শুরু হয়। সমুদ্রতীরের দেশসমূহের মানুষজনের পেশা ছিল মাছ ধরা ও ব্যবসা বাণিজ্য। তবে মহাসাগর অতিক্রম করার কথা প্রথমে ভাবে পর্তুগিজ ও স্পেনিশ নাবিকরা। এসব অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে লাভজনক উপনিবেশিক রাজত্বের বিস্তার। নতুন নতুন ভূখণ্ড ও সমুদ্রপথ আবিষ্কারকারী নাবিকদের মধ্যে কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামা, বার্থোলোমে দিয়াজ, ম্যাগেলান অন্যতম। তাদের দুঃসাহসী অভিযানের দ্বারা নতুন গোলার্ধ, নতুন মহাদেশ, নতুন দেশ, নতুন দ্বীপ, নতুন সভ্যতা আবিষ্কৃত হল। আমেরিকা মহাদেশ, ভারতর্ষ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার অধিকাংশ ভূখণ্ডই ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতি দখল করে নিল।
১৫শ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই আবিষ্কার ও অনুসন্ধানের যুগে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ব্যাপক সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায় এবং বিশ্বায়নের সূচনা করে। ইউরোপে উপনিবেশবাদ ও বাণিজ্যবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটে এবং তা বিভিন্ন দেশের জাতীয় নীতি হিসবে গৃহীত হয়। ইউরোপিয়ানদের সমুদ্র অভিযানে দাস ব্যবসার বিশ্বায়ন শুরু হয়। স্পেনীয়রা আমেরিকায় পৌঁছালে সেখানকার বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে রাস্তাঘাট নির্মাণে প্রচুর সস্তা শ্রমিকের দরকার পড়ে। তারা দেখল যে ক্রীতদাস প্রথাই আদর্শ সমাধান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পেরু, মেক্সিকো, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশের গরিব জনগণকে ধরে ধরে দাস বানিয়ে এ কাজ উদ্ধা করা হল। মাটি খুঁড়ে সোনা রূপা কয়লা বের করতে আরও দাস দরকার পড়ল। এভাবে গড়ে প্রতি বছরে ৭৫ হাজার থেকে ৮৬ হাজার দাসকে আটলান্টিকের এপার থেকে ওপারের আমেরিকা মহাদেশে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা উচ্ছেদের ঘোষণা (Emancipation Proclamation-1863) দিলেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিগ্রহ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়।
এদিকে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটতে থাকে। মুসলিম বিজ্ঞানীদের বহুবিধ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের ভিত্তির উপর নতুন প্রযুক্তিগত সভ্যতার ইমারত প্রতিষ্ঠা করেন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা। এই কারিগরি আবিষ্কারগুলো ইউরোপে সামতন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে নতুন ধনতন্ত্রের পথ সুগম করেছে। এই প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে অশ্বশক্তি, জলশক্তি ও বায়ুশক্তির ব্যবহার। সমুদ্রপথে চলাচলের জন্য জাহাজের হাল ও কম্পাসের আবিষ্কার, বারুদের আবিষ্কার; কাচ, কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার। এই সকল প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পেছনে মুসলিম আবিষ্কর্তাদের বিপুল অবদান রয়েছে। এভাবে জ্ঞান হাতবদল হয়ে প্রাচ্য থেকে ইউরোপে চলে আসে। ইউরোপের পদানত দাসে পরিণত হতে থাকে একের পর এক মুসলিম ভূখণ্ড।
এভাবে ইউরোপীয়দের চিন্তার ঘরের এক হাজার বছরের রুদ্ধদ্বার খুলে যায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে, শিল্পবিপ্লবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, ব্যাঙ্ক বীমা স্থাপনে, কৃষিতে, সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায়, চিকিৎসায়, প্রকৌশলে, যুক্তিবিদ্যায়, দর্শনে, শিল্পে, সাহিত্যে বিকশিত হয়ে উঠল। অতীতের ভাববাদী দর্শনের পৃষ্ঠাকে উল্টে রেখে সকল বিষয়ে একটি বস্তুবাদী দর্শন, সকল প্রশ্নের, সকল ইতিহাসের একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলল। আগে মানব ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা হত আদম-হাওয়া থেকে, এখন ডারউইনসহ অন্যান্য প্রকৃতিবিদগণ নিয়ে আসলেন বিবর্তনবাদ। বিশ্বজগৎ সৃজনের কৃতিত্বও আর স্রষ্টাকে দেওয়া হল না, বলা হল আমরা একটি আকস্মিকভাবে সৃষ্ট মহাবিশ্বে (an accidental universe) বাস করছি। বিজ্ঞান ও ধর্মকে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করানো হল। এই যুগটিকে আলোকায়নের যুগ (১৬৮৫-১৮১৫), Age of Enlightenment অথবা অমব Age of reason বলা হয়ে থাকে। আলোকিত যুগের দর্শনের মতে ক্যাথেলিক চার্চের কর্তৃত্বের পাশাপাশি রাজতন্ত্রও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। তারা এসকল প্রথা বা ঐতিহ্যের পরিবর্তে যুক্তিনির্ভর একটি সমাজকাঠামো গড়ে তুলতে মানুষকে উৎসাহিত করেন।
১৭৮৯ সালে অঙ্কিত এই কার্টুনটিতে ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় তিন শ্রেণির মানুষ ছিল- শ্রমজীবী সাধারণ জনতার (থার্ড এস্টেট) পিঠে সওয়ার হয়েছিল অভিজাত বুর্জোয়া শ্রেণি (সেকেন্ড এস্টেট) এবং খ্রিষ্টান ধর্মব্যবসায়ী যাজক সম্প্রদায় (ফার্স্ট এস্টেট)।
ফ্রান্সের সাধারণ মানুষকে রাজার আরোপ করা কর, গির্জা কর্তৃক আরোপ করা কর, ভুস্বামী বা জমিদারদের আরোপ করা কর দিতে হতো। আইনও ছিল গরিবের বিপক্ষে। তাদের বিচার করার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামানো হতো না। সব মিলিয়ে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। মানুষ সামাজিক বৈষম্য, কর্মহীনতা, ক্ষুধা, প্রভাবশালী, অভিজাত, বুর্জোয়া শ্রেণির আগ্রাসন, করারোপের মাধ্যমে শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়ষ লুইয়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ডাক দেন আলোকিত যুগের অন্যতম প্রবক্তা জ্যাক রুশো। তিনি তাঁর লেখনির মাধ্যমে ফরাসি মননে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জাগ্রত করতে সক্ষম হন। মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, দেনিস দিদেরো প্রমুখ লেখক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাহিত্যিকগণও ফরাসি বিপ্লবের (১৪ জুলাই ১৭৮৯) মানসিক ক্ষেত্র প্রস্তুতে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের চিত্র বদলে দিয়েছিল। মানুষের চিন্তার জগৎ আলোড়িত হয়েছিল। বহুদেশে রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব গোটা মানব সভ্যতাকে বস্তুবাদী ধর্মবিবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুনভাবে লিখতে ভূমিকা রেখেছে। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। উনিশ শতকে ফ্রান্স ছাড়িয়ে সারা ইউরোপে নতুন ভাবধারার সূচনা করেছিল এই বিপ্লব।
খ্রিষ্টধর্ম মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা ব্যর্থ হওয়ার পর সার্বভৌমত্ব আল্লাহর হাত থেকে মানুষের হাতে তুলে নেবার পর সংবিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি তৈরী করে মানব জীবন পরিচালনা আরম্ভ হলো, যার নাম দেয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র (Secular Democracy)। টমাস হবস, ডেভিড হিউম, জন লক, স্পিনোজা প্রমুখ দার্শনিকগণ তাঁদের বিভিন্ন তত্ত্বে এই সংসদীয় গণতন্ত্রের রূপরেখা প্রস্তাব করেন। এই গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব রইলো মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে। অর্থাৎ মানুষ তার সমষ্টিগত, জাতীয় জীবন পরিচালনার জন্য সংবিধান ও সেই সংবিধান নিঃসৃত আইন-কানুন প্রণয়ন করবে শতকরা ৫১ জন বা তার বেশী। যেহেতু মানুষকে আল্লাহ সামান্য জ্ঞানই দিয়েছেন সেহেতু সে এমন সংবিধান, আইন-কানুন দণ্ডবিধি, অর্থনীতি তৈরী করতে পারে না যা নিখুঁত, নির্ভুল ও ত্রুটিহীন, যা মানুষের মধ্যকার সমস্ত অন্যায়, অবিচার দূর করে মানুষকে প্রকৃত শান্তি (ইসলাম) দিতে পারে। কাজেই ইউরোপের মানুষের তৈরী ত্রুটিপূর্ণ ও ভুল আইন-কানুনের ফলে জীবনের প্রতিক্ষেত্রে অন্যায় ও অবিচার প্রকট হয়ে উঠলো। বিশেষ করে অর্থনৈতিক জীবনে সুদভিত্তিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করায় সেখানে চরম অবিচার ও অন্যায় আরম্ভ হয়ে গেলো। মুষ্টিমেয় মানুষ ধনকুবের হয়ে সীমাহীন প্রাচুর্য্য ও ভোগবিলাসের মধ্যে ডুবে গেলো আর অধিকাংশ মানুষ শোষিত হয়ে দারিদ্র্যের চরম সীমায় নেমে গেলো। স্বাভাবিক নিয়মেই ঐ অর্থনৈতিক অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ইউরোপের মানুষের এক অংশ বিদ্রোহ করলো ও গণতান্ত্রিক ধনতন্ত্রকে বাদ দিয়ে নতুন কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসন্ধান করতে শুরু করল। এমন একটি সময়ে জন্ম নিল সমাজতান্ত্রিক মতবাদ।
সবকিছুর বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর ধারাবাহিকতায় জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) উদ্ভাবন করলেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বা Dialectical materialism, এবং ১০ বছর ধরে লিখলেন পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক যুগান্তকারী বই ডাস ক্যাপিটাল। ওদিকে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস দিলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা। এই দুইজনে যৌথভাবে লিখলেন কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টো (১৮৪৮)। বাজল পুঁজিবাদের বিদায়ঘণ্টা। তাঁরা বললেন, মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শাসক আর শোষিত। বললেন মানুষের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। তাদের প্রচারিত সমাজতন্ত্র লেনিনের নেতৃত্বে তিন মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম একটি বৃহত্তম সাম্রাজ্য রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে দিল। বিশ্বের বড় একটি অংশের মানুষ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করলো। ইউরোপের মানুষের অন্য একটা অংশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যান্য দিকের ব্যর্থতা দেখে সেটা বাদ দিয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলো। অর্থাৎ গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্র, ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এগুলো সবই অন্ধকারে হাতড়ানো, এক ব্যবস্থার ব্যর্থতায় অন্য নতুন আরেকটি ব্যবস্থা তৈরী করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রকৃতপক্ষে সমষ্টিগত জীবনের ধর্মহীনতা অবলম্বন করার পর থেকে যত তন্ত্র (-cracy), যত বাদই (-ism) চালু করার চেষ্টা ইউরোপের মানুষ করেছে সবগুলির সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে রয়েছে। অর্থাৎ রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, এসবগুলিই মানুষের সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন ধাপ, বিভিন্ন পর্যায় (Phase, step) মাত্র। এই সবগুলি তন্ত্র বা বাদের সমষ্টিই হচ্ছে এই ইহুদী-খ্রিষ্টান সভ্যতা, দাজ্জাল।
ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত শোষিত-বঞ্চিত মানুষর মুক্তির আশায় অবশেষে যে সমাজতন্ত্রকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল, সেই সমাজতন্ত্রও মুক্তি দিতে ব্যর্থ হল। কয়েক বছরের মধ্যেই পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতার উগ্রতম রূপ সমাজতন্ত্রকে মানুষ ভীষণভাবে প্রত্যাখ্যান করল। সমাজতন্ত্র পৃথিবীতেই ‘স্বর্গ’ দেবে শুনে যেসব দেশ একে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল, শীঘ্রই তারা বুঝতে পারল যে তারা প্রতারিত হয়েছে। তারা আসলে নরকে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তখন বেশি দেরি হয়ে গেছে। তবুও তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে লাগলো ঐ স্বর্গ থেকে বের