আজকে সারা পৃথিবীময় কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা নিশ্চয়ই সচেতন ব্যক্তিমাত্রেরই জানা। যারা দুনিয়ার খোঁজ-খবর রাখেন, পত্র-পত্রিকা পড়েন, তাঁরা অবশ্যই জানেন এবং দেখতে পাচ্ছেন সমস্ত দুনিয়া আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আজকে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। কারণ তাদের অর্থনীতি যুদ্ধ-অর্থনীতি (War Economy)। যুদ্ধ লাগলে যুদ্ধরত দেশগুলোকে বন্দুক কিনতে হবে, বুলেট কিনতে হবে, বোমা কিনতে হবে। তা না হলে তাদের অস্ত্রের বাজার চাঙ্গা হবে না। সেই উদ্দেশ্যসাধনেই তারা পৃথিবীতে বিধ্বংসী তা আরম্ভ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছি আমরা মুসলমান নামক এই জাতি। আমরা আজকে এই দাজ্জালীয় সভ্যতা তথা বস্তুবাদী সভ্যতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি। তারা টার্গেট করেছে সমগ্র মুসলিম জাতিকে, তারা টার্গেট করেছে ইসলামকে।
এক যুগ ধরে তারা মিডিয়াকে লাগিয়ে দিয়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে। বলা হচ্ছে মুসলমানরা সন্ত্রাসী আর ইসলাম সন্ত্রাসের ধর্ম। ব্যাস, তারপরের ঘটনা পরিষ্কার। এখন আক্রামন হচ্ছে মুসলমান, বোমা পড়ে মুসলিম দেশগুলির উপরে, উদ্বাস্তু হয় মুসলামন, এই মুহূর্তে সাত কোটি উদ্বাস্তু মুসলমান, সিরিয়ায় দুই পরাশক্তির (আমেরিকা ও রাশিয়া) সামরিক সক্ষমতার প্রদর্শন চলছে, যার বলি হচ্ছে মুসলমান। আমাদের বাড়ির কাছে মিয়ানমার, সেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলমানদেরকে তাদের নিজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো, কোনো বিচার হয়নি। এই হচ্ছে আত্মর্জাতিক পরিস্থিতি আর মুসলমানের অভ্যত্মরীণ সংকট। তারা এক জাতি হয়েও, এক আল্লহর বান্দা হয়েও, এক নবীর উম্মাত হয়েও, এক কেতাবের অনুসারী, বিশ্বাসী হয়েও আজ নিজেরা নিজেরা শিয়া, সুন্নি, শাফি, হানাফি, হাম্বলি, মালেকি, এই তরিকা-ওই তরিকা, এই মাহাজাব, ওই ফেরকায় বিভক্ত হয়ে, নিজেরা নিজেরাই দ্বন্দ্ব করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমনই একটি পরিস্থিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এই পৃথিবীর বুকে।
বর্তমানে আমরা যে ব্যবস্থাটির অধীনে জীবনযাপন করছি সেটা হলো গণতন্ত্র। বর্তমানে গণতন্ত্র একটি নিমজ্জমান ব্যবস্থা। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। অনেকের আশা আকাঙ্কা ছিল এই নির্বাচনকে দেখার, পর্যবেক্ষণ করার, আশা করি সবাই দেখেছেন। বুঝতে পেরেছেন কেমন নির্বাচন হয়েছে, যারা প্রার্থী ছিলেন তারা কীভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন। নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে, কতটুকু দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে তা আমার নতুন করে বলার প্রয়োজন হবে না। যারা খোঁজ খবর রাখেন তাদের সামনে সে দৃশ্যটি পরিষ্কার।
আমরা গণতান্ত্রিক ধারায় জীবনব্যবস্থার চর্চা (Practice) করছি। এ ব্যবস্থায় একটি সরকার অতি অল্প সময়ের জন্য রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে, বিশাল বিশাল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত করে এক কথায় সম¯ত্ম রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়োজিত করে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য। নির্বাচন হওয়ার পরে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার কিছু দিন যেতে না যেতেই শুরু হযে হয়ে যায় সরকারকে জ্বালাও পুরাও করার প্রতিযোগিতা। হরতাল, অবরোধ জ্বালাও-পোড়াও কোনো কিছুই বাদ থাকে না। তারপর কি হয়?
কোনোরকমে দুই তিন বছর যাওয়ার পরেই আবার শুরু হয় অস্থিরতা। সরকারগুলি দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার পরিবর্তে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার কৌশল বাস্তবায়ন। এক সময় বিরোধী দল থাকতো এক-দুইটা। এখন জোট হয়েছে! এই হচ্ছে সরকারগুলোর অবস্থা। সরকার যতই উন্নয়ন করম্নক, যতই প্রগতি দেখাক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে যায় জনতার চোখে।
এই অবস্থা আমরা পরর্যবেক্ষণ করেছি। অদ্ভুত একটি ব্যাপার হচ্ছে- আমাদের জনগণ দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচারের দায়ে এক দলকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন আরেক দলকে ক্ষমতায় আনে যেন নতুন সরকার ভালো কিছু করে দেখায়। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর যেতে না যেতেই তাদের রুচি পরিবর্তন হয়ে যায়! পূর্বের দলকে বা জোটকে তারা আবার পছন্দ করে। নতুন যারা ক্ষমসীন হন তারাও আবার ক্ষমতাচুত্য দলকে দমন করার কৌশল অবলম্বন করায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। গণতন্ত্রে প্রচলিত একটা বাক্য বলা হয়ে থাকে- ‘এক দল অপর দলকে বিরোধিতা করা নাকি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য!’ বিরোধী দল থাকবে, বিরোধিতা করবে, তর্ক বিতর্ক হবে, একটা সিদ্ধন্তে আসবে- এটা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
কিন্তু এখন আর সেটা সৌন্দর্যের মধ্যে নেই, শত্রুদের পর্যবসিত হয়েছে। এখন নির্মূল করার প্রক্রিয়া চলছে। ফলে যারা সরকারে থাকেন তারা চিন্তা করেন যে, আমরা যদি ক্ষমতা থেকে সরে যাই, তা হলে একটা রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। তাই যেকোনো প্রকারে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। যার জন্য তারা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যেকোনো প্রক্রিয়াই অবলম্বন করতে দ্বিধা বা কার্পণ্য করেন না। আবার বিরোধীদলে যারা আছেন, তারাও যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেন, এতে মানুষ খুন হলেও কুছ পরোয়া নেহি। এই ক্ষেত্রে যদি বৈদেশিক শত্রুকেও আমন্ত্রণ জানাতে হয় তাও সই।
এই অবস্থায় আমরা আমাদের জীবন কাটাচ্ছি। এই নিমজ্জমান সিস্টেম (System) আমাদেরকে এর চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারে নি, আর না কোনোদিন পারবে। গণতন্ত্রের এই যে একটা জীবনদর্শন বা জীবনব্যবস্থা, যা আমরা আমাদের এই অঞ্চলে দশকের পর দশক ধরে চর্চা করে চলেছি এই জীবনব্যবস্থা আমাদের কতটুকু কাক্সিড়্গত সমাজ উপহার দিয়েছে? কতটুকু স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে? এভাবে এগোতে থাকলে একটা জাতি কতটুকু উন্নতি করবে বা কতটুকু প্রগতিশীল হবে? আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি যে, গণতন্ত্র আমাদেরকে এর চাইতে আর বেশি কিছুই দিতে পারবে না। এখন এ ব্যাপারে এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।