নারীরা জাতির অর্ধেক জনশক্তি। তাদেরকে বাদ দিলে জাতির শক্তিও অর্ধেক কমে যায় এবং জাতির উন্নতি প্রগতির সম্ভাবনাও লুপ্ত হয়ে যায়। কারণ নারীদেরকে তো সমাজ থেকে বাদ দেওয়া যাবে না, তারা তখন জাতির বোঝা হয়ে দাঁড়াবে যা গোটা জাতির অগ্রগতিকে মন্থর করে দেবে।
আল্লাহর রসুল নারীদের কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে তাদের মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভাগুলো বিকশিত হয়ে জাতিকেই সমৃদ্ধ করেছে, উন্নত অবস্থানে নিয়ে গেছে। তাদেরকে বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন হয়েছে শিক্ষাপ্রদান এবং দায়িত্ব অর্পণ। ইসলামের সমাজের শিক্ষাকেন্দ্র, প্রশাসনিক কার্যালয় সবই ছিল মসজিদ। তাই নারীদেরকে সামষ্টিক কাজে সম্পৃক্ত করতে হলে মসজিদে তাদের যাতায়াত অবারিত করতে হয়েছে। রসুল সেটাই করেছেন।
এই কাজটি করা রসুলের জন্যও খুব সহজ হয় নি। তাঁকে বারবার করে নারীদেরকে এগিয়ে নেওয়ার গুরুত্বটা জাতির সামনে তুলে ধরতে হয়েছে। অনেকেই নারীদেরকে আবৃত রাখার বস্তু অথবা পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন উপকারী জীববিশেষ বলে ভাবত। নিজেদের অভিরুচিকে নারীর উপর চাপিয়ে দিত জোর করে। সমাজটা ওভাবেই গড়ে উঠেছিল। সেই সমাজকে ভাঙার কাজ নিয়েছিলেন রসুলাল্লাহ। এজন্য প্রথমেই তাঁকে তাঁর সেই সঙ্গীদেরকে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে হয়েছে যারা চাইতেন না যে মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে যাক, সকল কাজের কৃতিত্বে ভাগ বসাক; যারা চাইতেন মেয়েরা তাদের আজ্ঞাবহ অনুবর্তিনী হয়ে থাকুক।
আল্লাহরর রসুলের এই নতুন সমাজব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে যারা মন থেকে মেনে নিতে পারেন না তারা এবার খুঁজতে থাকেন কী করে নারীদেরকে আবার গৃহবন্দী করা যায়। এজন্য তারা প্রথমে তাদেরকে মসজিদে যাওয়া থেকে ফেরানোর মাসলা বের করতে শুরু করল। রসুলাল্লাহর সারা জীবনের সুন্নাহকে বদলানোর জন্য তারা একটি পয়েন্টকে মহা গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন। সেটা হচ্ছে, খলিফা ওমর (রা.) নাকি নারীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং সেটাও শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত। ফকিহরা বলছেন এটা নাকি মাখরুহে তাহরিমি। আসুন দেখা যাক মূল বিষয়টা কী?
একবার খলিফা উমর (রা.) এর স্ত্রী আতিকা বিনতে যায়েদ (রা.) ফজরের বা এশার সালাতে মসজিদে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। ওমর (রা.) চুপ করে থাকলেন, কোনো উত্তর দিলেন না।
বস্তুত ঐ সময়টাতে তিনি চাচ্ছিলেন না যে তাঁর স্ত্রীরা কেউ মসজিদে যান। কারণ তখন কিছু দুষ্ট মোনাফেক চরিত্রের লোক মেয়েদের পিছে পিছে অনুসরণ করত যা মেয়েদেরকে সন্ত্রস্ত করত। যেন কোনো অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে সেজন্য ওমর (রা.) মনে মনে চাইতেন না যে রাতে মেয়েরা মসজিদে যাক। কিন্তু তিনি মুখ ফুটে কোনোদিন বলেন নি যে মেয়েরা মসজিদে যাবে না।
তখন আতিকা (রা.) বললেন, “আল্লাহর শপথ! আপনি যদি আমাকে সরাসরি নিষেধ না করেন তাহলে আমি মসজিদে যাবই যাব।” তথাপি ওমর (রা.) চুপ রইলেন, কারণ রসুলাল্লাহ স্বয়ং নারীদেরকে মসজিদে যাওয়ার আদেশ করেছেন, ঋতুবতী নারীদেরকেও আলোচনা শোনার জন্য মসজিদে বা ঈদগাহে উপস্থিত করেছেন, আল্লাহও বলেছেন, হে বনি আদম! তোমরা যখন সালাতের উদ্দেশে মসজিদে যাবে তখন উত্তম পোশাক পরিধান করবে (সুরা আরাফ, ৩১)।” বনি আদম বলতে নারী পুরুষ উভয়কেই বোঝায়। তাই ওমর (রা.) ইসলামের এই হুকুমের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারেন না। কিন্তু পরিস্থিতি তাঁকে চিন্তিত করেছিল, তবু তিনি তাঁর স্ত্রীকে যেতে দিলেন।
পরবর্তীকালে একদিন আতিকা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে আপনি কেন অমন করে মসজিদে যেতেন যখন এটা জানতেন যে ওমর (রা.) এটা পছন্দ করছেন না? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “ঠিক সেই কারণেই যার দরুন তিনিই আমাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতে পারেন নি। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা (১:১০৬)।
একদিন ওমর (রা.) স্বয়ং তাঁর স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমি কসম করে বলছি তুমি ভালো করে জানো যে আমি এটা অপছন্দ করি।” তখন আতিকা (রা.) বলেছিলেন, “আল্লাহর শপথ! আমি বিরত হবো না যতক্ষণ না আপনি আমাকে নিষেধ করেন।” তখন ওমর (রা.) বললেন, “সত্য বলতে আমি তো তোমাকে নিষেধ করছি না।” যখন মসজিদে নববীর ভেতরে ওমর (রা.) ছুরিকাঘাতে আততায়ীর হাতে নিহত হন তখন সেখানে তাঁর স্ত্রী আতিকা বিনতে যায়েদ (রা.) -ও উপস্থিত ছিলেন। (আল মুহাল্লা, ইবনে হাজাম)।
ওমর (রা.) মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মসজিদে মেয়েদের জন্য পৃথক একটি দরজা বানিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েরা তখন দুটো দরজাই ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু পুরুষরা কেবল একটি দরজাই ব্যবহার করতেন। সুতরাং ওমর (রা.) নারীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন এমন কথা আমিরুল মোমেনীনের উপর একটি অপবাদ আরোপের শামিল।
সমাজে যদি ফেতনা বিস্তার লাভ করবে, তখন নারী ও পুরুষ সকলের উপর ফরজ দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে সেই ফেতনাকে নির্মূল করার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করা। কিন্তু নারীদেরকে লুকিয়ে রাখা তো ফেতনা নির্মূল করার কোনো পন্থা হতে পারে না। আল্লাহই স্বয়ং বলেছেন, তোমরা যুদ্ধ করো যে পর্যন্ত না ফেতনা দূরীভূত হয় এবং জীবনব্যবস্থা সম্পূণরূপে আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। (সুরা আনফাল, ৩৯)। আমাদের ইসলামী বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধ জেহাদ করার মতো শ্রমসাধ্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজের থেকে পলায়ন করার জন্যই ফেতনার যুগের অজুহাত তুলে নারীদেরকে ঘরে ধরে রাখার মাসলা আবিষ্কার করছেন। কিন্তু লাভ হচ্ছে কী?