হয়ে আসার জন্য। তবুও তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে লাগলো ঐ স্বর্গ থেকে বের হয়ে আসার জন্য। সহজ কথা নয়, কারণ ও স্বর্গ থেকে বের হবার অর্থ নিজেদের দেশ, লক্ষ স্মৃতি জড়ানো প্রিয় জন্মভূমি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশে, অচেনা সমাজে বাস করা, যাদের ভাষা পর্যন্ত তাদের অজানা। কিন্তু অনস্বীকার্য ইতিহাস এই যে ঐসব দেশের জনসাধারণ তাদের জন্মভূমি থেকে পালিয়ে অজানা দেশে চলে যাবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এই চেষ্টায় তারা পরিবারের অন্যদের প্রাণও বিপন্ন করেছে, সহায়-সম্পদ বিসর্জন তো ছোট কথা।
কমিউনিস্ট পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিনে লোক পালিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে রাশিয়ানরা বিখ্যাত বা কুখ্যাত বার্লিন দেয়াল তৈরী করলো। তবুও মানুষ পালানো বন্ধ করা যায় না দেখে দেয়ালের ওপর প্রতি পঞ্চাশ গজ অন্তর স্তম্ভ (Watch tower) তৈরী করে সেখানে মেশিনগান বসানো হলো। হুকুম দেয়া হলো কাউকে দেয়াল টপকে পালাতে দেখলেই গুলী করে হত্যা করতে। তবু লোক পালানো বন্ধ হয় না দেখে পরিখা খোড়া হলো, কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হলো ও নানা রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বসানো হলো পলায়নকারীদের খুঁজে বের করে হত্যা বা বন্দী করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই ‘স্বর্গ’ থেকে পালানো বন্ধ করা গেল না। ১৯৪৯ সন থেকে ১৯৬১ সন পর্যন্ত ২৭ লাখ নর-নারী, শিশু কমিউনিস্ট স্বর্গ থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় এবং ঐ সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ ঐ পালাবার চেষ্টায় নিহত হয়, বন্দী হয়।
১৯৭৫ সনে ২০ বছর ধরে চলমান যুদ্ধে আমেরিকানরা হেরে যাবার পর সম্পূর্ণ ভিয়েতনাম কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়। এরপর সে দেশ থেকে মানুষ সমাজতন্ত্রের ভয়াবহ ‘স্বর্গ’ থেকে পালানোর জন্য মরিয়া হয়ে যে নৌকায় একশ’ জনের স্থান হবে সে নৌকায় পাঁচ সাতশ’ মানুষ ভর্তি হয়ে সমুদ্রে ভেসেছে। হাজার হাজার নৌকা ডুবে গেছে, হাজার হাজার নৌকা জলদস্যুরা (Pirates) আক্রমণ করে লুটে নিয়েছে, মানুষদের হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, তাদের বিদেশে বিক্রি করে দিয়েছে।
চীনেও ঐ একই ব্যাপার হয়েছে। মোহভঙ্গের পর হাজার হাজার চীনা তাদের দেশ থেকে বাইরের জগতে পালিয়ে যাবার চেষ্টায় প্রাণ হারিয়েছে, বন্দী হয়েছে। মূল চীন ভূখণ্ড থেকে সমুদ্র প্রণালী সাঁতরে পার হয়ে ব্রিটিশ শাসিত হংকং-এ পালিয়ে যাবার চেষ্টায় বহু চীনা ডুবে মারা গেছে। যুদ্ধে আমেরিকানরা হেরে যাবার পর সম্পূর্ণ ভিয়েতনাম কমিউনিস্টদের হাতে চলে যাবার পর সে দেশ থেকে মানুষ পালানোর যে বিরাট হিড়িক পড়ে গিয়েছিল ও তা বহু বছর পর্যন্ত চলেছে সে খবর জানা নেই এমন লোক পৃথিবীতে বিরল। ছোট বড় নৌকা বোঝাই করে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ মানুষ সমুদ্রে ভেসেছে। তারা কোথায় পৌঁছবে, কোন দেশে আশ্রয় পাবে কিছুই না জেনেও তারা শুধু দাজ্জালের ‘স্বর্গ’ থেকে পালাবার জন্য মরিয়া হয়ে যে নৌকায় একশ’ জনের স্থান হবে সে নৌকায় পাঁচ সাতশ’ মানুষ ভর্তি হয়ে সমুদ্রে ভেসেছে। হাজার হাজার নৌকা জোর বাতাসে, ঝড়ে ডুবে গেছে, হাজার হাজার নৌকা জলদস্যুরা (Pirates) আক্রমণ করে লুটে নিয়েছে, মানুষদের হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, তাদের বিদেশে বিক্রি করে দিয়েছে।
এ সমস্ত খবর হাজার হাজার বার সমস্ত পৃথিবীর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, বহু ছবি ওগুলিতে ছাপা হয়েছে। সেই সব লোমহর্ষক খবর পড়ে, ছবি দেখে পৃথিবীর মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠেছে। এতো সংখ্যায় এতো বার এই পালানোর চেষ্টা হয়েছে যে এদের জন্য একটা আলাদা শব্দই সৃষ্টি হয়েছে- The Boat People – নৌকার মানুষ। তারপর একদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বার্লিন প্রাচীর ধ্বংসের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের মোহ থেকে বেরিয়ে আসে মানুষ। কিন্তু যাবে কোথায়, আবার সেই গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ।
এভাবে একের পর এক মতবাদের উদ্ভব, চুলা থেকে কড়াই আর কড়াই থেকে চুলায় পড়ে আজকে মানুষ দিশেহারা। জাতিসংঘ গঠনের পর থেকে আজ পর্যন্ত একটি দিনও যুদ্ধহীন কাটেনি পৃথিবীর। পৌনে এক শতাব্দীতে নানা যুদ্ধে নিহত হয়েছে আরো এক কোটি বনি আদম, আহত, বিকলাঙ্গ, ঘরছাড়ার তো কোনো গোনাগাথা নেই। শান্তির জন্য সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, প্রতিটি দেশে সর্বপ্রকার অপরাধের গ্রাফ আকাশস্পর্শ করেছে। পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার ফলে বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ জমা হয়েছে মাত্র আটজন মানুষের হাতে (অক্সফাম, ২০১৭)। বাকি অর্ধেক সম্পদ নিয়ে চলছে কামড়া-কামড়ি। প্রতিদিন বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সারি। বাড়ছে হতাশা। বাড়ছে কর্মহীনতা। অস্ত্রব্যবসায়ী রাষ্ট্রগুলোর শোষণে সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ গ্রাস করছে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে।
পৃথিবীর মানুষ আজ বিক্ষুব্ধ। বাইরে যত সফলতার অহংকার থাকুক মনের গভীরে মানুষ আজ দেউলিয়া, দিশাহারা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে, বিশেষ করে যে সব দেশ এই যান্ত্রিক সভ্যতাকে গ্রহণ করেছে, সেগুলোতে প্রতিবছর খুন, যখম, ডাকাতি, ধর্ষণ, বোমাবাজি আর অপহরণের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। এমন কি বেগুনাহ, নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্তÍ এই মানুষরূপী শয়তানদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এক দিক দিয়ে মানুষ যেমন বিজ্ঞানের শিখরে উঠছে অন্য দিক দিয়ে ঠিক তেমনিভাবে সে সব রকমের অন্যায়ের চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে। মানুষের আত্মা আজ ত্রাহী সুরে চিৎকার করছে- কেন? কেন মানুষ তার জ্ঞান আর বিজ্ঞানের প্রগতিকে মনুষ্যত্বের উন্নতির পরিবর্তে তাকে অবনতির গভীর অতলে নিয়ে যাচ্ছে? তার যে অতীত ইতিহাসের দিকে মানুষ কৃপার দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে তার যে কোন বিশেষ মুহূর্ত আজকের যে কোন বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গে তুলনা করলে সে দেখবে যে, মানুষ হিসাবে সে বর্তমানে কত নিচুতে নেমে গেছে। বেশি দূর যেতে হবে না, শুধু এই বিংশ শতাব্দীতে সে যত মানুষের প্রাণ হত্যা করেছে, গত দশ শতাব্দীর সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহে তার ভগ্নাংশও করে নি। শুধু হত্যা নয়, অন্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে তার পূর্ব পুরুষদের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। আত্মার এই নিদারুণ পতনের সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রযুক্তির (Technology) ধ্বংসকারী শক্তির যোগের পরিণতি চিন্তা করে মানুষ আজ শিউরে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্র জানে সে যদি তার শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করতে চায় তবে যতক্ষণে তার আন্তঃমহাদেশীয় মিসাইল (I.C.B.M.) রাশিয়াতে পৌঁছে রাশিয়ার নর-নারী শিশুদের মাটির সঙ্গে মিশিযে দেবে, ততক্ষণে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রও আমেরিকার দিকে অর্ধেক রাস্তা পার হয়ে আসবে এবং আমেরিকারও ঠিক সেই দশাই ঘটবে। এই চিন্তাই তাদেরকে পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে রেখেছে। কিন্তু কতদিন?