বিগত আটশ বছর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম জাতি সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের শিকার। হালাকু খান, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লঙদের পরে ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতি যেমন ইংরেজ, ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইতালিয় সবশেষে এখন মার্কিনরা একটার পর একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। ইহুদি বৌদ্ধ খ্রিষ্টান হিন্দু সকল জাতির লোকেরাই যে যেখানে পাচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর হামলা চালাচ্ছে, ঘর থেকে টেনে বের করে মুসলিম পর্দানশীন নারীদেরকে গণধর্ষণ করছে। তাদেরকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে, বিক্রি করে দিচ্ছে বেশ্যালয়ে। তারা উদ্বাস্তু হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, জীবিকার প্রয়োজনে দেহবিক্রি করছে।
এই হলো নারীদেরকে পিছিয়ে রাখার, তাদের উপর বিকৃত পর্দাপ্রথা চাপিয়ে দেওয়ার নেটফল। তারা আজ নিজেদের ইজ্জত রক্ষা করতে সমর্থ নয়, জাতিও তাদেরকে রক্ষা করতে সমর্থ নয়। অথচ এই পরাজিত লাঞ্ছিত জাতির আলেম মুফতি মোজাদ্দিসরা কী করছেন? তারা বসে বসে মাসলা বের করছেন যে, নারীর চোখ দেখা, ভ্রু প্লাক করা, নেইল পলিশ দেওয়া জায়েজ নাকি না জায়েজ। জাতির বর্তমান এই হীনতা নিয়ে তাদের মনে কোনো হীনম্মন্যতা নেই, পরিত্রাণের পথ খোঁজারও কোনো তাড়না নেই। এখনও তাদের ওয়াজের মূল বিষয় নারীর পর্দা আর অন্য কোনো ফেরকার আলেমদের বিষোদ্গার করা। আল্লাহর দীনের সঙ্গে এর চেয়ে বড় উপহাস আর কী হতে পারে? অথচ উম্মতে মোহাম্মদীর নারীরা রসুলের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছেন, অস্ত্র হাতে পরাজিত করেছেন রোমান পারস্যের সুপ্রশিক্ষিত সেনানীকে।
এবার আমরা হাদিস গ্রন্থ থেকে এতদসংক্রান্ত কিছু হাদিস জেনে নেব।
■ আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল ﷺ বলেছেন, -“তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে আসতে বাধা দিও না। [সহিহ মুসলিম, খণ্ড ১, অধ্যায় ১৭৭, হাদিস হা/৮৮৬]
■ রাসুল ﷺ স্বামীদের উদ্দেশ করে বিশেষভাবে বলেছেন যদি তোমাদের মধ্যকার কারো স্ত্রী মসজিদে আসার অনুমতি চায়, তাহলে তাকে মসজিদে আসতে নিষেধ করবে না। [সহিহ বুখারী, খণ্ড ১, অধ্যায় নামাজ, অনুচ্ছেদ ৮০, হাদিস হ/৮৩২]
■ আবু হেুারায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, -“তোমরা আল্লাহর দাসীদেরকে আল্লাহর মসজিদসমূহে আসতে নিষেধ করো না। তবে তারা যেনো সুগন্ধি ব্যবহার না করে বের হয়। [সুনানে আবু দাউদ, খণ্ড ১, অনুচ্ছেদ ৫৮, হাদিস হা/৫৬৫]
■ আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, -“তোমরা তোমাদের নারীদেরকে রাত্রিবেলা মসজিদে যাওয়া থেকে বাধা প্রদান করবে না।” [মুসনাদ ইমাম আহমাদ, খণ্ড-২, হা/১৩৩২]
■ আয়িশা(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নারীরা রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সাথে ফজরের সালাত আদায় করতো, অতঃপর তাদের চাদর মুড়ি দিয়ে বের হয়ে যেত (তখন) তাদেরকে চেনা যেত না। [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ, মুসনাদ ইমাম আহমাদ, খণ্ড-২ হা/১৩৪৪]
■ জনৈকা নারী সাহাবি রাসুল ﷺ এর খুতবা শুনে শুনে সুরা কাফ মুখস্থ করেছিলেন। [মুসলিম হা/২০৪৯; মিশকাত হা/১৪০৯]
এই হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায় রসুলাল্লাহ এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন যেখানে নারীরা এতটাই নিরাপদ ছিলেন যে তারা রাতের অন্ধকারেও মসজিদে যাতায়াত করতে পারতেন। সুতরাং নারীদেরকে বন্দী না করে অমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসলামের আগমনের উদ্দেশ্য।