মানুষ আজ যে সভ্যতার বড়াই করছে সত্যি কি এটা সভ্যতা? না, এটা সভ্যতা নয়। এটা আত্মাহীন বিবেকহীন একটা যান্ত্রিক প্রগতিমাত্র, যে প্রগতি মানুষকে যত সে যান্ত্রিকভাবে এগুচ্ছে, তত তাকে মানুষ হিসাবে টেনে নিচে নামাচ্ছে- তাকে কিছুতেই আর যাই হোক সভ্যতা বলে আখ্যা দেয়া যায় না। এই যান্ত্রিক প্রগতি সে এত দূরে নিয়ে গেছে যে, ইতিমধ্যেই তার হাতে আজ যে পারমাণবিক (Nuclear) অস্ত্র জমেছে তা দিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটাকে ভেঙ্গে দেয়া যায়। ভেঙ্গে যে আজও দেয় নি তার কারণ এই সভ্যতা নয়, নর-নারী, শিশু, পশু সব নিহত হবে এ কোমল মানবিক বৃত্তিও নয়, কারণ ভয়। ভয় যে শত্রুর সঙ্গে সে নিজেও যাবে। যুক্তরাষ্ট্র জানে সে যদি তার শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করতে চায় তবে যতক্ষণে তার আন্তঃমহাদেশীয় মিসাইল (I.C.B.M.) রাশিয়াতে পৌঁছে রাশিয়ার নর-নারী শিশুদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে, ততক্ষণে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রও আমেরিকার দিকে অর্ধেক রাস্তা পার হয়ে আসবে এবং আমেরিকারও ঠিক সেই দশাই ঘটবে। রাশিয়াও জানে, সে যদি আমেরিকাকে ধ্বংস করতে চায় তবে তারও ঠিক তেমনি দশাই হবে। মানবতা নয়, দয়া নয়, ন্যায়ের প্রতি সম্মান নয়, অন্যায়ের প্রতি বিরূপতা নয়, কত কোটি মানুষ, শিশু পশু নিহত হবে, এ অনুভূতিও নয়- শুধু ভয়, শত্রুকে মারলে আমিও মরব। মানবতা ও ন্যায়ের খাতিরে যে এই হত্যাযজ্ঞ থেকে এরা বিরত নয় তার প্রমাণ নাগাসাকি ও হিরোশিমা। নিজের পরিণামের এই ভয়ই শুধু পৃথিবী ধ্বংসকারী অস্ত্রগুলোকে ব্যবহার থেকে মানুষকে বিরত রেখেছে। যান্ত্রিক ‘সভ্য’ ভাষায় এরই নাম (Deterent), দা’তাত। যে মুহূর্তে রাশিয়া বা আমেরিকা নিশ্চিতভাবে বুঝবে, যে যান্ত্রিক প্রগতিতে আমরা এতদূর এগিয়েছি, এমন অস্ত্র তৈরি করতে পেরেছি যে শত্রুর আঘাত আমি সম্পূর্ণভাবে ঠেকাতে পারব এবং আমার আঘাতকে সে ঠেকাতে পারবে না, সে মুহূর্তে সে শত্রুকে আঘাত হানবে। কোনো ন্যায়-অন্যায় বোধ, কোনো দয়া-মায়া-মমতা তাদেরকে এতটুকু দেরি করাতে পারবে না। এটা আজ আর কোন গোপনীয় কথা নয় যে, শত্রুর শক্তিই পৃথিবীর ছোট বড় রাষ্ট্রগুলিকে প্রলয়ংকরী যুদ্ধ শুরু করা থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে। এই সেদিনও আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফোর্ড পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, “দা’তাত (Deterent) কিছু নয়- আমাদের সামরিক শক্তিই হচ্ছে শান্তির সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি।” অর্থাৎ সোজা কথায় আমেরিকা পারমাণবিক ইত্যাদি শক্তিতে যতক্ষণ ততটুকু শক্তিশালী থাকবে যে, তাকে আঘাত করলে আঘাতকারীকেও মরতে হবে, শুধু ততক্ষণই আমেরিকা নিরাপদ। উল্টোদিকে রাশিয়ার সম্বন্ধেও ঐ একই কথা।
দু’জনে দু’জনের বুকের উপর বন্দুক নিশানা করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ট্রিগার টিপছেনা শুধু এই কারণে যে একজন ট্রিগার টিপলে অন্যজনও টিপবে। আর দু’জনেই শেষ হবে। শুধু ভয়ের উপর ভিত্তি করে আজ যে মানুষ বলে জাতিটা কোন মতে বেঁচে আছে এটাকে যদি কেউ সভ্যতা বলে অভিহিত করে তবে তার সাথে আমি একমত নই। এতো সভ্যতা নয়ই শুধু একটি যান্ত্রিক প্রগতি এবং এমনি অবস্থা অনির্দিষ্ট কালের জন্য চলতে পারে না। মানুষ যদি এখনও না বুঝে যে তার এ আত্মাহীন যান্ত্রিক (Technology) প্রগতির পথ ছেড়ে তারা এই যান্ত্রিক জ্ঞান মানুষের কল্যাণের কাজে লাগাতে হবে, তার আত্মাকে উন্নত করতে হবে এবং বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন ভাবে গড়তে হবে। তবে আজ হোক আর কাল হোক বন্দুকের ট্রিগার একজনকে টিপতেই হবে।
মানুষ ইচ্ছে করে এই আত্মহত্যা করবে না ঠিক, কিন্তু দু’জন একে অন্যের বুকের উপর বন্দুক তাক করে চিরদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, এও ঠিক কিনা? অবস্থাই (Circumstances) বাধ্য করবে একজন না একজনকে ট্রিগার টিপতে। এ শতাব্দীতে মানুষ দু’টো বিশ্বযুদ্ধ (World War) করেছে। প্রথমটা ধরুন। ১৯১৪ সনে যে দিন যুদ্ধ শুরু হয় তার আগের দিন যদি সমস্ত পৃথিবীতে একটা গণভোট (Referendum) নেয়া হত এই বলে যে, যুদ্ধ চাও কি চাওনা, তবে যুদ্ধের পক্ষে মানুষ কোন ভোট দিত না, দিলেও শূণ্যের কোঠার কাছাকাছি। এমন কি যারা পরের দিন মহাযুদ্ধ আরম্ভ করেছিল তারাও না। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কি বাঁধেনি? সেই যুদ্ধে চার কোটি মানুষ হতাহত হয় নি? তারপর সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মাত্র একুশ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের দিন যদি আবার পৃথিবীময়- এমন কি যে সব দেশ যুদ্ধ শুরু করল তাদের সহ গণভোট নেয়া যেত, তবে তারও ফল ঐ আগের গণভোটের মতই হত- যুদ্ধের পক্ষে শূণ্যের কোঠায়। কিন্তু তাতে কি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বন্ধ হয়েছে? হয় নি- এবং সে যুদ্ধে সাত কোটি মানুষ নামক প্রাণী হতাহত হয়েছে, বীভৎসভাবে পঙ্গু হয়েছে, কোটি কোটি স্ত্রীলোক বিধবা হয়েছে, কোটি কোটি ছেলেমেয়ে বাপ-মা হারিয়েছে, কোটি কোটি স্ত্রীলোক ধর্ষিতা হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীময় মানুষও যদি কোন বিশেষ ব্যাপার না চায়, তবুও তা হয়; এবং পৃথিবীময় মানুষও যদি কোন ব্যাপার চায়, যেমন শান্তি, তা হয় না।
কেন? আগেই বলেছি- অবস্থা (Circumstances) আর এই অবস্থার জন্ম হয় মানুষেরই কাজের ফলে- তার কর্মফল সে আর এড়াতে পারে না শত অনিচ্ছা থাকলেও। হাজার চেষ্টা করলেও পরিণতি তাকে ভোগ করতেই হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ কেমন করে যুদ্ধ আরম্ভ হল তা লিখতে যেয়ে লেখেছেন “We all slithered into it” অর্থাৎ আমরা কেমন যেন পিছলিয়ে ওর মধ্যে পড়ে গেলাম। আজ পৃথিবীর চারদিক থেকে আর্ত মানুষের হাহাকার উঠছে- শান্তি চাই, শান্তি চাই। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনায়, শোষণে, শাসিতের উপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের উপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের উপর ধুর্তের বঞ্চনায়, পৃথিবী আজ মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নিরপরাধ ও শিশুর রক্তে আজ পৃথিবীর মাটি ভেজা। এ অবস্থা বিনা কারণে হয় নি। অন্য কোন গ্রহ থেকে কেউ এসে পৃথিবীতে এ অবস্থা সৃষ্টি করে নি। মানুষ নিজেই এই অবস্থার স্রষ্টা। তাই পৃথিবীতে শান্তির জন্য এত চেচামেচি, এত লেখা, এত কথা, এত শান্তির প্রচার- কিছুই হচ্ছে না। শুধু হচ্ছে না নয়, সমস্ত রকম পরিসংখ্যান (Statistics) বলে দিচ্ছে যে, একমাত্র যান্ত্রিক উন্নতি ছাড়া আর সমস্ত দিক দিয়ে মানুষ অবনতির পথে যাচ্ছে- এবং দ্রুত যাচ্ছে। বস্তুবাদী শিক্ষায় মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছে তত বেশি আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, মানবতাবোধহীন, ভদ্রবেশী দুর্বৃত্তে পরিণত হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সর্বরকম অপরাধ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে বরং বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এমন কোন দেশ নেই যেখানে অপরাধের সংখ্যা কমছে। এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি চিন্তা করে সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশাহারা। এর উপর আবার ভয়াবহ বিপদ দাঁড়িয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের। এ সবই, অর্থাৎ এই অবস্থা প্রমাণ করছে যে মানব জাতি আজ পর্যন্ত এমন একটা জীবনব্যবস্থা তার নিজের জন্য সৃষ্টি বা প্রণয়ন করতে পারে নি যেটা পালন করলে যান্ত্রিক উন্নতি সত্ত্বেও মানুষ এই পৃথিবীতে শান্তিতে বাস করতে পারে।
তাহলে উপায় কি? মানুষের ভবিষ্যত নিদারুণ পরিণতিকে এড়াবার পথ কি?
পথ আছে, উপায় আছে। কিন্তু সে পথ গ্রহণ করার সময় খুব বেশি নেই। যে পথে চললে, যে জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করলে মানুষ জাতি অপ্রতিরোধ্যভাবে তার আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাবে না, তার বুদ্ধি ও মনের, দেহের ও আত্মার এমন একটা সুষ্ঠু, ভারসাম্য মিশ্রণ দেবে যা তাকে দু’দিকেই উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবে। এমন পথ খুঁজতে গেলে সর্বপ্রথম মানুষকে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে সিদ্ধান্তের উপর তার সাফল্য ও বিফলতা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে। সেটা হচ্ছে ধীরস্থির, নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত করা যে, এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বের কোন স্রষ্টা আছেন, কি নেই। যদি থাকেন তাহলে তাঁর রচিত কোনো জীবনবিধান পৃথিবীতে অবিকৃতভাবে আছে কিনা সেটার অনুসন্ধান করতে হবে। কারণ স্রষ্টাই ভালো জানবেন যে কোন পথে তার সৃষ্ট মানুষ একটি ভারসাম্যপূর্ণ, প্রগতিশীল, শান্তিময় জীবন লাভ করতে পারবে।
সাধারণ বুদ্ধিতেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মানুষ পৃথিবীতে কোন পথে কিভাবে চললে নিরাপত্তা ও শান্তির মধ্যে থাকতে পারবে তা স্রষ্টা থাকলে বা না থাকলে এই উভয় অবস্থাতেই একই হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। আরও সহজ করতে গেলে- আপনাকে যদি কোনও বিশেষ একটি দেশে যেতে হয়, তবে সর্ব অবস্থাতেই আপনার সিদ্ধান্ত কি একই হবে? যদি সেই দেশটাতে দৃঢ় আইন-কানুন, বিচারালয়, কর্তব্যনিষ্ঠ, দক্ষ পুলিশ থাকে, অথবা সেই দেশটাতে কোন সরকার, আইন-কানুন, পুলিশ এমনকি কোর্ট-কাচারী কিছুই না থাকে- এই উভয় অবস্থাতেই কি আপনি একইভাবে সেই দেশে প্রবেশ করবেন এবং একইভাবে বিচরণ করবেন? কোনো দ্বিধা না করে বলা যায় যে- অবশ্যই নয়। প্রথম অবস্থায় আপনি একা এবং নিরস্ত্র সে দেশে প্রবেশ করবেন এবং নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াবেন এবং দ্বিতীয় অবস্থায় আপনি একা সে দেশে অবশ্যই প্রবেশ করবেন না। যদি যেতেই হয় তবে আপনি দল গঠন করবেন, অস্ত্র সজ্জিত হবেন এবং চলাফেরার সময় অত্যন্ত সতর্ক এবং সাবধান হবেন। যেহেতু দেশে আইন নেই তাই আপনার অস্ত্রই হবে আইন। অর্থাৎ ঐ দেশে একটা শক্তিশালী সরকার থাকা বা না থাকার উপর আপনার মত, পথ, কাজ সর্ব কিছু শুধু বদলাচ্ছে না একেবারে উল্টো হয়ে যাচ্ছে। কাজেই স্রষ্টা আছেন কি নেই এই সিদ্ধান্তের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করছে মানুষের সত্যিকারের শান্তিময়, সুখী প্রগতির পথ কিম্বা বিপথ। মানব জাতি হিসাবে, মানুষ আজও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নি, তাই তার মত ও পথের এত বিভিন্নতা, এত সংঘর্ষ। কাজেই মানব জাতিকে সামগ্রিকভাবে আজ স্থির সিদ্ধান্ত নিতেই হবে যে স্রষ্টা আছেন কি নেই, কারণ আজ শুধু মানুষে মানুষে যুদ্ধ, রক্তারক্তি, হানাহানি, অশান্তি আর অশ্রু নয় এগুলো দিয়ে তার অতীত ও বর্তমান পূর্ণ হয়ে আছে- আজ বাজী তার একেবারে অস্তিত্বের।